১২ ডিসেম্বর, ২০২২ ১৭:৩১
আব্দুল অদুদ দীপক ও আহমেদ হুমায়ুন হাবীব, সহোদর তারা। ব্রিটিশ বাংলাদেশি মানুষের কাছ থেকে প্রায় দেড়শ’ কোটি টাকা আমানত সংগ্রহ করেছেন রীতিমতো লন্ডনে সুবিশাল ও বিভিন্ন শহরে শাখা অফিস খুলে। এরপর গত দশ মাস ধরে অসংখ্যবার তারিখ দিলেও মানুষের আমানত ফেরত দেওয়া তো দূরের কথা, উল্টো লন্ডন ছেড়ে দুবাই পাড়ি দিয়েছেন তারা।
বাঙালিপাড়ার ৮৫ মারডল স্ট্রিটের অফিস এখন তালাবদ্ধ। সর্বশেষ, ১০ ডিসেম্বর থেকে পর্যায়ক্রমে অর্থ ফেরতের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তারা। কিন্তু ১১ ডিসেম্বর পর্যন্ত কোনও বিনিয়োগকারী অর্থ ফেরতের কথা জানাননি। অতীতেও প্রতিশ্রুতি অনুসারে টাকা ফেরত দেওয়া হয়নি বিনিয়োগকারীদের। এতে উদ্বিগ্ন বিনিয়োগকারীরা হতাশ ও ক্ষুব্ধ।
যেভাবে হয় প্রতারণা
জানা গেছে, পূর্ব লন্ডনে ৮৫ মারডল স্ট্রিট ঠিকানা দিয়ে যুক্তরাজ্যের কোম্পানি হাউজে হাবিবসন্স অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট লিমিটেড নামে একটি কোম্পানির নিবন্ধন রয়েছে। ২০১৭ সালের ১৭ ডিসেম্বর নিবন্ধিত কোম্পানিটির নম্বর ১১০৭০৫৮২। এটি নিবন্ধন করা হয়েছিল আব্দুল অদুদ দীপক ও আহমেদ হুমায়ুন হাবীবের নামে। গত চার বছরে এদের নামে বিভিন্ন ঠিকানায় বেশ কয়েকটি কোম্পানি নিবন্ধিত হয় কোম্পানি হাউজে। কয়েকটি কোম্পানি তারা নিজেরাই বন্ধ করে দেয়। হাবিবসন্স নামের কোম্পানিটির নিবন্ধন ২০২০ সালের ১ ডিসেম্বর বাতিল হয়।
ভুক্তভোগীদের কয়েকজন জানান, কোম্পানিটি বন্ধ হলেও একই কার্যালয়ে হাবিবসন্স ক্যাপিটাল নামের ভুয়া কোম্পানির সাইন বোর্ড ঝুলিয়ে মানুষের কাছ থেকে বিনিয়োগ সংগ্রহ করতে থাকেন দীপক ও হুমায়ুন। এর পাশাপাশি তারা দুবাইভিত্তিক প্যাসিফিক গ্লোবাল অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট নামের আরেকটি কোম্পানির পক্ষ থেকে গ্রাহকদের চুক্তিপত্র দিয়ে অর্থ সংগ্রহ করেন। মূলত ফোরেক্সের মতো শেয়ার বাজার সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ও কারেন্সি মার্কেটে বিনিয়োগের কথা বলে গ্রাহকদের কাছ থেকে আমানত নেওয়া হয়। গ্রাহকদের বলা হয়, আমানতের ৯৫ শতাংশ অর্থের বিপরীতে বিমা করা থাকবে, তাই বিনিয়োগ হালাল ও সম্পূর্ণ নিরাপদ। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ব্যবসায় ক্ষতির কথা বলে গ্রাহকদের লভ্যাংশ দেওয়া বন্ধ করে দেওয়া হয়।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ
নাম না প্রকাশের শর্তে হাবিবসন্স ক্যাপিটাল ও প্যাসিফিক গ্লোবাল অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টে বিনিয়োগকারী লন্ডনের এক আইনজীবী জানান, তাদের সব কোম্পানিতে ব্রিটেনের বাংলাদেশিদের মোট বিনিয়োগ প্রায় দেড়শ’ কোটি টাকা। ব্রিটেনে মোট গ্রাহক তিনশ’ জনের বেশি। দেশে আছেন আরও শতাধিক।
নাম না প্রকাশের শর্তে একজন গ্রাহক জানান, তার রেস্টুরেন্ট বিক্রির পুরো টাকা তিনি হাবিবসন্সে বিনিয়োগ করেছেন। এখন তারা তাকে ভয় দেখাচ্ছে তিনি তো রেস্টুরেন্ট বিক্রির টাকা ট্যাক্স পরিশোধ করে এখানে বিনিয়োগ করেননি। টাকা নিয়ে বাড়াবাড়ি করলে তার সব তথ্য ব্রিটিশ সরকারের রাজস্ব বিভাগে জানিয়ে দেওয়া হবে। হুমায়ুনের এ হুমকির অডিও রেকর্ড তিনি প্রমাণ হিসেবে এই প্রতিবেদককে শুনিয়েছেন।
পূর্ব লন্ডনে বসবাসরত তারিক চৌধুরী নামের একজন বিনিয়োগকারী জানান, এ চক্রটির লোভনীয় লভ্যাংশের পাতা ফাঁদে পড়ে প্রতারিত হয়েছেন কমিউনিটির বেশ কয়েকজন আইনজীবী, রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক ও সরকারি দলের একজন প্রভাবশালী ছাত্রনেতা থেকে শুরু করে টিভি চ্যানেলের মালিকসহ বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষ। ব্রিটেনে ব্যাংকিং সুবিধা ব্যবহার করতে না পারা বৈধ কাগজপত্রবিহীন বহু বাংলাদেশি নগদ টাকা বিনিয়োগ করেছেন এই দুই প্রতিষ্ঠানে। ব্রিটিশ সরকারের সামাজিক সুবিধা নেওয়া মানুষেরাও বিপুল অর্থ লগ্নি করেছেন। অনেক মানুষ নগদে টাকা দিয়েছেন। ফলে অনেক গ্রাহক সরকারি ঝামেলা এড়াতে সংবাদমাধ্যমের কাছে মুখ খুলতে বা আইনের আশ্রয় নিতে রাজি হচ্ছেন না। সবাই টাকা ফেরত পাওয়ার আশায় দিন গুনছেন।
নাম না প্রকাশের শর্তে অপর এক বিনিয়োগকারী জানান, টাকা ফেরতের বহু তারিখ ও পরিকল্পনার কথা জানালেও দুই ভাই কোনও প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেননি। হুমায়ুন প্রতিদিন দশ-বারো জন করে গ্রাহকদের নিয়ে অনলাইনে জুম মিটিং করে এখনও টাকা ফেরতের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন।
বিনিয়োগকারীদের টাকা ফেরত পাওয়ার তৎপরতা
গ্রাহকরা টাকা ফেরত পেতে কমিউনিটিতে কমিটি গঠন, বৈঠকের পর বৈঠকসহ বিভিন্ন তৎপরতা চালাচ্ছেন। একপর্যায়ে শাহিন কাবেরি, মুজিবুর রহমান, লন্ডনের অফিস ভবনের মালিক ও বিনিয়োগকারী লুৎফুর রহমান, আকিব আলী শিবলু, আব্দুস সাত্তার, দীপক, মিজু চৌধুরী, আদম আহমদ, এটিএন বাংলা ইউকের সাবেক পরিচালক সুফি মিয়া, আইনুল হক ও আদিল হোসেনের সমন্বয়ে টাকা ফেরত পেতে কমিটিও করা হয়। কমিটির সদস্যরা দুবাইতে গিয়ে হুমায়ুনের সঙ্গে বৈঠক করলে তিনি কিছু হিসাব দেখিয়ে টাকা পর্যায়ক্রমে ফেরতের প্রতিশ্রুতি দেন নভেম্বর মাসে। অভিযোগ রয়েছে, সম্প্রতি গোপনে কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তির বিনিয়োগের কিছু অর্থ ফেরত দিয়েছেন দুই ভাই। কিন্তু সাধারণ গ্রাহকরা এখনও টাকা ফেরত পাননি।
আইনি উদ্যোগ
নাভিটাস মার্কেটস, হাবিবসন্স ট্রেডিং ও প্যাসিফিক গ্লোবালের বিভিন্ন প্রচারিত লিফলেট ও প্রচারণায় ছবিসহ হুমায়ুন ও অদুদের সহযোগী এবং কোম্পানির বিভিন্ন পদবিধারীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার উদ্যোগ নিচ্ছেন কয়েকজন বিনিয়োগকারী। বাংলাদেশ থেকে যারা বিনিয়োগ করেছেন সেসব গ্রাহক এই উদ্যোগ নিচ্ছেন। একটি সূত্র জানায়, ইতোমধ্যে একজন ভুক্তভোগী বাদী হয়ে দীপক ও হুমায়ুনের বিরুদ্ধে বাংলাদেশে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছেন। দেশের খ্যাতনামা আইনি প্রতিষ্ঠান প্রক্রিয়াটি পরিচালনা করবে।
এক গ্রাহক জানান, বারবার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে দুই ভাই চাইছে কালক্ষেপণ করে দেশে থাকা বাড়ি-ঘরসহ সব সম্পদের নাম পরিবর্তন বা বিক্রি করে দিতে। তখন ভুক্তভোগীরা মামলা করলেও তাদের খুব ক্ষতি হবে না। দুই প্রতারকের কাছ থেকে টাকা উদ্ধারে ক্ষতিগ্রস্ত সবাই যদি সম্মিলিতভাবে আইনি উদ্যোগ নেন তাহলে তা অর্থবহ হবে। পাশাপাশি কমিউনিটিতে এদের বিরুদ্ধে সামাজিক পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।
কে এই দীপক ও হুমায়ুন
বাংলাদেশে দুই ভাইয়ের গ্রামের বাড়ি হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ উপজেলার আউশকান্দি ইউনিয়নের বনগাঁও গ্রামে। একযুগ আগে বাবা ছালিক মিয়ার রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদনের সূত্রে দীপকের মা, ভাই হুমায়ুনসহ পরিবারের কয়েকজন সদস্য ব্রিটেন আসেন। দীপক ব্রিটেন আসেন স্টুডেন্ট ভিসায়।
দীপক লন্ডনস্থ শেরপুর ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের বর্তমান নির্বাচিত সভাপতি। তিনি এর আগে তিনবার সংস্থাটির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। দীপক গত ফেব্রুয়ারি মাসে দেশে বিনিয়োগকারীদের টাকায় ঢাকা, সিলেট নগরী ও শেরপুরসহ বিভিন্ন স্থানে কয়েক কোটি টাকার জমি ও সম্পদ কিনেছেন। লন্ডনে রাতারাতি নামে-বেনামে অন্তত ৬টি ঘরের মালিক হয়েছেন বলে জানা গেছে। তিনিও বর্তমানে দুবাইতে অবস্থান করছেন।
আহমেদ হুমায়ুন হাবিব কয়েক মাস ধরে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে দুবাইতে অবস্থান করছেন।
দুই ভাইয়ের বক্তব্য
এ ব্যাপারে অভিযুক্ত আহমেদ হুমায়ুন হাবীব ফোনে বলেন, বিনিয়োগের পরিমাণ দেড়শ’ কোটি টাকা নয়, অনেক কম। ইউক্রেন যুদ্ধ, শেয়ার বাজারের ধারাবাহিক পতনসহ বিভিন্ন কারণে ব্যবসা লোকসানে রয়েছে। তারপরও শিগগিরই টাকা পর্যায়ক্রমে ফেরত দেওয়ার অঙ্গীকারের কথা জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, গ্রাহকরা আরেকটু সময় দিলে সবার টাকা তিনি ফিরিয়ে দেবেন।
তার বড় ভাই আব্দুল অদুদ দীপক ফোনে বলেছেন, তিনি নিজে যে ৪১ জন গ্রাহকের কাছ থেকে নিজের নামে চুক্তিপত্র করে টাকা নিয়েছেন সেই টাকা ছাড়া বাকি গ্রাহকদের দায়-দায়িত্ব কোনোভাবেই নেবেন না। তবে একের পর এক তারিখ দিয়েও গ্রাহকদের টাকা ফেরত না দেওয়া, কোম্পানি খুলে গোপনে বন্ধ করা এবং নানা টালবাহানার বিষয়ে কোনও ব্যাখ্যা দেননি দীপক।
হাবিবসন্স ক্যাপিটালের অন্যতম ম্যানেজার ফয়জুল হক বলেছেন, তিনি এই প্রতিষ্ঠানের বেতনভুক্ত কর্মচারী। তার অনেক আত্মীয়-স্বজনও হাবিবসন্সে বিনিয়োগ করেছেন। গ্রাহকরা বিনিয়োগ ফেরত পাবেন বলে তিনি আশাবাদী। তিনি বলেন, আমি জানি মানুষ টাকা ফেরত না পেলে আত্মহত্যা ছাড়া পথ থাকবে না।
সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন
আপনার মন্তব্য