বিশেষ প্রতিনিধি, লন্ডন

০৬ মে, ২০১৫ ১৮:৫৭

ব্রিটিশ নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ-বিএনপি

রাত পোহালেই ব্রিটেনের পার্লামেন্ট নির্বাচন। নির্বাচনী উৎসবের রব চলছে ব্রিটেন জুড়ে। নানা প্রতিশ্রুতিতে চলছে জনগণের মন জয়ের সর্বশেষ চেষ্টা।

তবে বাংলাদেশের দেশের মতো নেই মিছিল, সমাবেশ, মাইকিং কিংবা টাকার খেলা। প্রধান দুই দল লেবার আর কনজারবেটিব এর মধ্যে এইবারই হচ্ছে ব্রিটিশ গণতন্ত্রের ইতিহাসের এ নির্বাচনী লড়াইl

গত এক মাসব্যাপী চলা বিভিন্ন সংগঠনের জরিপে দুটি দল এতই কাছাকাছি যে এখনো কেউ পরিষ্কারভাবে বলতে পারছে না নির্বাচনের সম্ভাব্য ফলাফল। অন্য সব বারের তুলনায় এইবারের নির্বাচনে বৃটেন প্রবাসী বাংলাদেশীদের আগ্রহের আধিক্যের কারণ এইবারের নির্বাচনে বিভিন্ন দল থেকে ১২ জন বাংলাদেশি প্রথম এবং দ্বিতীয় প্রজন্মের প্রার্থীরা অংশ নিচ্ছেন। এর মধ্যে সর্বাধিক সংখ্যক লেবার দলে।

বিভিন্ন জরিপের মতে বিজয়ের দৌড়ে এগিয়ে আছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভুত রোশনারা আলী, টিউলিপ সিদ্দিকী ও রুপা হক। কনজারভেটিবের একমাত্র প্রার্থী মিনা হকও সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

 ব্রিটেনের নির্বাচনী ইতিহাসে কোনো অভিবাসী প্রার্থী নিয়ে এবারের মতো এত মাতামাতি হয়নি কোনদিন। রুশনারা আলীর জয়ের বিষয়ে দল এতটাই নিশ্চিত যে তাকে প্রার্থী দেওয়ার ক্ষেত্রে দ্বিতীয়বার ভাবতে হয়নি।

লেবার পার্টির প্রার্থী হয়ে লন্ডনের হ্যাম্পস্টেড ও কিলবার্ন ভোটারদের বাড়ি বাড়ি ঘুরছেন বাংলাদেশ জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানের ছোট মেয়ে শেখ রেহানার কন্যা ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাগ্নি টিউলিপ সিদ্দিক। নির্বাচনী প্রচারণা চালাতে গিয়ে দম ফেলার সময় নেই তার। এর মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সাংবাদিক সব কিছুর মোকাবেলা করছেন তিনি একাই। কিন্তু তারচেয়েও বেশি মোকাবেলা করতে হচ্ছে বিএনপি জামায়াত শিবিরের প্রচার প্রচারণা।

এর আগে নর্থ লন্ডনের ক্যামডেন কাউন্সিল এর রিজেন্টস পার্ক ওয়ার্ডের একজন কাউন্সিলর হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার মাধ্যমে শেখ রেহানা তনয়া টিউলিপ সিদ্দীকের ব্রিটেন রাজনীতিতে অভিষেক হয়েছিল। সেখানে তাঁর নানা, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্ট্যাচু নির্মাণের একটা উদ্যোগ নিয়েছিলেন। যুক্তরাজ্য বিএনপি ও জামায়েতের বিরোধীতার কারণে সেটা সম্ভব হয়নি।

বঙ্গবন্ধু ও তার রক্তের ধারাকে কোনভাবেই মেনে নিতে না পারা বিরোধীগোষ্ঠি ব্রিটেনেও বাংলাদেশের রাজনীতির ছায়া দেখেন। টিউলিপ জয়ী হলে, সরকারে অংশ নিলে, ব্রিটেনে তাদের রাজনীতির জন্য অশনিসংকেত হতে পারে। এই ভয়েই তারা সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে টিউলিপের বিজয় ঠেকাতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন বলে প্রচারণা চলছে কমিউনিটিতে। আর পিছনে থেকে কলকাঠি নাড়ছেন বিএনপির সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট তারেক রহমান। প্রতিদিন ভাড়া করে মানুষ পাঠাচ্ছেন টিউলিপের নির্বাচনী এলাকায়। যারা বাংলাদেশের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ভোটারদের সঙ্গে আলোচনা করে এসবের সঙ্গে শেখ হাসিনা ও টিউলিপের সম্পর্ক জড়িয়ে নেতিবাচক প্রচারণা চালাচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের অস্ত্রচুক্তির বিষয়টিকে নিয়ে মাতামাতি তাদেরই প্রক্রিয়ার ফসল। ঠিক একই প্রক্রিয়া চলছে ব্রিটেনে বাংলাদেশি প্রথম এমপি রোশনারা আলীর নির্বাচনী এলাকায়। আর এসব প্রচার প্রচারণা মোকাবেলা করতে পিছিয়ে নেই আওয়ামী লীগও। প্রতিদিন আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা দল বেধে টিউলিপের পক্ষে চালাচ্ছেন প্রচার প্রচারণা। কিন্তু এর ফলাফল যতোটা না পক্ষে যাচ্ছে তার চেয়ে বেশি বিপক্ষে যাচ্ছে বলেই অভিমত অনেকের।

হ্যাম্পস্টেড ও কিলবার্ন আসনে বাঙালি ভোট আছে প্রায় তিনশত। কিন্তু প্রতিদিন যে পরিমাণ নেতা কর্মী প্রচারণায় অংশ নিচ্ছেন তারা যতোটা না টিউলিপের জন্য তার চেয়ে বেশি নিজের রাজনৈতিক অভিলাষের জন্য। ব্রিটেনের ফটো রাজনীতির অংশ হিসাবে দেখছেন অনেকে। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ রেহানা মেয়ের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিয়েছিলেন বেশ কয়েকদিন। কিন্তু আওয়ামী লীগ দলীয় নেতাকর্মীদের জয়বাংলা শ্লোগান ব্রিটেনের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে মেয়ে টিউলিপের জন্য কিছুটা বিব্রতকরও বটে। তাই বাধ্য হয়েই নির্বাচনী প্রচারণা বাদ দিয়ে ঘরেই বসে আছেন তিনি। যদি কোন কারণে নির্বাচনে টিউলিপের পরাজয় হয়, তার দায় ভার পড়বে আওয়ামী লীগের উপর।


টিউলিপ তার নিজের প্রচেষ্টা ও শ্রমে ব্রিটেনের রাজনীতিতে তার অবস্থান পোক্ত করেছেন। তিনি বারবার তাঁর বক্তব্যে বলেছেন, নিজের পরিচয়েই রাজনীতি করতে চান তিনি। মাত্র ১৬ বছর বয়সে লেবারের রাজনীতি শুরু করেন। রিজেন্টস পার্ক ওয়ার্ডে লেবার পার্টি'র মনোনিত কাউন্সিলর প্রার্থী নির্বাচিত হয়েছেন টিউলিপ সিদ্দীক। টিউলিপ সিদ্দিক ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক ও স্নাতোকত্তোর ডিগ্রী অর্জনের পর সরকার, নীতি ও রাজনীতি বিষয়ে তার দ্বিতীয় মাস্টার্স ডিগ্রী করছেন।

লেবার পার্টির যুব সংগঠন ‘ ইয়াং লেবার’ এর নেত্রী হিসেবে তিনি বেশি পরিচিত। আজকে পর্যন্ত হিসাব নিকেশে টিউলিপেরই পাল্লা ভারী বলে জানাচ্ছেন বিশ্লেষকরা। সর্বশেষ প্রাক নির্বাচনী জরিপ টিউলিপকে ৪৮ শতাংশ ভোট দিয়ে নির্বাচন জয়ের পথে এগিয়ে রেখেছে। জরিপে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টির প্রার্থী টোরি সায়মন মার্কাস ৩২ শতাংশ সমর্থন পেয়েছেন। আর লিবারেল ডেমোক্র্যাট দলীয় প্রার্থী মাজিদ নেওয়াজ পেয়েছেন ১০ শতাংশ ভোটারের সমর্থন।

টিউলিপের আসনে তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে বলে আশা করছে বেটফ্রেড। সম্ভাব্য ফলাফল নিয়ে বাজি ধরেছে প্রতিষ্ঠানটি তাদের ভাষ্যমতে যুক্তরাজ্যের মোট ৬৫০টি সংসদীয় আসনের মধ্যে হ্যাম্পস্টেড অ্যান্ড কিলবার্নের ফলাফল নিয়ে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অর্থ ব্যয় করেছেন বাজিকরেরা। বেটফ্রেড মনে করে আসনটিতে টিউলিপের জেতার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। এ কারণে টিউলিপের পক্ষে কেউ সাত পাউন্ড বাজি ধরলে তাঁকে দুই পাউন্ড লাভ দেওয়া হবে।

সায়মন মার্কাসের জেতার সম্ভাবনা তুলনামূলক অনেক কম। তাঁর পক্ষে এক পাউন্ড বাজি ধরলে তাঁকে তিন পাউন্ড লাভ দেওয়া হবে। অন্য প্রার্থীদের নির্বাচিত হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। তাই ওই সব প্রার্থীদের পক্ষে এক পাউন্ড বাজি ধরার বিপরীতে ১৪ পাউন্ড, ৫০ পাউন্ড ও ৬৬ পাউন্ড পর্যন্ত লাভ দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে বেটফ্রেড।

তবে জরিপে যতই এগিয়ে থাকুন, নির্বাচনে জয়ী হওয়াকে এখনো চ্যালেঞ্জিং হিসেবেই দেখছেন টিউলিপ সিদ্দিক। তিনি মনে করেন কিশোর বয়স থেকেই এই এলাকায় বড় হয়েছেন, স্কুলে পড়েছেন। এখানকার প্রতিটি ঘটনা, প্রতিটি অগ্রগতি তার জানা। মানুষের চাওয়া পাওয়ার হিসাব-নিকাশও রয়েছে তার কাছে। এর আগেই কাউন্সিলর হিসেবে জনগণকে সেবা যেমন দিতে পেরেছেন, ভালোবাসাও পেয়েছেন। আর তাতেই আশাবাদী হয়ে উঠেছেন তিনি। হ্যামস্টেড ও কিলবার্নের জনগণের মনের ভাষা শুনতে ও বুঝতে পারেন বলেই মনে করেন টিউলিপ সিদ্দিক। নির্বাচনে বিজয়ী হলে নিজের মেধা, যোগ্যতা ও জনপ্রিয়তা দিয়েই বিজয়ী হবেন মনে করছেন টিউলিপ।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত