ফরিদ আহমেদ

০৭ নভেম্বর, ২০১৫ ০৩:৩৮

সুরের ধারার অপার সুধা

গীত মনুষ্যের একপ্রকার স্বভাবজাত। মনের ভাব কেবল কথায় ব্যক্ত হইতে পারে। কিন্তু কণ্ঠসঙ্গীতে তাহা স্পষ্টীকৃত হয়। ‘আঃ’ এই শব্দ কণ্ঠভঙ্গীর গুণে দুঃখবোধক হইতে পারে, বিরক্তিবাচক হইতে পারে, এবং ব্যাঙ্গোক্তিও হইতে পারে। উপযুক্ত স্বরভঙ্গির সহিত বলিলে দুঃখ শতগুণ অধিক বুঝাইবে। এই স্বরবৈচিত্র্যের পরিণামই সঙ্গীত। - বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।

গত রোববার (১ নভেম্বর) একটা সংগীত অনুষ্ঠান উপভোগ করতে গিয়েছিলাম। এর আয়োজনে ছিলো টরন্টোর ‘বাংলা টেলিভিশন কানাডা’। আমি এমনিতেই এখানকার বাঙালিদের আয়োজিত অনুষ্ঠানসমূহে খুব কম যাই। এতে অবশ্য বাঙালি সমাজের কোনো দোষ নেই। অপরাধ আমার নিজেরই। কুনো ব্যাঙের মতো ঘরের এক কোণাতেই বসবাস আমার। কে কোথায় কী অনুষ্ঠান করছে, সেটা অনেক সময় আমার অনাগ্রহের কারণেই জানা হয়ে ওঠে না, অনুষ্ঠানে যাওয়াতো অনেক দূরের ব্যাপার। এই অনুষ্ঠানটাতেও হয়তো যাওয়া হতো না সেই আলস্যজনিত উদাসীনতা এবং বুড়ো বটের মতো বৈরাগ্যের কারণে। আমার সেই বৈরাগ্যে বাগড়া দিলেন এক ভদ্রলোক। ইনার নাম সাজ্জাদ আলী। আমি ডাকি সাজ্জাদ ভাই বলে। সাজ্জাদ ভাই টরন্টোর পরিচিত এবং প্রিয় মুখ। ‘বাংলা টেলিভিশন কানাডা’-র পরিচালক এবং প্রযোজক তিনি।

সাজ্জাদ ভাই ফেসবুকের মাধ্যমে এই অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ যাওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানালেন। অনুষ্ঠানটির নাম ‘সুরের ধারা-৩’। এতে দুজন গুণী শিল্পী গান গাইবেন। এঁদের একজন হচ্ছেন ড. মমতাজ মমতা এবং অন্যজন হচ্ছেন পণ্ডিত প্রসেনজিত দেওঘরীয়া। তিনি আমাকে জানাতে ভুললেন না যে, অনুষ্ঠানটিকে তিনি একটু ভিন্নভাবে করতে ইচ্ছুক। সঙ্গীতের রস যাঁরা সত্যিকারেরভাবে উপভোগ করতে ইচ্ছুক, তাঁদেরকেই তিনি শুধুমাত্র বেছে বেছে দাওয়াত দিচ্ছেন এই অনুষ্ঠানের জন্য। এই বেছে নেওয়া উন্নত ক্যাটাগরির মধ্যে আমার মতো একজন সঙ্গীতবিষয়ক গোমূর্খ লোক কীভাবে ঢুকলো, সেটা অবশ্য জানতে চাওয়াটা হয়ে উঠে নি আমার। মাঝে মাঝে কিছু কিছু বিষয়ে আলগা ভাব নেওয়াটা প্রয়োজন আছে বলেই মনে হয়। আন্না সেই জীবনের শুরু থেকে বলে আসছে যে, গানের বিষয়ে আমার রুচি রিকশাওয়ালাদের সমপর্যায়ের। এটা যে অতিরঞ্জন, তা নয়। আমার গানের রুচি আসলেই ওই পর্যায়ের। প্রচুর পরিমাণে বাংলাদেশি সিনেমার গান শোনা এবং পছন্দের তালিকায় এগুলো শীর্ষস্থানে থাকার কারণে ওর এই ধারণার জন্ম হয়েছিলো জীবনের সেই প্রাথমিক পর্যায় থেকেই। সেই ধারণা তার আজও পাল্টায় নি। পাল্টানোর সুযোগও নেই, কারণ আমার রুচি সেই আগের জায়গাতেই গাট মেরে বসে আছে। এর উন্নয়নের জন্য কোনো প্রচেষ্টা আমি নেই নি। এহেন সেই আমাকেই কিনা সঙ্গীত রস-পিপাসু হিসাবে উন্নত কোনো সঙ্গীতের অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রণ করা হচ্ছে!

এখানে প্রচুর গানের অনুষ্ঠান হয়। প্রায় প্রতি সপ্তাহান্তেই কোথাও না কোথাও, কেউ না কেউ সংগীত অনুষ্ঠানের আয়োজন করছে। সংখ্যায় বেশি দেখেই ধরে নেওয়াটা ঠিক না যে, গানের প্রতি সবার খুব ভালবাসা আছে। এদের দুই একটাতে যাবার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি যে, আয়োজনে সবসময়ই কিছুটা না কিছুটা অযত্ন এবং অবহেলা রয়েই যায়। মাঝে মাঝে এমনই এক হট্টগোল এবং বিশৃঙ্খল পরিবেশে সংগীতানুষ্ঠানগুলি হয় যে, গায়ক গায়িকা্রাও এখানে গান গেয়ে কোনো শান্তি পান না। শুধু যে শিল্পীরাই শান্তি পান না তা নয়, দর্শকদের মধ্য থেকে এক অংশেরও এই সমস্যায় পড়তে হয়। বিশেষ করে সেই সমস্ত দর্শক, যাঁরা সত্যিকারভাবে গান শুনে সেটাকে উপভোগ করার জন্য এই ধরনের অনুষ্ঠানে যান। এই ধরনের অনুষ্ঠান শিল্পী, দর্শক এবং আয়োজক, কাউকেই পুরোপুরি সন্তুষ্টি দিতে পারে না। সাজ্জাদ ভাই এই জায়গা থেকে সরে আসার বিষয়ে এই অনুষ্ঠানের শুরু থেকেই সচেতন ছিলেন। অনুষ্ঠান শুরুর বেশ কয়েকদিন আগেই তিনি অনলাইন পত্রিকা নতুন দেশে ‘বাংলা টিভি কানাডা’র “সুরের ধারাঃ” আয়োজনের কৈফিয়ত’ নামে একটা প্রবন্ধ লেখেন।

সেই প্রবন্ধে তিনি উল্লেখ করেন যে, ‘শিল্পীর সন্তুষ্টি একটি গানের অনুষ্ঠান আয়োজনের দ্বিতীয় প্রধান বিষয়। মনে প্রশান্তি না থাকলে শিল্পী গাইবেন কিভাবে? আয়োজকদেরই শিল্পীর জন্য গাইবার উপযুক্ত পরিবেশ তৈরী করতে হবে। এর একটু ব্যাখ্যা বলবো। একজন শিল্পীর কাছে সব থেকে বড় অ-সুখের কারণ যখন তিনি বুঝতে পারেন যে শ্রোতারা তার গান শুনছে না। এই ‘গান না শোনা শ্রোতা’ সকল শিল্পীর জন্য এবং কোন কোন আয়োজকের জন্য মস্ত বড় সংকট। গান যারা শুনছেন না আয়োজকরাতো তাদেরকে হল থেকে বের করে দিতে পারে না। আবার এদের সংখ্যাওতো নেহয়েত কম না, হয়তো দেখা যাবে ঠগ বাছতে গাঁ উজাড় হয়ে গেল। তাহলে এ সংকট উত্তরণের উপায় কি? আমার মনে হয় আয়োজকরা বিশেষ কিছু ব্যবস্থা নিতে পারেন যেন ঐ ‘গান না শোনা’রা অনুষ্ঠানে আসতে আগ্রহ হারায়। ধরুন যদি আপনি অনুষ্ঠানটিতে সেলুলার ফোনের সব ধরণের ব্যবহার নিষিদ্ধ করেন বা ক্যামেরার ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করেন, তো প্রায় অর্ধেক বিশৃঙ্খলা কেটে যাবে। কানাডা’র মূলধারার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলোতে আমি এ নিয়ম কঠোরভাবে প্রয়োগ হতে দেখেছি।

আবার ধরুন অনুষ্ঠান যারা স্পন্সর করবে, তাদের প্রচার প্রক্রিয়া আয়োজকরা মাত্রা ও শালীনতার মধ্যে রাখতে পারেন। অনুষ্ঠানস্থলের দেয়ালগুলো এবং মঞ্চের আশেপাশে সর্বত্র কেনা-বেচার পোষ্টারে ঠাসা। পনের বিশটা স্টল, -কেউ খাবার বেচছে, কেউ শাড়ি কাপড়, কেউবা গহনা, আরো কত সব রকমারি পণ্যের কেনাবেচা! অনুষ্ঠানস্থলে ঢুকে বোঝা দায়, বাজারে এসেছি নাকি গান শুনতে! সাংগীতিক কোন পরিবেশ নেই, চারিদিকেই শুধু বানিজ্য। আর এমন একটি পরিবেশে শ্রোতা থেকে ক্রেতার সংখ্যাধিক্যতো ঘটবেই। আসলে আয়োজকরা নিজের অজান্তেই একটি গানের অনুষ্ঠানের এমনতর অস্বাস্থকর পরিবেশ তৈরী করে ফেলেন তাদের সাংস্কৃতিক চেতনাবোধের কারণেই। এ ধরণের পরিবেশ শিল্পীর পারফরমেন্সের উপরে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে বাধ্য।‘

সাজ্জাদ ভাইয়ের ভাবভঙ্গি দেখেই অনুমান করেছিলাম যে তিনি কঠোরভাবে এই সমস্ত নিয়ম কানুন মেনে চলবেন এবার। আমি সাধারণত সব জায়গাতেই নিয়ম মেনে নিয়মিতভাবে দেরি করে যাই। এদিন আর সেই কাজ করার ভরসা পাই নি। দেরিতে গেলে দেখা যাবে যে, ভদ্রলোক হয়তো অনুষ্ঠানেই ঢুকতে দেবেন না। বউয়ের সামনে মান-সম্মান নিয়ে টানাটানি পড়ে যাবে এরকম কিছু ঘটলে। এই ভয়ে সময় মতোই আমি আর আন্না হাজির হই গিয়ে ফেয়ারভিউ মল এলাকার মধ্যে অবস্থিত টরন্টো পাবলিক লাইব্রেরির অডিটোরিয়ামে। ওখানে গিয়ে আমার অনুমান সত্য বলেই প্রমাণিত হয়। বাঙালিসূলভ কোনো অনিয়ম এবং বিশৃঙ্খলার চিহ্নমাত্রও কোথাও সেখানে নেই। টিকেট কাউন্টার থেকে বরাদ্দকৃত টিকেট নিয়ে লবিতে যেতেই সাজ্জাদ ভাইয়ের সাথে দেখা হয়। শুধু সাজ্জাদ ভাই না। আরো অনেক পরিচিত মানুষের সাথেই দেখা হয়। সবাই এসেছেন এই অনুষ্ঠান দেখতে। এর মধ্যে মুক্তমনার লেখক শামান সাত্ত্বিকের সাথেও দেখা হয়। এনার সাথে আমার ধাক্কা খাওয়ার সম্পর্ক সেই মেঘমল্লার দেখার সময় থেকেই। এইদিনও ধাক্কা প্রায় লেগেই যাচ্ছিলো, উনি আমাকে সামান্য একটু আগে দেখে ফেলায় সেটা আর ঘটে নি।

অডিটোরিয়ামের দরজা যতক্ষণ খোলা না হয়েছে, ততক্ষণ সবাই শৃঙ্খলাবদ্ধভাবেই লবিতে অপেক্ষা করেছেন, শেষে দরজা খুললে সুন্দর করে লাইন ধরে অডিটরিয়ামে ঢুকেছেন। অনুষ্ঠানের শুরুতেই এর সঞ্চালক অনুষ্ঠানের নিয়ম কানুন সবাইকে বিনীতভাবে জানিয়ে দিলেন। একটা জিনিস উপলব্ধি করলাম যে, বাঙালি যে নিয়ম ভাঙে, তা আসলে আয়োজকদের গাফিলতির কারণেই ভাঙে। আয়োজকরা ঠিক থাকলে, কারোরই নিয়ম মানতে কোনো অসুবিধা হয় না। দুইশো ষাট সিটের বিশাল অডিটোরিয়াম কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায় অল্প সময়ের মধ্যেই। অনুষ্ঠানের আগের দিনই সাজ্জাদ ভাই বিজ্ঞাপন দিয়ে জানিয়ে দিয়েছিলেন যে, সব টিকেট বুকড হয়ে গিয়েছে, কাজে ওয়াক-ইন কোনো টিকেট বিক্রি করা হবে না কাউন্টারে। সেই বিজ্ঞাপনকে উপেক্ষা করে প্রায় শ খানেক অতিরিক্ত লোক এসে উপস্থিত হয়েছিলো। কিন্তু, এদের খুব অল্প সংখ্যককে আপ্যায়ন করতে সমর্থ হয়েছিলেন তিনি।

অনুষ্ঠানের প্রথম পর্বে গান গাইতে আসেন ড. মমতাজ মমতা। ইনি নীলফামারী জেলার এক সাংস্কৃতিক পরিবারের সন্তান। শাস্ত্রীয় সংগীতে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রি করেছেন রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। পরে উচ্চাঙ্গ সংগীতে ডক্টরেট ডিগ্রি নিয়েছেন শান্তিনিকেতন থেকে। তিনি মূলত বাংলা গানের পাঁচ দিকপাল, দ্বিজেন্দ্রলাল, রবীন্দ্রনাথ, রজনীকান্ত, অতুলপ্রসাদ এবং নজরুলের মধ্যে চার দিকপালের গান গেয়েছেন।

রবীন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রলাল, রজনীকান্ত, অতুলপ্রসাদ এবং নজরুল ইসলাম, এই পাঁচজন বাংলা গানের এক অপার বিস্ময়। আগেকার সব ঐতিহ্যকে মেনে নিয়েও এরা পুরোনো পথে হাঁটেন নি, বরং বাংলা গানের মোড় ঘুরিয়ে দিয়ে ভিন্নদিকে যাত্রা শুরু করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের গানে পূর্ব ঐতিহ্যের বিপুল সমারোহ ঘটেছিলো। টপ্পা, ধ্রুপদ, শক্তিগীতি, কীর্তন, বাউল, পল্লীগীতির সুর রবীন্দ্র সঙ্গীতকে দেশিয় ঐতিহ্যের সাথে বেঁধেছিলো দৃঢ়ভাবে। আবার দেশিয় ঐতিহ্যকে স্বীকার করে নিয়েও বিদেশি সুরের প্রয়োগ আছে তাঁর গানে। দ্বিজেন্দ্রলালের গান দেশি-বিদেশি সুরের মিশ্রনে তৈরি হওয়া সত্ত্বেও দেখা গেছে যে তাঁর বহু গানই রাগাশ্রিত। অতুলপ্রসাদের গানে মার্গ সংগীতের ছোঁয়া আছে, তার সঙ্গে আছে ঠুংরীর ঢঙ। রজনীকান্ত আত্মসমাহিত এক কবি-গায়ক। গান এসে ধরা দেয় তাঁর কাছে আপনাআপনি, সহজ স্বতস্ফূর্ততায়। সহজ গান, সহজ সুরের সাথে মিতালী তাঁর। শব্দ, ছন্দোবদ্ধ উপমা বা অলংকারাদির কোন আড়ম্বর নেই সেখানে। তাঁর আপন মনে গাওয়া এই গানই শ্রোতাকে টানে তুমুলভাবে। আর নজরুল, এই পঞ্চ পাণ্ডবের শেষ পাণ্ডব, সংগীতের মদিরা পান করিয়ে মাতাল করে রেখেছিলেন সবাইকে একদিন। রাগসঙ্গীত থেকে শুরু করে গজল, ভজন, কীর্তন, শ্যামাসঙ্গীত, ভক্তিগীতি, স্বদেশী গান, এমন কিছু নেই যেদিকে প্রতিভার রাশি রাশি প্রাচুর্য দেখান নি তিনি। স্বতস্ফূর্ত রচনাশক্তি, দুরন্ত আবেগ আর দরদী কবিমন নিয়ে সুরের যে ইন্দ্রজাল তিনি তৈরি করেছেন, তার তুলনা মেলা ভার।

বাংলা গানের এরা হচ্ছেন পাঁচ আদিম দেবতা। এই দেবতাদের গান পরম মমতা দিয়ে গেয়েছেন ডঃ মমতাজ মমতা। গান নয়, গভীর শ্রদ্ধায় যেনো পুজোর নৈবেদ্য তিনি সাজিয়েছিলেন এদের জন্য। এমন দরদ নিয়ে, এমন মমতা মাখিয়ে গানকে শ্রোতার কাছে অঞ্জলি ভরে উপহার দেবার জন্য মনের ভিতর থেকে তাগিদ লাগে, আন্তরিক সাধনা লাগে। তিনি সেটা করেছেন গভীর যত্নে, কঠোর পরিশ্রমসাধ্যতায়।

অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্বে আসেন এই অনুষ্ঠানের মূল আকর্ষণ পণ্ডিত প্রসেনজিৎ দেওঘরীয়া। ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সংগীতকে রাগ, রূপ ও নন্দনতত্ত্বের সংমিশ্রণে সমৃদ্ধ করেছেন তিনি। রাগের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গগুলো যেমন তান, মীড়, বোলতান, আলাপ, বন্দিশের গায়কি এই সব বিষয়গুলোকে প্রথাগত রীতিতে গায়কির মধ্যে ফুটিয়ে তোলার এক অসাধারণ দক্ষতা রয়েছে পণ্ডিত দেওঘরীয়ার মধ্যে।

সংগীতের হাতেখড়ি নিয়েছেন কাকা মিহির কুমার দেওঘরীয়া এবং পণ্ডিত গনেশ প্রসাদের কাছে। ডঃ সুরেন্দ্র শংকরের ব্যক্তিগত তত্ত্বাবধানে বহু বছর তিনি উচ্চাঙ্গ সংগীত শিখেছেন। ইনি আবার ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের অন্যতম স্তম্ভ ইন্দোর ঘরানার প্রতিষ্ঠাতা ওস্তাদ আমির খাঁ এর শিষ্য। এলাহাবাদ হিন্দি সাহিত্য সম্মেলন থেকে ১৯৯০ সালে হিন্দি সাহিত্যে এবং লক্ষ্ণৌর ভাতখণ্ডে সংগীত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চাঙ্গ সংগীতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। বিভিন্ন রাগ ও তালে প্রায় চারশ খেয়াল রচনা করেছেন তিনি। সেই সাথে অসংখ্য ভজন ও আধুনিক বাংলা গান রচনা করে সেগুলোতে সুর দিয়েছেন তিনি। ভারতে থাকার সময়ে আকাশবানী এবং দূরদর্শনের তালিকাভুক্ত শিল্পী ছিলেন তিনি।

বাংলা গানে রাগসংগীতের প্রচলন কিন্তু বহু আগে থেকেই, একেবারে সেই বাংলা গানের আদি সময়ে। চর্যাপদের কিছু কিছু গানের ক্ষেত্রে কোন রাগে গাইতে হবে, তা বলে দেওয়া আছে। অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম থেকে বাংলা গান তার একটা নিজস্ব রূপ নিয়ে বিকশিত হতে থাকে। প্রাচীন শাস্ত্রীয় রাগ যেমন, খাম্বাজ, বাগেশ্রী, ভীমপলশ্রী, পূর্বী, সাহানা, গৌড়, বসন্ত, মুলতান এইসব রাগের প্রচলন দেখা যায়। রাগসংগীতের গানের ভাষা সাধারণত এমন সহজ ও ব্যবহার্য যে, রচনার প্রতিটি শব্দকে ভেঙে সহজে সুরের মাধ্যমে উচ্চারিত, অনুক্ত, খন্ডিত, করুণ ও গম্ভীরভাবেও পরিণত করা যেতে পারে। বাণী বা কথার পূর্ব উচ্চারণের প্রয়োজন এখানে গৌণ হয়ে পড়ে। সুর প্রয়োগের প্রাধান্যই এখানে বিশেষ গুরুত্ববহ।

পণ্ডিত দেওঘরীয়াও ঠিক সেই কাজটিই করেছেন। কণ্ঠ এবং সুরকে ব্যবহার করেছেন তিনি সুদক্ষতার সাথে। অনেক ধরনের গান করেছেন তিনি, এর মধ্যে খেয়ালের মতো শাস্ত্রীয় গান যেমন আছে, তেমনি আছে আধুনিক গানও। যে গানই তিনি গান না কেনো, সেটাকে রাগের মিষ্টি রসে ডুবিয়ে তারপর সেটা উপহার হিসাবে তুলে দিয়েছেন দর্শকের করতলে। এই মিষ্টি-মধুর মহার্ঘ করতলে পেয়ে তৃপ্ত এবং মুগ্ধ দর্শকও করতালিতে মুখরিত করেছে মুহুর্মুহু তাঁর গানের সময়ে।

আমেরিকা এবং ক্যানাডা, এই দুই দেশে অনেক দিন ধরেই আছি। দেখি নাই, দেখি নাই করেও বাঙালিদের কম অনুষ্ঠান দেখা হয় নি আমাদের। কিন্তু, এতোখানি তৃপ্তি মনে নিয়ে, এতোখানি ভালো লাগা হৃদয়ে জমা রেখে, এতোখানি পূর্ণতা বুকের মধ্যে নিয়ে আর কোনো অনুষ্ঠান আমরা দেখেছি বলে মনে পড়ছে না। এ এক ভোরের শিশির ভেজানো স্নিগ্ধতায় জড়ানো মুগ্ধতা জাগানিয়া অনুষ্ঠান। মনোরম এবং মনোমুগ্ধকর।

এরকম অসাধারণ মানের একটা অনুষ্ঠান উপহার দিয়ে শ্রোতা-দর্শকদের হৃদয়কে আলোড়িত করে দেবার জন্য, এরকম একটা মায়াময় স্মরণীয় সন্ধ্যা উপহার দিয়ে চিত্তকে সুনির্মল করার জন্য, তাদের মধ্যে ভলোলাগার ঘোর তৈরি করে দেবার জন্য, বাংলা টেলিভিশন কানাডার সাথে সংশ্লিষ্ট সকলে, এই অনুষ্ঠানের স্বেচ্ছাশ্রমী কর্মীরা, গায়ক-গায়িকা, যন্ত্রী, সঞ্চালক এবং সর্বোপরি সাজ্জাদ ভাইয়ের প্রতি রইলো আন্তরিক ধন্যবাদ এবং কৃতজ্ঞতা। আপনাদের এই অন্তহীন পরিশ্রম এবং পরিশীলিত মননের কারণেই এরকম একটা পরিচ্ছন্ন, পরিশুদ্ধ এবং পরিতৃপ্তিকর অনুষ্ঠান আমাদের পক্ষে দেখা সম্ভব হয়েছে।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত