ফরিদ আহমেদ

১৫ এপ্রিল, ২০২০ ১৩:০৫

মৃত্যুর এই মিছিল সহজে থামবে না

অধ্যাপক ডা. মঈন উদ্দিন

বাংলাদেশে সরকারিভাবে এই মুহূর্তে কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা হচ্ছে ১০১২জন। এর মধ্যে একশোজনই হচ্ছে স্বাস্থ্যকর্মী। এই স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে চুয়ান্ন জন আবার ডাক্তার। এই সংখ্যাটা একটা অবিশ্বাস্য সংখ্যা। শতকরার হিসাবে দশ শতাংশ স্বাস্থ্যকর্মী করোনায় আক্রান্ত হচ্ছে বাংলাদেশে। প্রতি দশজন কোভিড-১৯ এর রোগীর মধ্যে একজনই স্বাস্থ্যকর্মী।

আক্রান্ত চুয়ান্ন জনের মধ্যে তিনজন আইসিইউতে ছিলেন। সেই তিনজনের একজন আজ মারা গেছেন। ডাক্তার ভদ্রলোকের নাম মঈন উদ্দিন। তিনি সিলেটের এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক। কর্তব্যরত অবস্থায় করোনাতে আক্রান্ত হন তিনি। ওসমানী মেডিকেল কলেজে ভেন্টিলেটর না থাকায় ঢাকা আসার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। নিজে একজন ডাক্তার হবার পরেও অ্যাম্বুলেন্স পাননি তিনি। ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে ঢাকায় এসে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি হন।

মেডিকেল কলেজের একজন সহকারী অধ্যাপকের যদি করোনা হবার পরে এ রকম করুণ অবস্থার মধ্য দিয়ে যেতে হয়, তবে বাংলাদেশে সাধারণ মানুষের করোনার চিকিৎসা কী ধরনের হবে, সেটা সহজেই অনুমেয়। শরীরের নিজস্ব প্রতিরোধক ক্ষমতা ছাড়া এর থেকে রক্ষা পাবার জন্য কোনো ধরনের রাষ্ট্রীয় সুযোগ সুবিধা কেউ পাবেন বলে মনে হচ্ছে না। এমনিতেই করোনা পরীক্ষাকে সীমিত করে রাখা হয়েছে। অসংখ্য লোক করোনার উপসর্গে মারা যাচ্ছে। অল্প যে কিছু লোককে করোনার রোগী হিসাবে সনাক্ত করা হচ্ছে, তাদের জন্যও পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই সরকারের। একই সাথে নেই ডাক্তারদের সুরক্ষা করার ব্যবস্থাও। সেটা থাকলে এই শুরুতেই এতো ব্যাপক সংখ্যক ডাক্তার করোনাতে আক্রান্ত হতেন না।

করোনার বিরুদ্ধে ডাক্তার, নার্স এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীরা আমাদের ফ্রন্টলাইন যোদ্ধা। সেই তাঁরাই যদি যুদ্ধের শুরুতে এভাবে আহত কিংবা নিহত হন প্রয়োজনীয় উপকরণের অভাবে, তাহলে আগামী দিনে এই যুদ্ধে কাদের দিয়ে লড়াই করবো আমরা? শরীরের নিজস্ব রোগ প্রতিরোধ করার ক্ষমতার কারণে অনেক লোক এমনি এমনিই করোনা থেকে ভালো হয়ে যাবে, ধীরে ধীরে সমাজে হার্ড ইম্যুনিটি গড়েও উঠবে। কিন্তু, এর মাঝেই আমরা হয়তো হারাবো অসংখ্য মানুষকে। এরা হারিয়ে যাবে প্রয়োজনীয় চিকিৎসার অভাবে।

আমাদের মন্ত্রীরা দিনের পর দিন গলাবাজি করে এসেছেন এই বলে যে করোনার জন্য পর্যাপ্ত প্রস্তুতি বাংলাদেশের আছে। এমনকি প্রধানমন্ত্রীও বিভিন্ন জেলার জেলা প্রশাসক এবং সিভিল সার্জনদের নিয়ে যে ভিডিও কনফারেন্স করছেন, সেখানেও এমন একটা ধারণা মানুষকে দেওয়া হচ্ছে। অথচ, বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের। ওসমানী মেডিকেল কলেজের এই তরুণ সহকারী অধ্যাপকের মৃত্যুই আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে যে আমাদের প্রস্তুতি বলতে আসলে কিছু নেই। প্রধানমন্ত্রীসহ তাঁর অন্যান্য মন্ত্রী-মিনিস্টার, আমলারা, সিভিল সার্জনরা সঠিক তথ্য দিচ্ছেন না মানুষকে।

এমন একটা ক্রান্তিকালে এসেও এরা জনগণের সাথে এই রকম প্রতারণা কেনো করছেন, অহরহ মিথ্যা কথা কেনো বলছেন, সেটা জানা নেই আমার। এই প্রতারণা, এই মিথ্যাচারের ফলাফল খুব একটা শুভ কিছু হবে না। আজ ডাক্তার মঈন উদ্দিন গিয়েছেন, কাল আরেকজন যাবেন, পরশুদিন হয়তো অন্য কেউ হাঁটবেন মৃত্যুরেখার পথ ধরে। তৈরি হবে মৃত্যুর এক মিছিল। মৃত্যুর এই মিছিল খুব সহজে থামবে না।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত