বঙ্গদর্শন পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের প্রথম কবিতা

 প্রকাশিত: ২০২১-১০-০৫ ২৩:৩৩:৪৩

 আপডেট: ২০২১-১০-০৫ ২৩:৩৫:১৪

ফরিদ আহমেদ:

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রথম কবিতা ছাপা হয়েছিল ১৮৭২ সালে বঙ্গদর্শন পত্রিকায়। নিতান্তই বালক তখন তিনি। বয়স বড় জোর বারো। কবিতাটার নাম ছিল ‘ভারত ভূমি’। অবশ্য কবিতার নিচে তাঁর নাম লেখা ছিল না। এই পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম দিকপাল বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তিনি এই বালকের কবিতার একটা ছোট্ট ভূমিকা দিয়েছিলেন, তাঁকে চৌদ্দ বছরের কিশোর বলে ভ্রম করেছিলেন।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর আমার “জীবনানন্দ আবিষ্কার  এবং অন্যান্য” বইয়ের ‘একশ পঁচিশ বছরের রবীন্দ্রনাথ’ প্রবন্ধে এই বিষয়টা আলোচনা করেছেন। তিনি লিখেছেন, “রবীন্দ্রনাথের প্রথম কবিতা যখন ছাপা হয় তখন তাঁর নিচে অবশ্য কবির নাম ছিল না। সে সময়ে নামহীন রচনা প্রকাশের রীতি ছিল। রবীন্দ্রনাথের প্রথম মুদ্রিত রচনা ঠিক কোনটি তা নিয়ে পণ্ডিতে পণ্ডিতে আজও কিঞ্চিৎ বিবাদ থাকলেও মোটামুটি এখন নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে, বঙ্গদর্শন পত্রিকার দ্বিতীয় বর্ষের দশম সংখ্যায় প্রকাশিত ‘ভারত-বিলাপ’ নামে অনামা কবির রচনাটিই ভবিষ্যতের এক মহাকবির সৃষ্টি। কবিতাটির তলায় সম্পাদক বঙ্কিমচন্দ্র নোট দিয়েছেন, “এই কবিতাটি এক চতুর্দশ বর্ষীয় বালকের রচিত বলিয়া আমরা গ্রহণ করিয়াছি। কোন কোন স্থানে অল্পমাত্র সংশোধন করিয়াছি। এবং কোন কোন অংশ পরিত্যাগ করিয়াছি।’’

সুনীল অবশ্য কবিতার নাম ভুল করেছেন। কবিতাটির নাম ‘ভারত-বিলাপ’ নয়, ‘ভারত ভূমি’। তবে, রবীন্দ্রনাথের বয়েস যে চৌদ্দ হয়নি, বঙ্কিমের এই ভুলটা ধরতে পেরেছিলেন তিনি। এ’ সম্পর্কে তাই তিনি বলেছেন। “এই কিশোর কবির বয়েস অবশ্য তখনও চৌদ্দ হয়নি, বারো-সাড়ে বারোর বেশি না, বয়েসের তুলনায় তাঁকে বড় দেখাত। বঙ্কিম সম্ভবত এই কিশোরকবিকে চোখেও দেখেছিলেন, কেননা এঁর বড় দাদা ছিলেন বঙ্কিমের বন্ধু এবং সেই সূত্রে ঠাকুরবাড়িতে বঙ্কিমের যাতায়াত ছিল। এমন কল্পনা করা যেতে পারে যে, ঠাকুরবাড়িতেই দ্বিজেন্দ্রনাথ কোন একদিন বঙ্কিমচন্দ্রকে বলছিলেন, দেখুন দেখুন বঙ্কিমবাবু, আমার কনিষ্ঠ ভাই রবি কেমন মনোমুগ্ধকর কবিতা রচেছে।’’

এগারো বারো বছর বয়সে কবিতা ছাপা হওয়াটা অবশ্য অনন্যসাধারণ কোনো ঘটনা নয়। অনেকেরই এই বয়সে কবিতা ছাপা হয়। সুকুমার রায়ের ‘নদী’ নামের প্রথম কবিতাটি যখন ছাপা হয়েছিল, তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র আটবছর। বুদ্ধদেব বসুর কবিতাও ছাপা হয়েছে অনেক অল্প বয়সে। এরকম কবিতা সাধারণত সবার চোখের আড়ালেই থেকে যায়। এই সমস্ত মানুষেরা যখন বিখ্যাত হয়ে উঠেন, তখনই সাধারণত তাঁদের প্রথম কবিতা গবেষকদের মাধ্যমে সবার সামনে উঠে আসে। সবাই আপ্লুত হন সেই প্রতিভার কিশোর বা বালক বয়সের কীর্তি দেখে। কিন্তু, রবীন্দ্রনাথের এই কবিতা  ছাপার গুরুত্বটা এর বিপরীত জায়গায়। তাঁর এই কবিতাটি অলক্ষ্যে থেকে যায়নি কিংবা গুরুত্বহীনভাবে পড়ে থাকেনি পত্রিকার পাতার মাঝে নিতান্তই এক বালকের কবিতা বলে। এটি ব্যাপক আলোড়ন তুলেছিল। সেই সময়ে দুই দুইটি বিখ্যাত পত্রিকার সম্পাদক এই নাম না ছাপানো কবির কবিতা নিয়ে আলোচনায় মেতে উঠেছিলেন। আসুন সুনীলের  মুখেই তা শুনি।

“বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ সম্পাদক কিছু সংশোধন করে ছাপলেন এক বালকের কবিতা, যে একদিন জগৎ-বিখ্যাত হবে। কিন্তু সেই প্রথম কবিতাটিই যে আলোড়ন তুলেছিল, তার তুলনা পৃথিবীর আর কোনও সাহিত্যে পাওয়া যাবে কি না সন্দেহ। সেই বালকের কবিতা নিয়ে তৎকালীন দুটি বিখ্যাত পত্রিকায় সম্পাদকীয় মন্তব্য লেখা হয়েছিল। অমৃতবাজার পত্রিকার শিশিরিকুমার ঘোষ কবিতাটির সুদীর্ঘ উদ্ধৃতি দিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছিলেন। সোমপ্রকাশ পত্রিকায় শিবনাথ শাস্ত্রী আবার আকারে ইঙ্গিতে ওই কবিকে এঁচোড়ে পাকা বলে ছেড়েছেন।

দু’রকম প্রতিক্রিয়া হলেও এক বালকের প্রতি দুজন বাঘা সম্পাদকের এতখানি মনোযোগ। নাম না ছাপা হলেও ওই কবিতার কবিকে যে দু’জনেই চিনতে পেরেছিলেন তাতে কোনও সন্দেহ নেই।’’

আপনার মন্তব্য