ফরিদ আহমেদ

১৬ নভেম্বর, ২০১৫ ১৯:০২

‘ব্যাপ্টিজম অব দ্য ক্রাইস্ট’

শিল্পকলার নানা শাখায় গুরু-শিষ্যের সম্পর্ক খুবই গুরুত্বপূর্ণ। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যতোটা না শেখা যায়, এই সকল শাখায় গুরুর কাছ থেকে ছাত্ররা তার চেয়ে বেশি শিখে নিতে পারে। চিত্রশিল্পও এর ব্যতিক্রম নয়। এই শাখায় গুরু-শিষ্যের সম্পর্কটা বেশ প্রাচীনই।

মধ্যযুগের ইউরোপ যেখানে ছিল রোগ-শোক এবং যুদ্ধবিগ্রহের আখড়াভূমি, নতুন কোন আবিষ্কারের জন্য একেবারে বন্ধ্যা ক্ষেত্র।  সেখানে রেঁনেসা ছিল একেবারেই মুদ্রার অপর পিঠ। সাগ্রহে অংশ নেওয়ার সময়, নতুন নতুন আবিষ্কারের নেশায় কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ার সময়। নিজেদের সামর্থ্য কী সে সম্পর্কে সচেতনতা এবং সভ্যতা যা অর্জন করেছে তার চেয়েও বেশী করার সামর্থ্য রাখে এই বিশ্বাসই নাড়িয়ে দিয়েছিল ইউরোপকে। এরফলশ্রুতিতেই শুরু হয় নতুন নতুন আবিষ্কার এবং আধুনিক বৈজ্ঞানিক চিন্তার সূত্রপাত।সেই সাথে শৈল্পিক উৎকর্ষের জন্য তৈরি হয় উর্বর ক্ষেত্র।

ইউরোপে রেনেসার সময়ে চিত্রশিল্পে নতুন পদ্ধতি এবং প্রকরণ প্রয়োগের জোয়ার আসে। ছবি এঁকে তখন সম্মান ও প্রতিপত্তি অর্জন করাতো যেতোই, সেই সাথে সুন্দর করে জীবিকাও নির্বাহ করা যেতো। জ্ঞানের নানা শাখায় উন্নতি হওয়ার কারণে জনসাধারণের রুচিও উন্নত হয়ে ওঠে। সুকুমার বৃত্তি এবং শিল্পকলার প্রতি মানুষের অনুরাগ এবং ভালবাসা বৃদ্ধি পায় প্রচুর পরিমাণে। ফলে, ভালো ছবির কদর যায় বেড়ে। মানুষজন টাকা পয়সা খরচ করে সেগুলো কিনতে দ্বিধাবোধ করতো না। এই সহজলভ্য টাকা এবং দ্রুত প্রাপ্য সম্মানের লোভে অসংখ্য প্রতিভাবান শিল্পী চলে এসেছিলেন চিত্র শিল্পে নিজেদের পেশা সুদৃঢ় করতে।

এই স্বর্ণ সময়ে ইতালির নানা শহরে গড়ে উঠেছিলো অসংখ্য ছোট-বড় নানা ধরনের স্টুডিও। এই সব স্টুডিওতে শিক্ষানবিশ শিক্ষার্থীরা গুরুর তত্ত্বাবধানে ছবি আঁকা শিখতো। এতে যে শুধুমাত্র শিষ্যদেরই লাভ ছিলো তা নয়। এদেরকে শেখাতে গিয়ে গুরুরও লাভ হতো। প্রচুর পরিমাণে ফরমায়েশ থাকার কারণে গুরুর একার পক্ষে সব ছবি এঁকে শেষ করে ফেলা সম্ভব ছিলো না।

ফলে, গুরু কাজে লাগিয়ে দিতেন তাঁর শিষ্যদের। ছবির গুরুত্বপূর্ণ অংশের কাজ করে তিনি চলে যেতেন অন্য ছবি আঁকায়। শিষ্যরা অগুরুত্বপূর্ণ অংশগুলো সমাপ্ত করতো গুরুর নির্দেশনা অনুযায়ী। শুধু যে গুরুর নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করতে হতো সবসময়, তাও নয়। অনেক সময়ই স্বাধীনভভাবে কাজ করার জন্য শিষ্যরা গুরুর সদয় অনুমতি পেতো। এতে করে খুব দ্রুত তাদের হাত পাকতো, নিজের মধ্যে আত্মবিশ্বাস জন্মাতো এবং এই পেশার সবচেয়ে জরুরী যেটা, সেই প্রয়োজনীয় প্রচার পাওয়া হয়ে যেতো। ভবিষ্যতে শিল্পী হিসাবে স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য এর অবদান ছিলো অসামান্য।

প্রতিভাবান শিল্পী যাঁরা, তাঁরা বেশিদিন এক গুরুর সাথে থাকতেন না। প্রয়োজনীয় জ্ঞানটুকু সঞ্চিত হলেই তাঁরা সরে যেতেন গুরুর কাছ থেকে। এরপরে হয়তো যোগ দিতেন অন্য কোনো চিত্র শিল্পীর স্টুডিওতে। সেখান থেকে আবার অন্য কোথাও। সেই সময়ে নতুন কিছু শেখার আশায় নিজেদের ঘরবাড়ি ছেড়ে দিয়ে দূরবর্তী কোনো শহরে পাড়ি দিতেও ছাত্ররা দ্বিধা করতো না। এমনই এক অদম্য জ্ঞানস্পৃহা গড়ে উঠেছিলো সবার মাঝে।

এইসব শিক্ষানবিশ ছাত্রদের মধ্যে লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চিও ছিলেন। ফ্লোরেন্সের বিখ্যাত চিত্রশিল্পী আন্দ্রিয়া দেল ভেরোচিওর স্টুডিওতে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। ভেরোচ্চি শুধু চিত্রশিল্পীই ছিলেন না, তিনি ছিলেন ভাস্করও। একই সাথে মেটাল ওয়ার্কের কাজও তিনি করতেন। তাঁর স্টুডিওতে লিওনার্দো ছাড়াও বতিসিনি, বতিসেলি এবং লরেঞ্জো দ্য ক্রেডির মতো ছাত্ররা ছিলো, যারা পরবর্তীতে নিজেরাই বিখ্যাত শিল্পী হয়েছেন।

সেটা ১৪৭৫ সাল। লিওনার্দোর বয়স মাত্র তেইশ বছর। ফ্লোরেন্সের একজন মঙ্ক স্যান স্যালভি, আন্দ্রিয়া দেল ভেরোচিওকে একটা ছবি এঁকে দেবার জন্য ফরমায়েশ করেন। বাইবেলের কাহিনি অবলম্বনে ব্যাপ্টিজম অব দ্য ক্রাইস্ট ছবিটি আঁকা শুরু করেন তিনি। কাঠের উপরে টেম্পারা ব্যবহার করে ছবিটি আঁকা শুরু হয়। ছবির মধ্যমণি যীশু। তাঁকে দীক্ষা দিচ্ছেন সেইন্ট জন। বাঁ পাশে দুজন দেবদুত হাঁটু পেতে বসে আছে। ছবির মূল অংশ ভেরোচিও আঁকলেন। তাঁরপর একেবারে বাঁদিকের দেবদুতকে আঁকার ভার দিলেন লিওনার্দোর উপরে।

তরুণ লিওনার্দো দেবদূতের ছবিটিকে এমনভাবে আঁকলেন যে, গুরুর অংশটা পুরোপুরি মার খেয়ে গেলো এর তুমুল ঔজ্জ্বল্য এবং উচ্চতর মানের কাছে। লিওনার্দোর আঁকা অংশটার দক্ষতার কাছে ভেরোচিওরঅংশটাকে মনে হতে লাগলো খুবই সাদামাটা এবং গতানুগতিক। দেবদূতের সাবলীল স্বচ্ছন্দ ভঙ্গী, মাথার জটিল নকশা, মস্তকাভরণ আঁকার কল্পনাশক্তি এবং এর শান্ত-সমাহিত, পবিত্র ভাব দেখলে সহজেই বোঝা যাবে যে অত্যন্ত উঁচু স্তরের একটা কাজ করে ফেলেছে লিওনার্দো। সেই সময় তেলরঙের কাজ নতুন মাধ্যম হিসাবে মাত্র চালু হয়েছে। লিওনার্দো তেলরঙে এই কাজটা করেছিলেন। ভেরোচিওর মতো এরকম একজন ঝাঁনু এবং দক্ষ চিত্রশিল্পীর কাজ ম্লান হয়ে গেলো, তাঁরই ছাত্র, সদ্য এক তরুণ, যে কিনা কাজ শিখছে তাঁর কাছে শিক্ষানবিশ হিসাবে।

এই ছবির এক্স-রে করে দেখা গেছে যে, ভেরোচিওকা দেবদূতের যে স্কেচ করেছিলেন, পরবর্তীতে লিওনার্দো আঁকা শেষ হবার পরে যে চিত্র দাঁড়িয়েছে, তার সাথে কোনো মিলই নেই। ভেরোচিওকার স্কেচকে সম্পূর্ণ ভিন্ন দিকে নিয়ে গিয়েছিলেন লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি। একজন অসামান্য প্রতিভাবান শিল্পী যে জীবনের শুরুতেও অন্যকে অনুসরণ না করে স্বকীয় রাস্তাতেই হাঁটতে চান, তার জ্বলন্ত প্রমাণ এটি। ছবিতে দু’জন দেবদূত রয়েছে। এ দুটোতে তুলনা করলেই পার্থক্যটা বোঝা যায়। লিওনার্দো দেবদুতের মধ্যে প্রাণ সঞ্চার করেছেন, সে গভীর আগ্রহ নিয়ে পুরো বিষয়টা দেখছে, এবং সমস্ত ব্যাপ্টিজম কর্মকাণ্ডের মধ্যে খুব স্বাভাবিকভাবেই একাত্ম হয়ে গিয়েছে। এর বিপরীতে ভেরোচিওর দেবদূত তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে। চারপাশে কী ঘটছে সে বিষয়ে কোনো আগ্রহই তার নেই। মনে হচ্ছে উদাসী একজন সে।

নিজের এই অক্ষমতা মেনে নিতে পারেন নি ভেরচি। লজ্জায়, ক্ষোভে, দুঃখে, অপমানে ছবি আঁকাই বন্ধ করে দিলেন তিনি। মনোনিবেশ করলেন ভাস্কর্যে। ব্যাপ্টিজম অব দ্য ক্রাইস্টই ভেরোচিওর সর্বশেষ ছবি। আর কখনো রঙ তুলি স্পর্শ করেন নি তিনি। এটাই তাঁর আঁকা সর্বশেষ ছবি হয়ে থেকেছে।

শিষ্যের কাছে পরাজিত হয়ে কোনো গুরু এভাবে সবকিছু ছেড়েছুড়ে দিয়েছেন, এই নজির আর নেই কোথাও। লিওনার্দোর জীবনীকার ভাসারি, এই ঘটনাকে দেখেছেন অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে। তাঁর মতে, এটি একটি যুগান্তকারী ঘটনা। এখান থেকেই হাই রেনেসাঁর সূত্রপাত হয়।

কেউ কেউ অবশ্য একে অতিরঞ্জন হিসাবেই চিহ্নিত করেছেন। তাঁদের ভাষ্য হচ্ছে যে, চিত্র শিল্পের চেয়ে ভেরোচিওর ভাস্কর্য শিল্পে দক্ষতা অনেক বেশি ছিলো। সে কারণেই যে পেশায় তিনি অধিকতর সাফল্য অর্জন করতে পারবে বলে ভেবেছিলেন, সেটাতে মনোনিবেশ করেছিলেন। এর সাথে লিওনার্দোর আঁকা দেবদূতের কোনো সম্পর্ক নেই। ব্যাপ্টিজম অব দ্য ক্রাইস্ট ছবিটা, তার শেষ ছবি হওয়াটা নেহায়তই কাকতালীয় ঘটনা মাত্র।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত