ইসমাইল গনি হিমন

০৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ ১৫:১৯

সত্যজিৎ রাজনের দ্বিতীয় প্রদর্শনী: সময়, পরিবর্তন ও সাহসিকতার আখ্যান

[নগরের সুরমা মার্কেটে চলছে শিল্পী সত্যজিত রাজনের দ্বিতীয় একক চিত্র প্রদর্শনী ‘প্রাগভবিষ্যের পদাবলি’। ৫ সেপ্টেম্বর শুরু হওয়া এ প্রদর্শনী চলবে ১৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। এ নিয়ে লিখেছেন আরেক শিল্পী ইসমাইল গনি হিমন]

বিশ্ব যখন অস্থিরতা, যুদ্ধ, জলবায়ু সংকট এবং অর্থনৈতিক টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তখন বাংলাদেশও ব্যতিক্রম নয়। প্রতিদিনের জীবন যেন ভরপুর যান্ত্রিক শব্দ, রাজনৈতিক অস্থিরতা আর অনিশ্চয়তায়। এমন সময়েই সিলেটের সুরমা নদীর পাড় ঘেঁষা এক পুরোনো মার্কেটের দোকানঘরে সত্যজিৎ রাজনের দ্বিতীয় প্রদর্শনী আমাদের সামনে হাজির হলো— এক শিল্পানুষ্ঠান, যা বাস্তবতার সঙ্গেও গভীরভাবে মিশে আছে।

আমরা অনেকেই ধরে নিই, একটি প্রদর্শনী মানেই হবে নিখুঁতভাবে সাজানো গ্যালারি—শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত পরিবেশ, হালকা সুরেলা সংগীত, নরম আলো এবং সুগন্ধে ভরা পরিপাটি আয়োজন। যেন স্বর্গীয় এক অভিজ্ঞতা। কিন্তু এখানে হলো একেবারে বিপরীত। নেই বড় কোনো বিলবোর্ড, নেই প্রচারণার আড়ম্বর। শিল্পী যেন ইচ্ছে করেই নিজেকে প্রচারের বাইরে রেখেছেন। বরং শিল্প এবং শিল্পীকে খুঁজে পেতে দর্শককে আসতে হয়েছে সুরমা নদী থেকে মাত্র এক মিনিট দূরের অর্ধ-পুরোনো এক মার্কেটের ছোট্ট ঘরে—যা আসলে শিল্পীর নিজস্ব স্টুডিও।

 

এই জায়গার নির্বাচনই আমাদের দেশের বাস্তবতাকে মনে করিয়ে দেয়। শিল্পকে কেন্দ্র করে কোনো চাকচিক্য নয়; বরং জীবনের সংগ্রাম, অস্থিরতা আর যান্ত্রিক কোলাহলকেই এখানে প্রদর্শনীর অংশ করে তুলেছেন শিল্পী। প্রদর্শনীঘরে ঢুকেই দেখা যায়—কোনো মেকআপ নেই, কোনো সাজানো-গোছানো ভান নেই। শিল্পকর্ম ঝোলানো হয়েছে শিকল দিয়ে। এই শিকল কেবল প্রদর্শনীর টেকনিক নয়; এটি যেন আজকের পৃথিবীর প্রতীক—একদিকে বাঁধন ও সীমাবদ্ধতা, অন্যদিকে প্রতিবাদের ভাষা। গরম আর বাইরের শব্দের সঙ্গে লড়াই করে দর্শক যেমন ছবি দেখছে, তেমনি শিল্পীও জানিয়ে দিচ্ছেন—শিল্প জীবনের বাস্তব সংগ্রাম থেকে আলাদা নয়।

আমি শিল্পবোদ্ধা নই, কোনো সমালোচকও নই। কিন্তু এই লেখার কারণ ব্যক্তিগত। সত্যজিৎ রাজনকে আমি সবসময় শিল্পকলার একজন বড় ভাই হিসেবে দেখেছি। প্রায় আমাদের বেড়ে ওঠার সময় তার শিল্পকর্মের সঙ্গেই কেটেছে। যদিও তার প্রথম প্রদর্শনী “নক্ষত্রগুহা ও ছায়াপথের ত্বক” (জয়নুল গ্যালারি-২, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ২০১৫)–এ আমি উপস্থিত থাকতে পারিনি, তবে সেসব কাজ বহুবার দেখেছি, অনুধাবন করেছি। আর এবার তার দ্বিতীয় প্রদর্শনীতে সরাসরি উপস্থিত থেকে যেন এক দায়িত্ববোধ থেকেই এই লেখা লিখছি।

এই দশ বছরে তার শিল্পে এসেছে পরিবর্তন। তিনি মাধ্যম বদলেছেন—তেলরং, অ্যাক্রিলিক, এচিং, কালি-কলম ও প্যাস্টেলের পাশাপাশি এবার নতুনভাবে যুক্ত করেছেন জলরঙ। জলরঙের স্বচ্ছতা ও তৎক্ষণাত প্রকাশ তার কাজে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। শহুরে ল্যান্ডস্কেপে তার রঙের ব্যবহার ও বিমূর্ত বিন্যাস দর্শককে এক নান্দনিক অথচ কাঁচা সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করায়।

তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, এই পরিবর্তন বাহ্যিক নয়; বরং অন্তর্লোকের। তার কাজের প্রতিটি রেখায়, রঙে, ভাঙনে, এমনকি অসম্পূর্ণতায়ও আছে সাহসিকতা। জীবন যেমন নিখুঁত নয়, তেমনি তার শিল্পও নিখুঁত হওয়ার দাবি করে না। দর্শকের চোখে হয়তো অসম্পূর্ণ, কিন্তু শিল্পীর কাছে সেটিই সত্য।

আমার দৃষ্টিতে সত্যজিৎ রাজনের শিল্পচর্চা এমন এক ধারা, যেখানে শরীর, মনন, চরিত্র এবং সময়ের দ্বন্দ্ব একসঙ্গে মিশে যায়। তিনি সেই শিল্পীদের একজন, যাদের কাজ চিনতে দর্শকের সিগনেচারের প্রয়োজন হয় না। তার শিল্পকর্মই তার পরিচয় বহন করে।

ভবিষ্যতের জন্য একটাই প্রত্যাশা—তিনি তার কাজগুলোর সংরক্ষণে আরো সচেতন হবেন। কারণ একটি চিত্রকর্ম শেষ হওয়ার পর তা আর শুধু শিল্পীর সম্পদ থাকে না; হয়ে ওঠে সময়ের দলিল এবং দর্শকেরও অংশীদারিত্ব।

এই প্রদর্শনী শুধু সত্যজিৎ রাজনের দ্বিতীয় আত্মপ্রকাশ নয়; এটি আমাদের সময়, সমাজ ও অন্তর্লোকের প্রতিচ্ছবি। এখানে আছে যন্ত্রণার অগ্নি, আবার আছে স্বপ্ন দেখার সাহস। ফলে এই প্রদর্শনী একদিকে ব্যক্তিগত, অন্যদিকে সামষ্টিক—শিল্পীর নিজস্ব সংগ্রাম যেমন এর ভেতরে ধরা পড়েছে, তেমনি দেশের ও বিশ্বের অস্থিরতাও এর ভেতরে প্রতিফলিত হয়েছে।

তবে এ-ও বলতেই হয়, নতুন প্রদর্শনীর জন্য আর একটি দশক অপেক্ষা করার মতো ধৈর্য এই সময়ের নেই। সত্যজিৎ রাজনের মতো শিল্পীর কাছ থেকে আমাদের প্রত্যাশা থাকবে—আগামীতে তিনি আরও দ্রুত সময়ে নতুন প্রদর্শনীর আয়োজন করবেন। আবিষ্কার করবেন নতুন মাধ্যম, নতুন ফর্ম, নতুন রঙ ও নতুন গল্প। যেন তার শিল্পচর্চা কেবল সময়ের সাক্ষী না হয়ে, ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনাও হয়ে ওঠে।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত