মিহিরকান্তি চৌধুরী

২০ জুন, ২০২৫ ২১:৪৯

সনজীদা খাতুন : মানবিক বোধের এক নক্ষত্র

শ্রদ্ধা ও স্মরণ

সনজীদা খাতুন। ছবি সংগৃহিত

প্রফেসর ড. সনজীদা খাতুন বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তিনি ছিলেন একাধারে রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী, লেখক, গবেষক, সংগঠক, সংগীতজ্ঞ, শিক্ষক ও রবীন্দ্র অনুরাগী। তাঁর জীবন ও কর্ম রবীন্দ্রচর্চা, সংগীতশিক্ষা এবং সাংস্কৃতিক আন্দোলনের এক অবিচ্ছেদ্য অধ্যায়। বাংলাদেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ছায়ানটের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এবং দীর্ঘকালীন সভাপতি হিসেবে তিনি জাতির সাংস্কৃতিক সত্তা গঠনে অনন্য ভূমিকা রেখেছেন।

তিনি জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদেরও প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন। প্রচলিত শিক্ষার গণ্ডি পেরিয়ে বিকল্প ধারার শিশুশিক্ষা প্রতিষ্ঠান নালন্দা-এর সভাপতির দায়িত্বও তিনি নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেছেন। বিগত ২৫ মার্চ ২০২৫ তারিখে এই মহীয়সী নারী ব্যক্তিত্ব পরিণত বয়সে প্রয়াত হয়েছেন। তাঁর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করি।

জন্ম ১৯৩৩ সালের ৪ এপ্রিল ঢাকায়। সনজীদা খাতুনের পিতা ছিলেন প্রখ্যাত পণ্ডিত ও জাতীয় অধ্যাপক ড. কাজী মোতাহার হোসেন, যিনি বাংলাদেশে জ্ঞানচর্চার এক উজ্জ্বল প্রতিভা। সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে বেড়ে ওঠার কারণে তাঁর মননে শৈশব থেকেই সংগীত ও সাহিত্যচর্চার বীজ রোপিত হয়। তিনি ছিলেন খ্যাতনামা সাহিত্যিক ও প্রকাশক কাজী আনোয়ার হোসেনের বোন এবং রবীন্দ্রসংগীত বিশেষজ্ঞ ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ওয়াহিদুল হকের স্ত্রী। তাঁর আরও দুই বোন ফাহমিদা খাতুন ও মাহমুদা খাতুনও বিশিষ্ট রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী ছিলেন।
বাবা জাতীয় অধ্যাপক ড. কাজী মোতাহার হোসেন। ১৯৫৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে সম্মানসহ স্নাতক এবং ১৯৫৫ সালে ভারতের রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, শান্তিনিকেতন থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি ও ১৯৭৮ সালে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ । শিক্ষা শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান। বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পুরোধা। শান্তিনিকেতনের শিক্ষাদীক্ষা তাঁর মননগঠনে গভীর প্রভাব বিস্তার করে এবং রবীন্দ্রসংগীত ও সাংস্কৃতিক দর্শনের প্রতি তাঁর দায়বদ্ধতা আরও দৃঢ় করে তোলে। বিগত দশকের ষাটের দশকে শাসকের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে রবীন্দ্র শতবর্ষ উদযাপনের অগ্রগণ্য সৈনিক । রমনা বটমূলে বর্ষবরণ আয়োজনের পথিকৃৎ।

জানা যায়, ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষের অনুষ্ঠান উদ্‌যাপন শেষে এক বনভোজনে গিয়ে তিনিসহ অনেক অনুপ্রাণিত কর্মী সাংস্কৃতিক আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার জন্য সমিতি গঠন করার সিদ্ধান্ত নেন। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৬১ সালেই ছায়ানটের যাত্রা শুরু হয়। উদ্যোক্তাদের মধ্যে তাঁর স্বামী বিশিষ্ট রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী ও সাংবাদিক ওয়াহিদুল হকও ছিলেন । এরপর রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলগীতি, শুদ্ধ সংগীত, পল্লীগীতিসহ বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রের প্রশিক্ষণ শুরু হলো। তখন মানুষের ঐতিহ্যপ্রীতি বাড়াতে উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে পহেলা বৈশাখ উদযাপন করার রীতি শুরু করেন তাঁরা। ছায়ানট পহেলা বৈশাখের যে সংস্কৃতি চালু করেছে, তার বিন্যাস ও ব্যাপ্তি বিশাল। বর্তমানে ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে। সারা বিশ্বের বাঙালি পহেলা বৈশাখকে ঘিরে যে অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতি চর্চা করে, তার পথপ্রদর্শক ছায়ানট।

শিক্ষকতা দিয়ে তাঁর কর্মজীবনের সূচনা। শান্তিনিকেতন থেকে উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করে তিনি ইডেন কলেজ, কারমাইকেল কলেজ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে অধ্যাপনার দায়িত্ব পালন করেন। শিক্ষার পাশাপাশি সংগীত ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সঙ্গে তিনি নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন। ছায়ানট প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তিনি এদেশের সংগীতশিক্ষার এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি সাংস্কৃতিক সংগঠকদের একত্রিত করে স্বাধীনতার পক্ষে সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলেন। সংগীত ও সাহিত্যচর্চার মাধ্যমে তিনি জাতীয় চেতনাকে বিকশিত করেছেন, যা তাঁর কালজয়ী অবদানের স্বাক্ষর হয়ে থাকবে।

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নে তিনি রংপুর থেকে ঢাকায় ফিরে আসেন এবং পরে সাভারের জিরাব গ্রাম থেকে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে প্রবেশ করেন। সেখানে আগরতলায় কিছুদিন অবস্থান করে ৫ মে কলকাতায় যান এবং সাংস্কৃতিক কর্মীদের একত্রিত করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত সংগঠিত করতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তাঁর সাংস্কৃতিক নেতৃত্ব মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রতিরোধ ও স্বাধীনতা-উত্তর সাংস্কৃতিক পুনর্গঠনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে।

বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে তাঁর অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি বহু মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে একুশে পদক ও বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ থেকে পেয়েছেন রবীন্দ্র স্মৃতি পুরস্কার ও দেশিকোত্তম পুরস্কার। এ ছাড়া কলকাতার টেগোর রিসার্চ ইনস্টিটিউট ১৯৮৮ সালে তাঁকে ‘রবীন্দ্র তত্ত্বাচার্য’ উপাধি প্রদান করে। আরও রয়েছে ভারত সরকারের পদ্মশ্রী পুরস্কার (২০২১) এবং বাংলাদেশের ব্র্যাক ব্যাংক-সমকাল সাহিত্য পুরস্কার (২০১৯, নজরুল মানস প্রবন্ধগ্রন্থের জন্য)।
সনজীদা খাতুনের গায়কীতে ছিল প্রকৃত নিবেদন, ছিল সুরের মাঝে আত্মার প্রকাশ ।

 তিনি কেবল একজন রবীন্দ্রসংগীত শিল্পীই ছিলেন না, তিনি ছিলেন সংগীতের এক মনস্বী শিক্ষক ও গভীর সাধক, যাঁর কণ্ঠে নিবেদনের ঔজ্জ্বল্য স্পষ্ট হয়ে উঠত। সংগীতের প্রতি তাঁর অকৃত্রিম ভালোবাসা ও আত্মনিবেদনের ফলে তাঁর গাওয়া প্রতিটি রবীন্দ্রসংগীত শ্রোতার মনে গভীর অনুরণন তুলত। তাঁর গায়নে ছিল হৃদয়ের গভীর অনুভূতি, যা কেবল কণ্ঠস্বরের সুরেলা প্রবাহ নয়, বরং এক অন্তর্নিহিত আবেগ ও সত্তার বহিঃপ্রকাশ। তিনি বিশ্বাস করতেন, গায়কীর প্রকৃত সৌন্দর্য কেবল সুর ও তালেই নয়, বরং তা গড়ে ওঠে শিল্পীর আত্মার নিঃশর্ত নিবেদনের মধ্য দিয়ে। তাঁর কণ্ঠস্বরে তাই শুধু সুরের মাধুর্য নয়, বরং সংগীতের প্রতি এক অন্তর্গত দায়বদ্ধতা ও সাংস্কৃতিক আদর্শের প্রতিচ্ছবি প্রতিফলিত হতো। রবীন্দ্রসংগীতের ভাব ও দর্শনকে হৃদয়ে ধারণ করে তিনি তা গানে রূপ দিতেন, যা বাংলা সংগীতজগতে এক অনন্য উদাহরণ হয়ে থাকবে। তাঁর নিবেদিত সুরভঙ্গি, নিখুঁত উচ্চারণ ও গভীর আবেগ সংগীতকে কেবল শোনার নয়, অনুভবের বস্তুতে পরিণত করত। তাই তাঁর গায়কী চিরকালীন, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে তা পথপ্রদর্শক হয়ে থাকবে।

সনজীদা খাতুন সহজ, সরল জীবনযাপন করতেন। নামের সাথে ‘প্রফেসর’, ‘অধ্যাপক’, ‘ডক্টর’ এগুলো ব্যবহার করতেন না। কথায় আছে ‘চেনা বামুনের পৈতা লাগে না’। বরং সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে তাঁর নামের সালে ‘আপা’ সম্বোধন ভিন্ন আঙ্গিকের এক মাত্রা লাভ করেছিল। তাঁর সহজবোধ্য জীবনধারা বিভিন্ন প্রজন্মকে প্রভাবিত করেছে। বাঙালির আদি দর্শন ‘প্রচারবিমুখতা’ তাঁর মতো ব্যক্তিত্বের মাধ্যমেই প্রচার পেয়েছিল। রবীন্দ্র অনুরাগের নান্দনিক পাঠ তিনিই দিয়েছিলেন তরুণ প্রজন্মকে। ব্যক্তিগতভাবে তাঁর সাথে আমার একবার যোগাযোগ হয়েছিল ২০১০ সালে। রবীন্দ্রনাথবিষয়ক আমার ইংরেজি প্রবন্ধগ্রন্থ দ্য হন্টিং রেজ : টেগোর মিসালেনি প্রকাশিত হলে শ্রদ্ধা ও শুভেচ্ছার স্মারক হিসেবে তাঁর কাছে একখানা কপি পাঠাই। তিনি একদিন আমাকে ফোন করে আশীর্বাদ করলেন, শুভেচ্ছা জানালেন। আমি চিরকৃতজ্ঞ হয়ে রইলাম।   

সনজীদা খাতুন সাহিত্যচর্চায়ও অনবদ্য অবদান রেখেছেন। তিনি গবেষণাধর্মী ও প্রবন্ধমূলক ষোলোটি গ্রন্থ রচনা করেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে : কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, রবীন্দ্রসংগীতের ভাবসম্পদ, ধ্বনি থেকে কবিতা, অতীত দিনের স্মৃতি, রবীন্দ্রনাথ: বিবিধ সন্ধান, ধ্বনির কথা আবৃত্তির কথা, স্বাধীনতার অভিযাত্রা, সাহিত্য কথা সংস্কৃতি কথা, জননী জন্মভূমি, রবীন্দ্রনাথ এবং রবীন্দ্রনাথ, শান্তিনিকেতনের দিনগুলি, জীবনবৃত্ত, নজরুল মানস ।

সনজীদা খাতুনের জীবন ও কর্ম বাংলা সংস্কৃতির ঐতিহ্য ও উন্নয়নের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। তিনি শুধু সংগীতজ্ঞ বা শিক্ষাবিদ ছিলেন না; তিনি ছিলেন এক নিরবচ্ছিন্ন সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পুরোধা। তাঁর চিন্তা, গবেষণা, এবং সংগীতভাবনা বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে এক অবিস্মরণীয় অধ্যায় হয়ে থাকবে। তাঁর কণ্ঠে রবীন্দ্রসংগীত যেমন প্রাণ পেত, তেমনি তাঁর নেতৃত্বে সাংস্কৃতিক আন্দোলন পেয়েছে নবজাগরণ।

তাঁর অমর কীর্তি চিরকাল বাংলার সাহিত্য, সংগীত ও সাংস্কৃতিক জগতকে আলোকিত করবে। এই মহৎপ্রাণ শিল্পী, লেখক, গবেষক, সংগঠক, সংগীতজ্ঞ ও শিক্ষকের স্মৃতির প্রতি আবারও শ্রদ্ধা জানাই।

মিহিরকান্তি চৌধুরী: লেখক, অনুবাদক ও নির্বাহী প্রধান, টেগোর সেন্টার সিলেট।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত