সুকান্ত গুপ্ত

২৫ মে, ২০১৬ ০০:০১

নজরুলের হৃদয়ের কাছাকাছি

বিদ্রোহী কাজী নজরুল ইসলাম সত্য সুন্দরের কণ্ঠস্বর বা তাঁর সৃষ্টির প্রতিনিধি। কারণ তাঁর রচনার মধ্য দিয়ে জীবনের অপ্রকাশিত ভাবনা গুলো প্রকাশ পায়। তাকে বলা যায় মানব জাতির বিবেকের কণ্ঠস্বর। নজরুলের সৃষ্টি আমাদের জীবনের সমস্ত আবেগকে স্পর্শ করে আমাদের দুর্বলতাকে জয় করেছে। তাঁর নিজ গুণে নজরুল তাঁর লেখায় বস্তু ও ভাবের সমন্বয় সাধন করেছেন, সে কারণে তাঁকে বস্তুবাদী ও ভাববাদী দ্বিস্বরূপে অভিহিত করা যায়। তার সাথে মিশে আছে আধ্যাত্মবাদ। তিনি আবার আমাদের দৃষ্টিতে রোমান্টিক মানস প্রবণতার অধিকারী।

বস্তুবাদী হিসেবে তিনি অধিকার হারা পীড়িত মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে উচ্চস্বর। আধ্যাত্ম চিন্তায় স্রষ্টার প্রেমে ব্যকুল তিনি।

নজরুল তাঁর বিশ্বাস থেকে যে সত্য উচ্চারণ করেছেন, সেখানে সেই সত্য শুধুমাত্র আবেগ চালিত নয়। এখানে তাঁর ভাবনার অনুগামী হয়ে উঠেছে তাঁর স্থির চিন্তা। কবি আত্ম বিশ্বাসের শক্তিকে জাগিয়ে তুলেছেন অতুলনীয় করে তাঁর রচনায়। বস্তুবাদী শিল্পীরা শুধু আত্মবিশ্বাসের শক্তিকে জাগ্রত করেন না তারা ভালবাসার শক্তিকেও আবিষ্কার করেন জীবনে। নজরুলের রচনায় ভালবাসার চিরন্তনতার রূপ ধরে এই ভাবে-

‘‘ভোলো মোর গান, কি হবে লইয়া এইটুকু পরিচয়
আমি শুধু তব কণ্ঠের হার, হৃদয়ের কেহ লয়।
জানায়ো আমারে যদি আসে দিন এইটুকু শুধু যাচি
কণ্ঠ পারায়ে হয়েছি তোমার হৃদয়ের কাছাকাছি।’’
গানের আড়াল/ চক্রবাক

নজরুল প্রেমিক চিত্তের চিরন্তর স্বপ্নকে কবিতার শব্দে ও ভাষার অন্তরে জাগিয়ে তুলেছেন। হৃদয়ের নিকটবর্তী হওয়ার জন্য প্রেমিক চিত্তের যে আকুতি সেই আকুতি চঞ্চল ভাষাকে তিনি ধারণ করেছেন। এ ব্যাপারে নজরুলের ভাষায়-

জরোগ্রস্থ জাতিকে শুনাই নবজীবনের গান
সেই যৌবন উন্মাদ বেগ হে প্রিয়া তোমার দান।
হে চির কিশোরী। চির যৌবনা। তোমার রূপের ধ্যানে
জাগে সুন্দর রূপের তৃষ্ণা নিত্য আমার প্রাণে।
আপনার রূপে আপনি মুগ্ধা দেখতে পাওনা তুমি
কত ফুল ফুটে ওঠে গো তোমার চরণ মাধুরী চুমি!
কুড়ায়ে সে ফুল গাঁথি মালা কাব্য-ছন্দ-গানে
মালা দেখে সবে জানে না মালার ফুল ফুটে কোনখানে।
                                                                 -আমার কবিতা তুমি

এখানে নজরুল শুধু ভালবাসার কথা বলেননি, বলেছেন এই ভালবাসাকে জীবনের মহৎ শক্তির ভিতরে জাগিয়ে তুলতে তিনি করেছেন প্রেমের মৃত্যুহীন রূপের বন্দনা, প্রেমের কোন মৃত্যু নেই। এই একই বিষয়ে নজরুলের সুরে সুর মিলিয়ে ইংরেজ কবি, Edmund Spenser বলেছেন-

“My verse your virtues rear shall eterinize,
And in the heavens write your glarious name.
Where, when as death shall all the world subdue,
Our love shall live and later life renew”

প্রেমের প্রকাশ আমরা বলি চিরন্তন। মানুষের নিত্যনৈমত্তিক আসা যাওয়া এর ভাবরাজ্যে। নর-নারীর ভালবাসা ও বিশ্বাস এবং স্রষ্টার প্রতি আত্মনিবেদনের প্রেম এ দুয়ের সম্মিলন ঘটে নজরুলের প্রেমরূপ চিন্তায়। মানুষের প্রতি ভালবাসার রূপ নজরুলে প্রকাশিত হয় ভিন্ন দুটি রূপে এর একটি মানবতাবাদী এবং অন্যটি দেশপ্রেম। নজরুল তাঁর মানবিক প্রেমে অতি মাত্রায় স্পর্শকাতর। এর প্রতিটি অনুভূতি জীবন্ত। এ যেন মানব প্রেমের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

চাঁদের পিয়ালাতে আজি
জোছনা-সিরাজী ঝরে।
ঝিমায় নেশায় নিশীথিনী
সে শরার পান করে।।

এখানে দেখা যায় কবি হারানো বেদনায় বিরহকাতর। বাংলা প্রেমের গানে আনন্দ- বেদনা, মিলন ও বিরহের সুর যা পাওয়া যায়, নজরুলের গানের সুরে এ অনুভব হৃদয়স্পর্শী। ভালবাসার মূল্য জানে প্রেমিক হৃদয়। প্রেমের পথে সে বিলিয়ে দেয় তার ভালবাসার সব সঞ্চয়। যেমন কবি বলেছেন-

‘‘মোর প্রিয়া হবে, এস রাণী, দেব খোঁপায় তারার ফুল
কর্ণে দোলাব তৃতীয়া তিথির চৈতী চাঁদের দুল”

অতীন্দ্রিয় প্রেমে নজরুল মানবিক প্রেমের আবহ নির্মাণ করেন। এ তাঁর শক্তিশালী সৃজনশৈলীর গুণ। সাধারণের চোখে এ গানগুলো মানবিক প্রেমানুভবের প্রকাশ বলে মনে করলেও এর আবেদন ভিন্ন চিন্তা প্রসূত। যেমন-

আমার আপনার চেয়ে আপন যে জন
খুঁজি তারে আমি আপনায়।।
আমি শুনি যেন তার চরণের ধ্বনি
আমার এ তিয়াসী বাসনায়।

এখানে আমার আপনার চেয়ে আপন যে জনে বলতে কবি স্রষ্টাকে বুঝিয়েছেন যায় নৈকট্য লাভের আশায় আমরা পথ চেয়ে বসে থাকি। এখানেই দেখা যায় নজরুলের প্রেম কিভাবে মানবিকতার স্তর হতে আধ্যাত্ম লোকে উন্নীত হয়। অনুভবের সব দরজা খুলে দিলে আমরা পাই কবির প্রাপ্তি ও প্রত্যাশার নতুন এক জগত তাঁর তৃষ্ণার প্রতিবিম্ব-

প্রেম সত্য, প্রেম পাত্র বহু অগর্ণন,
তাই চাই, বুকে পাই, তবু কেন কেঁদে ওঠে মন।
(অনামিকা-সিন্ধু হিন্দোল)

আপনার মন্তব্য

আলোচিত