দোদুল খান

০৬ জুলাই, ২০১৬ ২২:১৯

‘ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে’ এবং ‘নজরুল-আব্বাস-ভগবতী’

‘ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে, এলো খুশির ঈদ’। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের এ গানটি যেন মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদ-উল-ফিতরের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। শেষ রমজানের সন্ধ্যায় আকাশে চাঁদ দেখার পরই সবার মনের মধ্যে গুনগুন করে বাজতে থাকে আব্বাস উদ্দিনের কন্ঠে নজরুলের গানটি।

প্রথম কবে নজরুল গানটি লিখেছিলেন, আর এ গানের প্রেক্ষাপটই বা কী, এ নিয়ে রয়েছে নানা মতবিরোধ ও বিতর্ক। তবে নজরুল গবেষকরা মোটামুটি কিছু বিষয়ে একমতই হয়েছেন যে আব্বাস উদ্দিনের অনুরোধেই ঈদ-উল-ফিতর উপলক্ষ্যে গানটি লিখেন নজরুল ও রেকর্ড করেন আব্বাস উদ্দিন। সালটি ১৯৩১ সাল, আর গানটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৩২ সালের ফেব্রুয়ারিতে। এরপর কেটে গেছে ৮৫ বছর, আজো চিরনবীন হয়ে আছে ‘ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে’ গানটি।

কেবলমাত্র ‘ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে’ গানটি নয়, প্রথমবার নজরুল রেকর্ড করেছিলেন দুটি গান। অপরটি হচ্ছে ‘ইসলামের ওই সওদা লয়ে’। একইসাথে বের হওয়া এ রেকর্ডটি তৎকালীন রেকর্ড ব্যবসায় গড়ে অনবদ্য এক রেকর্ড।

এ দুটি কালজয়ী গানের পেছনে যে তিনটি নাম অবিস্মরণীয়, তা হলো গানদুটির রচয়িতা কাজী নজরুল ইসলাম, কন্ঠশিল্পী আব্বাস উদ্দিন ও হিজ মাস্টারস ভয়েস কোম্পানীর রেকর্ডিং ইনচার্জ ভগবতী ভট্টাচার্য্য। বাকি দু’জনের নামের সাথে সবার পরিচয় থাকলেও ভগবতী ভট্টাচার্য্যরে নামটি জানেন না প্রায় কেউই।

এ প্রসঙ্গে কলামিস্ট মমতাজ উদ্দিন খান ২০১৩ সালে দৈনিক আজাদীতে প্রকাশিত একটি উপ-সম্পাদকীয়তে উল্লেখ করেন, “ভগবতী ভট্টাচার্য্য একটি স্মরণযোগ্য নাম। তার নাম আমরা ক’জনই বা জানি। ভুলে যাওয়ার অভ্যেস তো আমাদের আছে। তাই আমরা ভগবতী ভট্টাচার্য্যকে কখনো স্মরণ করি না কিংবা শ্রদ্ধায় অবনত হয়ে বলি না, ভগবতী বাবু আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ। যদি ১৯৩১ সালে হিজ মাস্টারস ভয়েস কোম্পানিতে আব্বাস উদ্দিন আহমেদের প্রস্তাবকে নাকচ করতেন তা হলে কি ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে’ গানটি আমরা কি পেতাম? না পেতাম না”।

নজরুল যে সময়ে গানদুটি রেকর্ড করেন, তখন তখনকার সময় ও সমাজ প্রেক্ষিতে কোলকাতার উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শিক্ষিত মুসলমানরা নজরুলকে ‘কাফের’ বলতেন। নজরুলের মত একজন কবিকে কাফের বলার বিষয়টি আব্বাস উদ্দিন আহমেদের মনে কষ্ট দিলে তিনি নজরুলকে অনুরোধ করেন, “কাজী দা, কোলকাতায় মুসলমানরা তো আপনাকে কাফের বলে, আমি বলি কি, দু’টো ইসলামি গান রেডি করুন না, আমি গেয়ে দেবো, দেখবেন, আপনার প্রতি যে ধারণা তার আমূল পরিবর্তন হবে।’

নজরুল ইসলাম এ প্রস্তাব দ্বিধা-সংকোচিত চিত্তে গ্রহণ করলেও পরে বলেছেন, ঠিক আছে, তুমি এইচএমভি কোম্পানির ভগবতী বাবুকে রাজী করাতে পারলে আমি করে দেবো।

তারপর থেকে শুরু হয় আব্বাস উদ্দিনের অধ্যবসায়। তিনি ভগবতী ভট্টাচার্য্যকে প্রথম প্রস্তাব করেন দু’টি ইসলামি গান রেকর্ড করার জন্য। কিন্তু আব্বাস উদ্দিনের প্রস্তাবে সাড়া দেননি ভগবতী ভট্টাচার্য্য। তখন কোলকাতায় হিন্দু রক্ষণশীল সমাজে শ্যামা সঙ্গীত, কীর্তন, ভজনের রমরমা বাজার, এ অবস্থা ভগবতীও ভাবেননি ইসলামি গান রেকর্ডিং করার কথা, তাছাড়া তখন মুসলমান সমাজের গান বাজনাও ছিল প্রায় নিষিদ্ধ।
সে সময় কোচবিহারের উদীয়মান তরুণ জনপ্রিয় শিল্পী আব্বাস উদ্দিনের বেশ কয়েকটি গান কোলকাতার বাজারে জনপ্রিয়, নজরুল ইসলামের গান প্রতিটি ঘরেই সমাদৃত। কিন্তু আব্বাস উদ্দিনের প্রথম চেষ্টা ব্যর্থ হয়।

১৯৩১ সালের নভেম্বর মাসে, আব্বাস উদ্দিন দ্বিতীয়বার ভগবতী ভট্টাচার্য্যকে প্রস্তাব করেন দুটি ইসলামি গান রেকর্ড করার জন্য। এবারে রাজি হন ভগবতী। তরুণ শিল্পী আব্বাস উদ্দিন একদৌড়ে এইচএমভি কোম্পানীতে কাজী নজরুল ইসলামের কাছে যান, তখন নজরুল ইন্দু বালাকে গানের সুর তুলে দিচ্ছিলেন। আব্বাস উদ্দিন বললেন, ‘কাজীদা ভালো খবর আছে। ভগবতী বাবু রাজী হয়েছেন দু’টো ইসলামি গান রেকর্ড করবেন।’

সেই থেকে শুরু। নজরুল ইন্দুবালাকে বিদায় দিয়ে তার আর্দালি দশরথকে চা ও পানের অর্ডার দিয়ে হারমোনিয়াম ও কাগজকলম নিয়ে বসেন। সৃষ্টি হয় বাংলার মুসলমানদের জন্য কালজয়ী বিখ্যাত গান ‘ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে’। দু’লাইন লেখেন আর সুর করে আব্বাসকে ধরিয়ে দেন। এরপর আরো একটি গান ‘ইসলামের ওই সওদা লয়ে’ তাৎক্ষণিকভাবে রচনা ও সুর সংযোজনা করে আব্বাসের কণ্ঠে তুলে দেন।

১৯৩১ সালের ডিসেম্বরই গান দু’টি রেকর্ড করা হয়। অপূর্ব সুর ও ছন্দে ইসলামি গান দু’টি সবার প্রশংসা অর্জন করে এবং ঠিক ২ মাস পর ১৯৩২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসেই ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’ এবং ‘ইসলামের ঐ সওদা লয়ে এলো নবীন সওদাগর’’ গান দু’টি বাজারে রেকর্ড করে ছাড়া হয়। হিজ মাস্টার ভয়েস এর এ রেকর্ডের নম্বর ৪১১১।

কেবল কোলকাতা নয়, গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ছড়িয়ে পড়ে এ গানের ঢেউ। দেশবাসী, বিশেষ করে মুসলমানরা হতবাক ও বিস্মিত হন। ইসলামের শাশ্বতবাণী গানের মাধ্যমে এতোটাই জনপ্রিয় হলো যে, এইচএমভি কোম্পানি অন্যান্য গানের রেকর্ডে যে পরিমাণ বিক্রয়লব্ধ মুনাফা করত তার চেয়ে আরো বেশি লাভবান হতে শুরু করলো। তখন এইচএমভির ভগবতী ভট্টাচার্য্য আরো কিছু ইসলামি গান রেকর্ডের প্রস্তাব দেন, মুক্ত হয় বাংলা ভাষায় ইসলামি গানের এক নতুন জগত।

সে সময় আরো একটি অদ্ভুত ব্যাপার ঘটে। ইসলামী গানের বাড়তি চাহিদার পাশাপাশি মুসলিম গায়কের সংকট দেখা দেয়, এবং হিন্দু ধর্মাবলম্বী অন্যান্য গায়ক-গায়িকারা ইসলামী গানে মুসলমানী নাম ধারণ করে রেকর্ড করেন। তাদের মধ্যে ধীরেন দাস-গনি মিয়া নামে, চিত্ত রায়-দেলোয়ার হোসেন, আশ্চার্যময়ী দাসী-আমিনা বেগম, গিরীন চক্রবতী-সোনা মিয়া, সীতাদেবী-দুলীবিবি অন্যতম।

আব্বাস উদ্দিন তার কন্ঠে ‘এই সুন্দর ফুল, সুন্দর ফল, মিঠা নদীর পানি খোদা তোমার মেহেরবানী’, ‘তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে’, ‘আমি যদি আরব হতাম, মদিনারই পথ’সহ প্রায় ৭৪টি ইসলামি গান রেকর্ড করেন।

কাজী নজরুল ইসলামের সৃষ্টিশৈলী, আব্বাস উদ্দিনের সুরেলা কন্ঠ ও ভগবতী ভট্টাচার্যের পৃষ্ঠপোষকতায় ‘ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে, এলো খুশির ঈদ’ গানের হাত ধরে এবার ৮৫টি ঈদ অতিক্রম করতে যাচ্ছে, বাংলা ইসলামী গান।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত