সিলেটটুডে ডেস্ক

১৯ ফেব্রুয়ারি , ২০১৯ ১৭:১৪

চলচ্চিত্র আন্দোলনের পুরোধা মুহম্মদ খসরু আর নেই

বাংলাদেশের সুস্থধারার চলচ্চিত্র আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ মুহম্মদ খসরু আর নেই।

মঙ্গলবার (১৯ ফেব্রুয়ারি) দুপুর ১২টায় রাজধানীর বারডেম হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।

২১ জানুয়ারি শ্বাসকষ্ট ও হৃদরোগ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন মুহম্মদ খসরু।

তার নিকটতম সহচর ইমন জানান, মুহম্মদ খসরু দীর্ঘদিন ডায়াবেটিক, অ্যাজমা, শ্বাসকষ্ট ও হৃদরোগে ভুগছিলেন। হাসপাতালে ভর্তির পর তার নিউমোনিয়া ধরা পরে।

বুধবার বেলা ১১টায় সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য মুহম্মদ খসরুর মরদেহ নেওয়া হবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে। তার প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হবে বেলা একটায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদে।

চলচ্চিত্রকার জাহিদুর রহিম অঞ্জন জানান, মুহম্মদ খসরুকে তার গ্রাম কেরানীগঞ্জের রুহিতপুরের মোহনপুরে দাফন করা হবে। অকৃতদার মুহম্মদ খসরু দুই ভাই ও তাদের পরিবার পরিজনদের রেখে গেছেন।

মুহম্মদ খসরু ভারতের হুগলি জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পৈতৃক বাড়ি কেরানীগঞ্জের রুহিতপুরের মোহনপুর গ্রামে। তিনি দীর্ঘ সময় চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বাইরে তার পড়ালেখা ছিল অগাধ।

কখনো লেখক, কখনো সম্পাদক, আবার কখনো দক্ষ সংগঠক হিসেবে তিনি ছিলেন নন্দিত। জীবনের বেশির ভাগ সময় নিভৃতচারী হিসেবেই কাটিয়েছেন তিনি।

মুহম্মদ খসরু চলচ্চিত্র বিষয়ক কালজয়ী পত্রিকা ‘ধ্রুপদি’ সম্পাদনা করতেন। চলচ্চিত্র মহলে সেটি ছিল সবচেয়ে গৃহীত ও নন্দিত পত্রিকা। তার উদ্যোগে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সংসদের তত্ত্বাবধানে প্রতিষ্ঠিত হয় ফিল্ম স্টাডি সেন্টার।

বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সংসদের আন্দোলনের ফলে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজ এবং জাতীয় ফিল্ম আর্কাইভ। এ প্রতিষ্ঠানগুলোর পেছনে তার যথেষ্ট অবদান ছিল।

মুহম্মদ খসরু বাংলাদেশ চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন ইনস্টিটিউটের প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করেন।

তাকে নিয়ে কথাসাহিত্যিক শাহাদুজ্জামান ফিল্মফ্রিতে লিখেছেন, ‘মুহম্মদ খসরুকে যারা ব্যক্তিগতভাবে চেনেন, তারা জানেন যে মানুষ হিসেবে তিনি ক্ষেপাটে, রাগী, মুখে তার অবিরাম খিস্তি। তার সব রাগ, ক্ষোভ ওই চলচ্চিত্রকে ঘিরেই। এই মানুষ বেঁচে আছেন সংসার করার জন্য নয়, সম্পদ অর্জনের জন্য নয়, খ্যাতি কুড়াবার জন্য নয়, শুধু একটি শিল্পমাধ্যমকে ভালোবাসার এবং সেই ভালোবাসা অন্যের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়ার জন্য।’

১৯৬৩ সালে ‘পাকিস্তান চলচ্চিত্র সংসদ’ প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম মুহম্মদ খসরু। সৎ, শুদ্ধ ও নির্মল চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন, সেগুলোর পঠন-পাঠনের মাধ্যমে আস্বাদন, অনুধাবন ও উপলব্ধি করা, আলোচনা-সমালোচনা করা, চলচ্চিত্র বিষয়ক পত্রিকা প্রকাশ ও প্রচার, সর্বোপরি সমঝদার ও রুচিমান দর্শক তৈরির যে সূত্রপাত হয়েছিল ১৯৬৩ সালে, মুহম্মদ খসরু গত ৫০ বছর সেই ধারাবাহিকতা ধরে রেখেছিলেন।

‘পাকিস্তান চলচ্চিত্র সংসদ’ স্থাপনের সময় আরও ছিলেন আনোয়ারুল হক খান, বাহাউদ্দিন চৌধুরী, মোশাররফ হোসেন চৌধুরী, ওয়াহিদুল হক, আবদুস সবুর, সালাহ্উদ্দিন প্রমুখ।

চলচ্চিত্র নিয়ে পত্র-পত্রিকায় গুরুগম্ভীর লেখালেখি ও গবেষণার ধারাবাহিকতা শুরু হয় ১৯৬৮ সালে। পাকিস্তান ফিল্ম সোসাইটি থেকে মুহম্মদ খসরুর সম্পাদিত চলচ্চিত্রের কাগজ ‘ধ্রুপদি’ যখন প্রকাশিত হতো, সেই সময়ে চলচ্চিত্রের পত্রিকা সম্পাদনা কিংবা প্রকাশ ছিল প্রায় অসম্ভব কাজ। তখন থেকে আজ পর্যন্ত ‘ধ্রুপদি’ দুই বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রের কাগজের স্বীকৃতি পায়।

চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের এই প্রবাদতুল্য মানুষটি উৎসাহিত করেছেন দেশের খ্যাতনামা অনেক চলচ্চিত্রকারদের। তারেক মাসুদ তাদের অন্যতম। চলচ্চিত্রকে মানুষের অধিকারের পক্ষে কাজে লাগাতে লেখালেখি করেছেন তিনি। তার বইগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘বাংলাদেশের চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলন’, ‘বাংলাদেশে চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের ভূমিকা’, ‘সাক্ষাৎকার চতুষ্টয়’।

‘ধ্রুপদি’ ছাড়াও তিনি সম্পাদনা করেছেন ‘চলচ্চিত্রপত্র’, ‘ক্যামেরা যখন রাইফেল’, ‘সূর্যদীঘল বাড়ী’ বিশেষ সংখ্যা।

১৯৭৫ সালে ভারত-বাংলাদেশের যৌথ প্রযোজনার ‘পালঙ্ক’ ছবিটি নির্মাণের সময় মুহম্মদ খসরু ভারতীয় চলচ্চিত্রকার শ্রী রাজেন তরফদারের সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করেন। বাংলাদেশে চলচ্চিত্র সংস্কৃতির বিকাশে দীর্ঘ ৫০ বছর নিরবচ্ছিন্ন অবদানের জন্য মুহম্মদ খসরু ‘হীরালাল সেন’ আজীবন সম্মাননায় ভূষিত হন।

এ ছাড়া বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ‘সুবর্ণ জয়ন্তী পদক’ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চলচ্চিত্র সংসদ থেকে আজীবন সম্মাননা-২০১৭ দেওয়া হয় তাকে।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত