প্রণবকান্তি দেব

২০ জুন, ২০২০ ১৭:০০

কামাল লোহানী : বিদায় কিংবদন্তি

চিরঘুমে কেউ চলে যাওয়ার পর তাঁর মুখটা কেবলই চোখের সামনে ভেসে বেড়ায়... খুব আপন কেউ হলে, কারো সাথে খুব হৃদয়ের যোগাযোগ থাকলে সে মুখস্মৃতি সহজে সরানো যায় না।

বেদনার দগদগে ক্ষত নিয়েই আসা যাওয়া করছে ইদানীংকার দিন-রাত্রিগুলো। বেদনার সেই বহরে আজ যুক্ত হলেন কামাল লোহানী। কতো পরিচয় তাঁর- লেখক, সাংবাদিক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অন্যতম সংগঠক। প্রকৃতপক্ষে, কামাল লোহানীর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে আমরা হারালাম বাংলাদেশের প্রগতিশীল-অসাম্প্রদায়িক চিন্তার সবচেয়ে সাহসী এক পুরুষকে। তাঁর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে নিভে গেল মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে হৃদয়ে ধারণ করা এক ঐতিহাসিক মশাল। আমৃত্যু বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে বিভোর এক যোদ্ধাকে আমরা হারালাম, কামাল লোহানীকে হারানোর মধ্য দিয়ে।

আমাদের স্বপ্ন, সাহস, উদ্যম আর প্রেরণার অন্য নাম কামাল লোহানী। তিনি সর্বশেষ সিলেট এসেছিলেন ২০১৮ সালের ৯ মে ইনোভেটর এর আমন্ত্রনে বইপড়া উৎসবের সমাপনী অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। বহুদিনের চেনা এই কিংবদন্তি মানুষটাকে সেদিন আমি আবিষ্কার করি নতুন মাত্রায়। সমাজ ও মানুষের প্রতি কী প্রচন্ড রকমের দায়বোধ তাঁর, সেটি আরো একবার নিজের চোখে প্রত্যক্ষ করি সেদিন।

৯ মে ২০১৮ আমাদের বইপড়া উৎসবের সমাপনী ও পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠান। অতিথি কামাল লোহানী। অনেকেরই শংকা ছিল তিনি আসবেন কি না। একদিকে বয়স, আরেক দিকে নানাবিধ অসুস্থতা- শঙ্কার পেছনে বহু যৌক্তিক কারণ ছিল। সব আয়োজন চলছে, সিলেটের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি অঙ্গনের সবার কাছে খবর পৌছে গেছে, কামাল লোহানী সিলেট আসছেন। সবারই মানসিক প্রস্তুতি বর্ণাঢ্য এ মানুষটির সাক্ষাৎ পাওয়া। অনুষ্ঠানের দিন দুপুর বারোটায় নভোএয়ারের ফ্লাইটে তিনি ঢাকা থেকে আসার কথা। আমাদের অনুষ্ঠান ছিল বিকেল তিনটায়, কবি নজরুল অডিটোরিয়ামে। পরিকল্পনা ছিল, দুপুরে এসে খেয়ে দেয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে অনুষ্ঠানে আসবেন। সকাল এগারোটার দিকে আমাকে নিজেই জানালেন, তিনি বিমানবন্দরে এসে গেছেন। আমি রেজওয়ান ভাইয়ের অফিসে অপেক্ষা করছি সিলেট বিমানবন্দরে যাবো উনাকে নিয়ে আসতে। কিন্তু এমন ঝড়, বৃষ্টি আর বিদ্যুৎ চমকানো শুরু হলো যে বিমান ঢাকা থেকে উড়তেই পারলো না সময় মতো। আকাশে মেঘের গর্জন, এমনই কালো হতে লাগলো চারপাশ যে দুপুরেই সন্ধ্যা নেমে এলো। আমার বুকের ধুকপুক বাড়ছে। হাতের ফোন মুহুর্মুহু বেজে উঠছে। ওপাশ থেকে কামাল লোহানী কাকু জানাচ্ছেন ঢাকার খবর আর এ পাশ থেকে আমি।

বিজ্ঞাপন



উৎকন্ঠায় সময় যাচ্ছে আমার আর রেজওয়ান ভাইয়ের। একটা বাজে, দুটো বাজে ফ্লাইটের খবর নেই, আবহাওয়াও চরম খারাপ। তিনটায় আমাদের অনুষ্ঠান। লোহানী কাকু বিমানবন্দরে অপেক্ষা করছেন, অসুস্থ মানুষ, সময়ে সময়ে ওষুধ খেতে হয়। সকালে ঠিক মতো খেয়ে বের হন নি। তার উপর বৈরী আবহাওয়ায় বিমান ভ্রমণ...  দুশ্চিন্তা মাথায় চড়ে ওঠে। তিনটা বাজতেই অডিটোরিয়ামে মানুষের উপস্থিতি শুরু। কেন না সবারই জানা, ইনোভেটর এর অনুষ্ঠান যথাসময়েই শুরু হয়। ভাবনা-দুর্ভাবনায় আমি আর রেজওয়ান ভাই দুলতে থাকি। আপডেট বিনিময় চলছে। অবশেষে চারটায় আবহাওয়ার কিছুটা উন্নতি হওয়ায় বিমান ঢাকা থেকে ছাড়ার খবর দিলেন তিনি। বিশ্বাস করুন, এ-ই যে সকাল এগারোটা থেকে একজন বয়োজৈষ্ঠ্য মানুষ বিমানের অপেক্ষায়, মেঘ-বৃষ্টি-ঝড় তাতে একবারো তাঁকে বিচলিত মনে হয় নি। তিনি আমাদের অনুষ্ঠান নিয়ে টেনশন করছেন। সাড়ে চারটা, পৌনে পাঁচটার দিকে সিলেটে এসে পৌছালেন। হুইল চেয়ার থেকে নেমে গাড়িতে উঠেই বলেন, অনেক দেরি হয়ে গেছে, চলো সরাসরি অনুষ্ঠানে চলে যাই। আমি যখন উনার হাত ধরি, দেখি কাঁপছেন। ক্লান্ত, বিধ্বস্ত, অসুস্থ তিনি। একজন কামাল লোহানী বলছেন, যেহেতু দেরি হয়ে গেছে, শিক্ষার্থীসহ সুধী অপেক্ষা করছেন সেহেতু আর দেরি করা যাবে না। অনুষ্ঠান শেষে নাকি দুপুরের খাবার খাবেন। আমি আর রেজওয়ান ভাই পরস্পরের দিকে তাকাই, বিস্মিত হই তাঁর দায়বোধ দেখে। সিলেট বিমানবন্দর থেকে আসতে আসতে রাজি করাই যে, একটু খেয়ে, ওষুধ খেয়ে অনুষ্ঠানে যাব। ততক্ষণে হল উপচে পড়ছে অভ্যাগতদের আগমনে। দুর দুরান্ত থেকে শিক্ষার্থীরা এসেছে বৃষ্টিতে ভিজে, অভিভাবকরা এসেছেন। তিনটার প্রোগ্রাম তখন পাঁচটা বাজে...কামাল লোহানী কাকুর মুখে ভাত যাচ্ছিল না। ভেতর যেন ছটফট করছে যে কাজে আসছেন সেখানে যেতে, বিলম্বের জন্য একটা অপরাধবোধের রেখাও তাঁর চোখেমুখে স্পষ্ট হয়ে উঠল।  ঝটপট দু'মুঠো মুখে দিয়েই অডিটোরিয়ামের দিকে রওয়ানা।

অনুষ্ঠানস্থলে পৌছে দেখি তিল ধারনের জায়গা নেই। মুহুর্মুহু করতালি আর দাঁড়িয়ে অভিবাদন জানিয়ে কামাল লোহানীকে বরণ করে নিলেন সিলেটের সুধীজন। সাড়ে পাঁচটায় শুরু হলো অনুষ্ঠান। প্রকৃতির বৈরীতা আর কামাল লোহানীর মতো ব্যাক্তিত্বের উপস্থিতিকে সবাই যেন হাসিমুখে মেনে নিলেন। একে একে বক্তৃতা চলল। শেষ বক্তা কামাল লোহানী মাইকে এসে যেন যাদুমন্ত্রে আটকে রাখলেন হল ভর্তি সবাইকে। দ্রোহ, বিপ্লব, মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন - আদর্শ আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দর্শন-ভাবনা, তারুণ্যের কর্তব্য ইত্যাদি বিষয়ের উপর আলোকপাত করে তাঁর সেই দীর্ঘ বক্তৃতা মুহুর্তেই সকলকে অন্য ভুবনে নিয়ে গেল। স্পন্দিত উচ্চারণে, সাহসী বাক্যবাণে তিনি যেন জাগিয়ে দিলেন সবাইকে। কেউ ফিরে গেলেন একাত্তরে, কেউ বায়ান্নতে, কেউবা হাতড়ালেন সমকালীন বাংলাদেশ।

পুরো নজরুল অডিটোরিয়াম জুড়ে ছড়িয়ে যায় তাঁর বিপ্লবী আহবান, "বন্ধুরা, আমরা শ্রমিকের বন্ধু, আমরা কৃষকের বন্ধু, আমরা ছাত্রের বন্ধু। আমরা সবাই মিলে একাত্তরে এ দেশটাকে স্বাধীন করেছি। আমরা সবাই মিলে দেশটাকে ভালোবাসব,রক্ষা করব"। সেদিন তাঁর দীপ্ত উচ্চারণে উজ্জীবিত হন উপস্থিত সবাই।

বইপড়া উৎসবের অনুষ্ঠান শেষে রাতে অনেক গল্প হয়। পরদিন সকালে ঢাকায় ফেরার পালা। সকালের চায়ের আড্ডায় অনেক আলাপ হয়। বাংলাদেশের ইতিহাসের এক কিংবদন্তির কাছ থেকে জানার, শেখার শেষ হয় না কোনোদিন। ঐদিন তিনি চাইলেই ঢাকা বিমানবন্দর থেকে ফেরত চলে যেতে পারতেন। কিন্তু রীতিমতো জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এসেছিলেন কেবল মুক্তিযুদ্ধের বইপড়ার অনুষ্ঠান ছিল বলে, এসেছিলেন আমাদের কথা দিয়েছেন বলে। এ-ই তো দেশপ্রেম।

কামাল লোহানী আমৃত্যু শিক্ষা দিয়ে গেছেন কিভাবে দেশকে ভালোবাসতে হয়। তিনি শিক্ষা দিয়ে গেছেন, নিজের শেকড়কে কীভাবে আঁকড়ে ধরে রাখতে হয়। তিনি শিক্ষা দিয়ে গেছেন, কীভাবে বুকের গভীর থেকে উচ্চারণ করতে হয়, 'আমার সোনার বাংলা'। তাঁর মৃত্যু আমাদের সমাজ ও রাস্ট্র জীবনে গভীর এক শুণ্যতা তৈরি করে দিল। তাঁর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে উজ্জ্বল সমাজ চিন্তা আর প্রগতিবাদের এক অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটল।

কামাল লোহানীর জীবনাদর্শ, তাঁর অসাম্প্রদায়িক চিন্তা, গণমানুষের মুক্তির সংগ্রামকে হৃদয়ে ধারণ করতে পারলেই তাঁর প্রতি যথার্থ শ্রদ্ধা জ্ঞাপন হবে।

বিদায় কামাল লোহানী! বিদায় কিংবদন্তি!

প্রণবকান্তি দেব : শিক্ষক, লেখক ও সংগঠক।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত