প্রণব মজুমদার

১৯ অক্টোবর, ২০১৫ ২২:৫১

আত্মকথন: জীবনের অন্তিম যন্ত্রণাগুলো

জম্মের ঋণ শোধ হয় মৃত্যু দিয়ে। কারোর ক্ষমা নেই। মৃত্যু অনিবার্য। কিন্তু কেউই আমরা মৃত্যুকে মেনে নিতে পারি না। হোক তা স্বাভাবিক কিংবা দুর্ঘটনাজনিত। আর বড় অসময়ের মরনকে কেউই কি বরণ করে নিতে পারে ? আমিতো পারিনি মেনে নিতে বড় অসময়ে সহধর্মিণীর চলে যাওয়াকে! মাত্র ৩৮ বয়সে স্ত্রীর অন্তর্ধান! জানি অধিকাংশ ক্ষেত্রে ক্যান্সার রোগের ‘অ্যান্সার’ নেই। বড় অপরিপক্ক সময়ে মরনব্যাধি ঘাতক জরায়ু ক্যান্সার চিরতরে পৃথিবী থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গেলো স্ত্রীকে। আপনজন বলতে পড়ে রইলাম আমি আর একমাত্র নাবালিকা প্রমিতি। রেডিওথেরাপি, কেমোথেরাপি এবং নাভিমূলে ইনজেকশনের তীব্র যন্ত্রণা যে দুঃসহ সেটা অতি কাছের মানুষ হিসেবে আমরা দু’জনই বুঝেছি। রাতে ঘুমোতে পারতো না স্ত্রী হেনা। মৃত্যু যন্ত্রনায় ছটফট করতো। সে কষ্ট থেকে ওর শারীরিক উপশমের জন্য কতো রাত বিনিদ্র থেকেছি! শরীরে দফায় দফায় উচ্চ মাত্রার দামী ওষুধ প্রয়োগ। একে তো শরীরের নানা উপসর্গ ও প্রতিক্রিয়া তারমধ্যে ‘আপন’ মানুষগুলোর দেয়া মানসিক কষ্ট বোধ হয় ওর মৃত্যুটা তরান্বিত করেছে !

অনেক অনেক যন্ত্রণা ছিলো সহধর্মিণী হেনা মজুমদারের। হেনার সেই যন্ত্রণার মধ্যে নিজ ভাইবোন ও তাদের নিকটজন এবং আমার ভাইবোন ও নিকট আতœীয়স্বজনের স্বার্থবাদী চরিত্র ও প্রকৃতি অন্যতম। তাদের অবজ্ঞা আর লাঞ্চনায় হৃদয়ের অতলে ওর বেশ যন্ত্রণা হতো। মৃত্যুর ক’মাস আগে ওর মায়ের এক রূঢ় আচরণ ওকে বেশ কষ্ট দিয়েছে। ধর্মকর্ম করেন, বৈষ্ণব মতের প্রায় ৯৫ বয়সের এই মাতার আপত্তিজনক কথায় অনেকটা বাকহীন হেনা। চোখে ক’দিন জল দেখেছি ওর। অত্যন্ত আপনজন গর্ভধারিণী মায়ের সেই তীব্র যন্ত্রণা সইতে না পেরে আমাকে শুধু বললো ‘আমার মাও আমার মৃত্যু কামনা করছে’। মরনের সন্ধিক্ষণে এসে একদিন ও বললো ‘আমি যদি পূর্নজম্ম হয়ে লোকালয়ে ফিরে আসি, তাহলে এই মায়ের গর্ভে যেন আমার জম্ম না হয়’।

অন্ন বস্ত্র ও বাসস্থান এসব হচ্ছে মানুষের জীবনের মৌলিক চাহিদা। আমার স্ত্রী প্রথমোক্ত ২টি পেয়ে গেছেন তার জীবদ্দশায়। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন ‘বুঝে উঠার আগেই বাবাকে হারিয়েছি। মায়ের আদর পাইনি। বাবা মারা যাবার পর নববিবাহিত বড় ভাই বৌকে নিয়ে বহু দুরে সরে পরলেন। অন্য ভাইবোনদের কাছ থেকে ভালবাসা পাওয়ার বদলে গ্রামের বাড়ীতে টিউশনী করে বিধবা মাসহ তাদের প্রায় সকলের অন্ন বস্ত্র ও অন্যান্য আবদার মিটাতে হয়েছে। ৯ সদস্যের এ বিশাল পরিবারকে দেখভাল করতে গিয়ে নিজের সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের দিকে তাকাতে পারিনি! কিন্তু বিবাহের পরে আমি তোমার সংসারে এসে আমি প্রায় সব পেয়েছি। আমার ১৬ বছরের দাম্পত্য জীবনে একটি দিক ছাড়া সকল চাহিদার পূর্ণতা পেয়েছি। সাধ ও আবদার সবই মিটিয়েছো তুমি’। এ কথা ওর বান্ধবীদের কাছেও বলেছে হেনা। তাঁর প্রতি আমার বেশ অনুরাগ ও অগাধ ভালবাসা সে ব্যাপারে ওঁর কৃতজ্ঞতার কথা ওরা আমায় বলেছে। বান্ধবী ক’জন তো সেদিন বলেই বসলেন আমাদের স্বামীরা একা প্রায় দেড় বছর ধরে অর্ধ কোটি টাকার ওপরে ব্যয় করে ক্যান্সার রোগের চিকিৎসা করাতো না!

কিন্তু কি বিষয়ে অপূর্ণতা ছিলো তাঁর ? আর কিসের যন্ত্রণা ছিলো হেনা মজুমদারের ? নিজেদের এক টুকরো জমি নেই। জম্মের পর থেকেই ভাড়া বাসায় আমার বসবাস। এ যন্ত্রণা ওকে বেশ কুরে কুরে খেতো। ২০১৪ সালে মে মাসে ক্যান্সার আক্রান্ত হবার ঠিক আগের বছর। বাপের বাড়ীর এক আত্মীয় তৈরি করা বসত বাড়ী বিক্রি করবেন। হেনা আমায় বললো ৩২ লাখ টাকা যোগাড় করো। আমাদের একটি ঠিকানা হবে। সুন্দর বাড়ী! পাকা বাধানো ঘাট। বিকেলে ঘাটে বসে আমরা বুড়ো বুড়ী বুট-–বাদাম খাবো। আর রাতে ঘাটের হেলান দেয়া সিড়িতে বসে চাঁদের জোৎসনা দেখবো। পরে ওঁর বাপের বাড়ীর কাছাকাছি ৬ কাঠা জমিরও সন্ধান পেয়েছিলো সে। নিচু জমি তাই দাম অপেক্ষাকৃত কম ছিলো।

নিবন্ধনসহ জমিটুকু কিনতে ১৪ লাখ টাকা খরচ হতো। বলেছিলো মাটিই খাটি। ঋণ করে হলেও টাকা সংগ্রহ করো। জমি কেনার সামর্থ্য আমার নেই। তাই সহধর্মিণীর কাছে সাংবাদিক পেশার এই অক্ষম স্বামী ছিলো বেশ অসহায়! মৃত্যুর ৫ মাস আগে অনেকটা উষ্মার সঙ্গে স্ত্রী বললো, ১৯৮০ সালে ঢাকায় এসে এক টুকরো জমি করতে পারলে না ? ঠিকানাহীন সাংবাদিক! কতগুলো বড় বড় শ্রেণীর শিক্ষা সনদ নিয়ে খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে ঝড়ের বালি এবং বৃষ্টির জলপান করো! একমাত্র মেয়ে আমাদের। তাই আদরের কন্যাকে নিয়ে সীমাহীন দুঃচিন্তা তাঁর। শুধু ঠিকানার কথা ভেবে কষ্ট পেতো। ওঁর জীবদ্দশায় ওকে আমি আমাদের ঠিকানা নিশ্চিত করে দিতে পারিনি! এ দুঃখ আমাকে সারা জীবন ওর মৃত্যুমুখের যন্ত্রণার মতো কষ্ট দেবে।


লেখক: সাহিত্যিক ও অর্থনীতি বিশ্লেষক

আপনার মন্তব্য

আলোচিত