মিখা পিরেগু

২০ মে, ২০২১ ২২:০৪

রক্তিম সংগ্রামের ঐতিহাসিক বীরত্বগাথা

মুল্লুকে চলো আন্দোলনের শতবর্ষ

আজ মহান চা শ্রমিক দিবস। ১৯২১ সালের এই দিনে চাঁদপুরে মেঘনার তীরে জাহাজঘাটে শ্রমিক ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাযজ্ঞ সংঘঠিত হয়। ব্রিটিশ উপনিবেশ দ্বারা চা শিল্পের গোড়াপত্তনের সময় উনিশ শতকের মাঝামাঝি থেকেই চা এর বাণিজ্যিক উটপাদনের জন্য বিপুল শ্রমিকের চাহিদা দেখা দেয়। কিন্তু স্থানীয় শ্রমিকদের দ্বারা শ্রমঘন এই শিল্প চালু করা সম্ভবপর নয়। তাই ব্রিটিশ সরকার ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দালালদের মাধ্যমে শ্রমিক নিয়ে আসা শুরু করে।

শ্রমিক সংগ্রহের জন্য নির্দিষ্ট কমিশনপ্রাপ্ত দালালরা 'আরকাট্টি' নামে পরিচিত ছিলো। সমগ্র দক্ষিন ভারত, মধ্যপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশ, ঝাড়খন্ড, বিহার, উড়িষ্যাসহ বিভিন্ন অঞ্চলের নিম্নবর্ণের মানুষদের মিথ্যা আশ্বাস আর উন্নত জীবনের নিশ্চয়তা দিয়ে শ্রমিক হিসেবে নিয়ে আসা হয়। এসকল মানুষদের প্রলুব্ধ করতে দালালরা 'গাছ নড়লে টাকা পড়ে' বা 'মাটি খুড়লে সোনা পাওয়া যায়' এরকম নানান বানোয়াট তথ্যদিয়ে প্রলোভনে ফেলে। বিপুল শ্রমিক সংগ্রহের ব্যাবস্থাকে সুসংসত করতে তৎকালীন সরকার ১৮৬৩সালে 'ল্যাবার ইমিগ্রেশন এক্ট' প্রণয়ন করে আর বিভিন্ন সময়ে সেটাকে পরিমার্জনও করে।

শ্রমিকদের ধোকা দিয়ে চা শিল্প শুরুর পর থেকেই বিভিন্ন সময় শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দেয়। দূর্গম পাহাড়ি অঞ্চলে বিষাক্ত সাপ, হিংস্র জন্তু জানোয়ার, প্রাকৃতিক প্রতিকূলতা আর মালিক শ্রেণির নির্যাতন নিত্যসঙ্গী চা শ্রমিকদের। নামমাত্র মজুরিতে সারাদিনের খাটুনিতে একবেলা খাবার জুটতো না, অখাদ্য- কুখাদ্য, অসুখ- বিসুখ আর বন্দীদশায় অপর্যাপ্ত মজুরির পাশাপাশি বাসস্থান, খাবার, স্বাস্থ্য নিরাপত্তাসহ নানামুখি সংকটে জর্জরিত শ্রমিকেরা ক্রমশই বাগান মালিক দ্বারা নিপীড়ন নির্যাতনে অতিষ্ট হয়ে ওঠে।

আসাম লেবার এনকোয়েরি কমিটির ১৯২৯-২১ সালের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ১৯১৭-২০ সময়কালে লক্ষাধিক চা শ্রমিক মৃত্যুবরণ করে। যাদের বেশিরভাগই অপুষ্টিজনিত ও সংক্রামক ব্যাধিতে মারা যায়। এভাবে চা বাগানে শ্রমিকদের বিদ্রোহ প্রকট আকার ধারণ করে। ভারতবর্ষজুড়ে তখন খেলাফত আন্দোলন আর অসহযোগ আন্দোলনের উত্তাপের ঢেউ। মহাত্মা গান্ধীর অনুসারীরা তখন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে জীবনবাজি রেখে। ১৯২০ সালের নানান সময়ে  করিমগঞ্জ, ধলই, কাছাড় ভ্যালি, ব্রক্ষ্মপূত্র ভ্যালি ও সিলেট ভ্যালির বিভিন্ন চা বাগানে অসন্তোষ ব্যাপক আকার ধারণ করে। যার ফলশ্রুতিতে ১৯২১ সালের মে মাসে চা শ্রমিকেরা মুল্লুকে বা নিজ জন্মস্থানেপ যাত্রার ব্যাপারে মনস্থির করে। কিন্তু নির্দয় বাগান মালিকের সাথে যোগসাজশে ব্রিটিশ সরকার রেলযোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। আর কোন উপায় না দেখে মে মাসের ৩ তারিখ প্রায় ত্রিশ হাজারের বেশি চা শ্রমিক রেললাইন ধরেই চাদপুরের মেঘনা ঘাটের উদ্দেশ্যে হাটা শুরু করে।  

তৎকালীন চা শ্রমিক নেতা পন্ডিত গঙ্গাচরণ দীক্ষিত ও পন্ডিত দেওসরন এই ‘মুল্লুকে চল’ আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। চা শ্রমিকদের কেবল ধারণা ছিলো স্টিমারযোগে কলকাতা যাওয়া যায়। এদিকে ২০মে চা শ্রমিকেরা মেঘনা ঘাটে পৌছালে দেখে আসাম রাইফেলসের গোর্খা সৈন্য মোতায়েন করা। পরিশ্রান্ত ও সংক্ষুব্ধ  চা শ্রমিকদের নিবৃত্ত করে ফেরানোর জন্য তৎকালীন অ্যাসিস্ট্যান্ট ডেপুটি কমিশনার মিস্টার কে সি দের নির্দেশ ও তত্ত্বাবধানে গোর্খা সৈন্যরা গুলিবর্ষণ শুরু করে। অসহায় চা শ্রমিকের রক্তে গিয়ে মিশে মেঘনা নদীর জলে। চা বাগানের ব্রিটিশ মালিক এবং তাদের দোসরদের গুলিতে এ দিন প্রাণ হারান কয়েকশ চা শ্রমিক। কারও কারও মতে এই সংখ্যা কয়েক হাজার। অজস্র মৃতদেহ ভেসে যায় মেঘনার বুকে। যার মাধ্যমে সংঘটিত হয় ইতিহাসের নির্মমতম শ্রমিক হত্যাযজ্ঞ।  

এই বর্বরোচিত হত্যার পর স্টিমার শ্রমিক, রেল শ্রমিক এবং পুরো আসাম ও পূর্বে বাংলার চা শ্রমিকরা একযোগে ধর্মঘট শুরু করে শ্রমিক হত্যার প্রতিবাদ অব্যাহত রাখেন। মহাত্মা গান্ধী, মাওলানা মোহাম্মদ আলী, চিত্তরঞ্জন দাস, নেতাজী সুবাস চন্দ্র বসুর মতো জাতীয় পর্যায়ের নেতারা ছুটে আসেন চাঁদপুর। চাঁদপুরে চা শ্রমিকদের এই আত্মত্যাগের মধ্য দিয়েই ভারতবর্ষের স্বাধীনতা ও ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান ত্বরান্বিত হয়। আর ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের ভিত রচিত হয়। চা বাগানের প্রেক্ষাপটে মুলকরাজ আনন্দের ১৯৩৭ সালে প্রকাশিত চাঞ্চল্যকর উপন্যাস 'টু বাডস এন্ড এ লিফ' এ বাগান মালিকদের অমানবিক অত্যাচারের চিত্র পরিস্ফুটিত হয়েছে।

তবে এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে চা শিল্প হল উপনিবেশবাদের ফলাফল। একে বরাবরই টি এস্টেট বলা হয়েছে।  কাজেই বাগান মালিকেরা ঔপনিবেশিক শাসকের ন্যায় শোষণ নিপীড়ন অব্যাহত রেখে চলেছে এবং ঐতিহাসিক ভাবেই মালিকপক্ষ রাষ্ট্রের সাথে অনেক নিবিড়ভাবে সম্পর্কযুক্ত। স্বাধীনতার পূর্ব ও পরবর্তী উভয় সময়েই মালিকপক্ষ রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদে চা শ্রমিকদের মজুরি সবচেয়ে কম রাখার প্রচেষ্টা করেই চলেছে। ফলত চা মালিকরা শুরু থেকেই চা বাগানে এমন পরিকাঠামো গড়ে তুলেছে যা হল সভ্যতার একেবারে বাইরে এক অন্ধকারচ্ছন্ন দ্বীপ। সাম্প্রতিক সময়ে কালিটি চা বাগানের বকেয়া মজুরির আন্দোলন কিংবা রেমা চা বাগানের বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাগান মালিকদের আচরণে এটা আরো পরিষ্কারভাবে প্রতীয়মান হয়েছে।

শতাব্দি পেরোলেও যে অধিকার রক্ষার জন্য চা শ্রমিকদের ঐতিহাসিক আত্মত্যাগের দুখঃগাথা রচিত হয়েছে তার বাস্তবায়ন আজও হয়নি। বছরের পর বছর কেবল বাগান মালিক নয় খোদ চা শ্রমিক ইউনিয়নের দ্বারাও শোষণ নিপীড়নের স্বীকার হচ্ছে চা শ্রমিকেরা। নামমাত্র মজুরির পাশাপাশি নূন্যতম মৌলিক অধিকার বরাবরই অধরায় থেকেছে চা শ্রমিকদের জন্য৷ তাই বলা যায় চা শ্রমিকদের অধিকার আজও প্রতিষ্ঠিত হয় নি। এমনকি চা শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন করার স্বাধীনতাকেও অবাস্তবিক শর্ত দ্বারা হরণ করা হয়েছে। একমাত্র চা শিল্পেই নজিরবিহীনভাবে একটি মাত্র ট্রেড ইউনিয়ন রয়েছে। চা শ্রমিকদের একমাত্র ট্রেড ইউনিয়ন চা শ্রমিক ইউনিয়ন দীর্ঘদিন যাবত সরকার ও বাগান ইজারাদারদের লেজুরবৃত্তিক সংগঠনে পরিনত হয়েছে। এরুপ পরিস্থিতিতে চা শ্রমিকদের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন করার মত ভিন্ন কোনো ট্রেড করার সুযোগও সুক্ষভাবে কেড়ে নেওয়া হয়েছে।

ফলে এই ভোগবাদী সমাজব্যাবস্থার পুজিবাদী মনোভাব চা শ্রমিকদের জীবন চা গাছের ন্যায় বনসাই করে রাখছে। চা শ্রমিকদের অমানবিক পরিশ্রমে ক্রমান্বয়ে চা শিল্পের বিকাশ ঘটেছে যার দরুন চা উৎপাদনের নতুন রেকর্ড গড়ে জিডিপিতে উল্লেখযোগ্য অবদানের পাশাপাশি রপ্তানীমুখি শিল্প হিসেবে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে অগ্রণী ভূমিকা রাখছে কিন্তু  দুষ্টচক্রে বাধা চা শ্রমিকদের জীবনের উন্নয়ন আর হয় না।

শ্রম আইনের ব্যাত্যয় ঘটিয়ে চা জনগোষ্ঠীকে বাসস্থান, স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা শিক্ষার অধিকার থেকে দূরে রেখেই বাগান পরিচালনা করছে মালিকেরা আর সরকারের এ ব্যাপারে তো কোনো ভ্রুক্ষেপই নেই। এতেই বোঝা যায় মুনাফালোভী বাগান মালিক আর রাষ্ট্রব্যাবস্থা একে অপরের সাথে নিবিড়ভাবে সম্পর্কযুক্ত।

আজ ১০০ বছর পরেও চা শ্রমিকদের মুল্লুকে চলো আন্দোলনের আবেদন বার বার তাৎপর্যমন্ডিত হয়ে ফিরে ফিরে আসছে। চা শ্রমিকদের বিভিন্ন ভাষা-সংস্কৃতি ও জাতিস্বত্তার মর্যাদা নিশ্চিত না করে হুমকির মুখে ফেলা হয়েছে তাদের বৈচিত্রময় জীবন ধারাকে।  অবৈধ চুক্তির মাধ্যমে নির্ধারিত চা শ্রমিকদের অসম মজুরি ব্যাবস্থা অদ্যাবধি আইনগতভাবে নূন্যতম মজুরি বোর্ড দ্বারা নির্দিষ্ট করা হয়নি।

ফলে চা শ্রমিকদের শ্রমের বিনিময়ে ন্যায্য মজুরির নিশ্চয়তা এই রাষ্ট্র নির্ধারন করে দিতে পারেনি। বিকল্প ট্রেড ইউনিয়ন করার স্বাধীনতা না থাকায় বলা যায় চা শ্রমিকদের মানবাধিকারও নিশ্চিত হয় নি চা শ্রমিকদের ভূমির অধিকার না থাকায় বাগান মালিকেরা একুশ শতকের জমিদার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। হাজার হাজার চা শ্রমিকের বলিদানের পর আজ তার শতবর্ষ অতিক্রম করলেও এই রাষ্ট্র তাদের জীবনের মর্যাদা দেয় নাই। মুল্লুক চলো আন্দোলনের শতবর্ষপূর্তিতে  মহান চা শ্রমিক দিবস হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি চাই। শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় মহান চা শ্রমিক দিবস চির ভাস্বর হয়ে থাকুক। চা শ্রমিক দিবসের সংগ্রামের চেতনায় বারবার অধিকার রক্ষার লড়াইয়ে চা শ্রমিকেরা পুনর্জীবিত আর উদ্দীপ্ত হোক এই প্রত্যাশা রাখি।


মিখা পিরেগু: সাংগঠনিক সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, কেন্দ্রীয় সংসদ।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত