মেহজাবিন মাশরাহ্

২৫ জুন, ২০২৩ ২০:৫৬

শিশু-অধিকার ব্যাহত হচ্ছে পরিবার থেকে

শিক্ষিত পরিবারের মেয়ে স্নেহা (ছদ্মনাম)। অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে সে। গায়ের রঙ শ্যামলা। কিন্তু তার বড় দুই বোন ধবধবে সাদা। তার গায়ের রঙের কারণে আশপাশের সকলের কাছে তার অনেক কথা শুনতে হয়। সবচেয়ে বেশি কথা শুনতে হয় তার নিজের পরিবারের লোকজনের কাছ থেকে। পরিবারের সবাই ডাইনিং টেবিলে খেতে বসলে অন্য কথার ফাঁকে স্নেহার রঙ নিয়ে ঠাট্টা করে। দুই বোন তাকে কালি, ব্ল্যাক ডায়মন্ড ইত্যাদি নামে ডাকে। তার মা মানুষের কাছে বলেন, "আমার মেয়ের চেহারার গঠন সুন্দর কিন্তু কালো"।

আত্মীয়রা তাকে বিভিন্ন রঙ ফর্সাকারী ক্রিম মাখার পরামর্শ দেন। তাদের এরূপ আচরণের ফলে সে সবসময় লোকচক্ষুর আড়ালে থাকতে চায় এবং পরিবারের ও আত্মীয়স্বজনের সাথে কথা বলতে চায় না। বাসায় মেহমান আসলে এসব কথা শোনার ভয়ে তাদের সঙ্গে দেখা করতে চায় না। ছবি তুলতে চায় না। তাই তার মা তাকে বকাঝকা করেন। শাস্তিস্বরূপ তার বাবা তাকে তার বন্ধুদের সাথে মিশতে নিষেধ করেন। যে কারণে সে আরও বিষণ্ণ হয়ে পড়ে এবং একা অনুভব করতে শুরু করে। এক এক পর্যায়ে সে মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে ও পরিবারের সকলের সাথে অনিচ্ছাকৃতভাবে খারাপ ব্যবহার করে।

শিশুদের শারীরিক নির্যাতন প্রতিরোধে মাঝে মাঝে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হলেও উপরিল্লিখিত মানসিক নির্যাতন নিয়ে কেউ কথা বলেন না। অথচ এরকম ঘটনা আমাদের চারপাশে অহরহর ঘটছে। কিন্তু শিশুদের মানসিক নির্যাতন প্রতিরোধে নেই কোনো উদ্যোগ।

প্রতি শিশুরই খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষা, বাসস্থান, চিকিৎসার পাশাপাশি সকল প্রকার নির্যাতন (শারীরিক, মানসিক, যৌন নির্যাতন) থেকে রক্ষা পাওয়ার অধিকার আছে। কিন্তু শিশুদের নিরাপত্তা নিশ্চিতকারী পরিবারই যখন নির্যাতনকারীর ভূমিকায় থাকে তখন এর প্রতিকার কীভাবে হবে?

কখনো জেনে আবার কখনো না জেনে অভিভাবকেরা তাদের সন্তানদের নির্যাতন করছেন। অভিভাবকদের সামান্য গালাগালি, মারধর শিশুর সুষ্ঠু বিকাশে মারাত্মকভাবে প্রভাব ফেলে। অথচ অধিকাংশ অভিভাবকদেরই এ বিষয়ে স্পষ্ট ধারণাই নেই। শিশু অধিকার লঙ্ঘনের অন্যান্য ক্ষেত্ৰ পাঠ্যবইয়ে থাকলেও এ বিষয়টি এখন পর্যন্ত লোকচক্ষুর আড়ালে রয়ে গেছে। যার ফলে শিশু কিশোররাও এ বিষয়ে জানে না।

সন্তানকে গালাগালি, মারধর, শাস্তি প্রদান করাকে অভিভাবকেরা "শাসন" বলে থাকেন। তাদের মতে শাসন না করলে বাচ্চারা ভুল পথে যায় এবং তাদের সুন্দর ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতেই তারা সন্তানদের শাসন করেন। প্রকৃতপক্ষে এরূপ আচরণের ফলে শিশুরা নানান মানসিক ও শারীরিক জটিলতায় ভুগছে। শিশুরা নিজের চেহারা, গুণ, শারীরিক গঠন নিয়ে আত্মবিশ্বাসের অভাব অনুভব করার পেছনে পরিবারের সদস্যরা দায়ী। পরিবারকে সবচেয়ে আপন ও নিরাপদ স্থান বলা হলেও এই পরিবারের সদস্যরাই শিশুদের ভয় দেখাচ্ছে, ঠাট্টা করছে, শারীরিক ত্রুটি নিয়ে মজা করছে, মারধর করছে। দেখা যাচ্ছে আপনজনেরাই শিশুদের মানসিকভাবে নির্যাতন করছে। যার ফলে শিশুদের মনে ঘৃণা ও রাগ জন্মায়। মূলত এসব কারণেই এই শিশুরা বড় হয়ে অমানবিক ও অসামাজিক হয়। এর পিছনে পরিবারের লোকজন ও আশেপাশের মানুষ দায়ী হলেও এর সম্পূর্ণ দোষ সন্তানের উপরই চাপিয়ে দেয়া হয়।

"মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন” নামক একটি সংগঠন ২০২০ সালের জুন থেকে ২০২১ সালের মে মাস পর্যন্ত দেশের ১১টি জেলায় মোট পাঁচ হাজার ৭৪ জন শিশুর উপর একটি জরিপ করে। জরিপে অংশ নেয়া শিশুদের মধ্যে তিন হাজার ১৩৪ জন শহরের এবং এক হাজার ৯৪০ জন গ্রামের। জরিপে অংশ নেওয়া শিশুদের মধ্যে শিক্ষার্থী ছাড়াও কর্মজীবী শিশুও ছিল। তাদের মধ্যে ৯৫.৩ ভাগ শিশু জানিয়েছে তারা ঘরে-বাইরে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বা কর্মক্ষেত্রে নির্যাতনের শিকার হয়েছে। তাদের মধ্যে ৯৫.৮ ভাগ নিজেদের ঘরে বাবা- মা ও আত্মীয় স্বজনের হাতে এবং শতকরা ৮২ ভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নির্যাতনের শিকার হওয়ার কথা বলেছে।

যেহেতু নিজ ঘরে বাবা মায়ের কাছেই শিশুরা নির্যাতিত হচ্ছে সেহেতু সরকার বা নীতিনির্ধারকদের এখন নতুনভাবে চিন্তা করতে হবে এ ব্যাপারে। সুন্দর ও সুস্থ ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে শিশুদের সাথে বন্ধুসুলভ আচরণ করতে হবে। অভিভাবকদের আরও দায়িত্বশীল আচরণ করতে ও শিশুদের নির্যাতন না করে শিশুর বিকাশের সকল বিষয় নিয়ে স্পষ্ট ধারনা দেওয়া ও খোলামেলা আলোচনা করা কীভাবে সৃজনশীলভাবে বুঝানো যায় সে ব্যাপারে সচেতন করতে হবে।

  • মেহজাবিন মাশরাহ্: শিক্ষার্থী, নবম শ্রেণি, হবিগঞ্জ রেসিডেন্সিয়াল স্কুল এন্ড কলেজ।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত