তুষার গায়েন

২৯ মার্চ, ২০২৪ ০২:০৩

ভেকধারী ধর্মানুভূতির কাছে জাতির এ কোন জিম্মিদশা

বাংলাদেশের ম্যাজিক রিয়ালিজম হচ্ছে বহুকাল ধরে ভেকধারী ধর্মানুভূতির কাছে পুরো জাতির জিম্মি হয়ে যাওয়া। সবাই জানে এই ধর্মানুভূতির কার্ড একটা বিশেষ ধর্মব্যবসায়ী গোষ্ঠির পাতানো খেলা যারা বাংলাদেশের অস্তিত্বে বিশ্বাসী নয়, যারা হাজার বছর ধরে গড়ে ওঠা বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে ধ্বংস করতে তৎপর এবং যারা সংখ্যালঘু ধর্ম সম্প্রদায়সহ মুক্তচিন্তার মানুষদের বিরুদ্ধে সংহারী ভূমিকায় অবতীর্ণ।

যারা ধর্ম ব্যবসা ও নির্দিষ্ট রাজনৈতিক লক্ষ্য পূরণের জন্য এসব করছে তাদের ব্যাপারটা বোধগম্য, কারণ তারা কখনো তাদের উদ্দেশ্য মানুষের কাছে গোপন করেনি। কিন্তু যারা এই প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির বিরুদ্ধে রাজনীতি ও আন্দোলন-সংগ্রাম করে অনেক মানুষের রক্ত, মেধা ও সৃষ্টিশীলতার বিনিময়ে ক্ষমতারোহন করেছেন, তারা যখন ঐ প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির ধর্মানুভূতি নামক জুজুর কাছে আত্মসমর্পণ করে অথবা ক্ষমতার স্বার্থে নিজেরাই সেই কার্ড ব্যবহার করে, তখন তার বিচার কী হতে পারে?

একটা দেশে যার যা ধর্ম সে তা পালন করবে, কিন্তু তার সাথে গান-বাজনা, শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার বিরোধ কোথায়? ধর্ম পালনের উদ্দেশ্য যদি হয় স্রষ্টার সাথে সৃষ্টির (মানুষের) আত্মিক সংযোগ স্থাপন, স্রষ্টার কাছে আত্মসমর্পণ ও আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে সুন্দর ও ভারসাম্যময় জীবন যাপন, তাহলে তাঁর কাছে পৌঁছাবার পথ মাত্র একটা হতে পারে না। স্রষ্টা নিজেই বৈচিত্র্যময় সেটা তাঁর বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডের দিকে তাকালেই বোঝা যায়, তাই তাঁর সাথে সংযোগ স্থাপনের পথও বিচিত্র ও বিভিন্ন হবে, এটাই স্বাভাবিক। না হলে এত ধর্ম, এত মত, পথ ও দর্শনের সৃষ্টি হতো না।

বাংলার বাউলরা আধ্যাত্মিক সাধক যারা স্রষ্টার সন্ধান ও আত্মিক সংযোগের অভিজ্ঞতাকে সংগীতের মাধ্যমে প্রকাশ করেন। লালন সাঁইজি বাউল শিরোমণি ও সমন্বয়বাদী বাঙালি সংস্কৃতির আইকন। তাহলে রমজান মাসের পবিত্রতা রক্ষার নামে বহুকাল ধরে চলে আসা লালন উৎসব বন্ধ করার এখতিয়ার কে দিয়েছে ধর্মব্যবসায়ী এবং তাদের মনরক্ষা করে চলা বর্তমান সরকারকে যারা কিনা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলে অহরহ মুখে ফেনা তোলে? এই ইস্যুতে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের কোনো প্রতিবাদ নেই কেন? তারা তো দেশের বিভিন্ন ক্রান্তিলগ্নে ও সংস্কৃতির সংকটে পথে নামেন, প্রতিবাদ করেন।

এই লালন উৎসব যদি বিএনপি-জামায়াতের আমলে বন্ধ করা হতো, তাহলে সেটা কি বিনা প্রতিবাদে পার পেত? তখন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট যে রাজপথে নামত এবং প্রগতিশীল লেখক, কবি, বুদ্ধিজীবী ও সংস্কৃতিকর্মীরা এর পিছনে থাকত, এতে কি কোনো সন্দেহ আছে? যে-কাজ বিএনপি-জামায়াতের আমলে হলে নিন্দনীয়, সে-কাজ কি আওয়ামী লীগের আমলে প্ৰশংসনীয় হতে পারে? কী কারণে কাউকে কৌশলগত ছাড়পত্র দিতে হবে যখন তারা উভয়েই মৌলবাদকে তোষণ করে চলে?

অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, যারা দেশে অতি লালন উৎসাহী এবং লালনকে প্রায় ধর্ম বানিয়ে ফেলেছে তাদের দিক থেকেও কোনো প্রতিবাদ নেই। যারা মনে করেন রবীন্দ্রনাথ লালনের পায়ের কাছে বসারও যোগ্য নন, রবীন্দ্রনাথকে ছোট করার জন্য লালনকে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দাঁড় করাবার চেষ্টা করেন, অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতিসত্তার সংগ্রামকে নস্যাৎ করার জন্য লালনকে ভাবান্দোলনের নেতা বানিয়ে তাঁর পিছনে কাফেলায় দাঁড়িয়ে যান এবং যেকোনো মূল্যে আওয়ামীলীগকে ক্ষমতাচ্যুত করতে জান পেহচান করেন—তারা কেন এই ইস্যুতে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে একটি কথাও বলেন না?

এর আগে যখন ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সামনে মৌলবাদীরা নির্ণীয়মান লালনের ভাস্কর্য ভেঙে ফেলতে সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করেছিল, বিভিন্ন সময়ে তাদের হাতে বাউলরা নির্যাতিত হয়েছিল, তখনও এই ভাবান্দোলনের নেতাদের কোনো টু শব্দ করতে দেখা যায়নি। তার মানেই হচ্ছে লালনপ্রেম তাদের নিছক রাজনৈতিক কৌশল মাত্র।

এ বছর বাংলা নববর্ষ উদযাপনের জন্য চারুকলা আয়োজিত ঐতিহ্যবাহী মঙ্গল শোভাযাত্রার রুট বা যাত্রাপথকে সঙ্কুচিত করা হয়েছে। কাদের নির্দেশে ও কাদের স্বার্থে এটা করা হয়েছে? বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ সাধারণ জনগণ কি এই শোভাযাত্রাকে সংক্ষিপ্ত করার দাবি জানিয়েছে সরকারের কাছে? বাংলাদেশের গ্রামে-গঞ্জে লোকায়ত সংস্কৃতির গলা টিপে মারার পর এখন শহর ও রাজধানীর দিকে হাত বাড়িয়েছে মৌলবাদীরা। গ্রামে যাত্রাপালা, জারি-সারির আসর, বাউল গান ইত্যাদি বন্ধ করে সেখানে ওয়াজের একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে কাদের স্বার্থে?

এবছর স্বাধীনতা দিবসের উদযাপনও ছিল ম্লান ও উৎসবহীন এবং সেটা নাকি করা হয়েছে রমজানের পবিত্রতা রক্ষার নামে। স্বাধীনতা দিবসের বর্ণিল ও উচ্ছ্বাসপূর্ণ উদযাপনের সাথে ধর্মানুভূতির কী বিরোধ? একটা জাতির রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অর্জিত দেশের স্বাধীনতা কি আরোপিত ধর্মানুভূতির কাছে বন্দি? রমজানে ধর্মানুভূতি রক্ষার জন্য সংস্কৃতি দমন করতে পারেন, কিন্তু অসাধু ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট ভেঙে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ করতে পারেন না।

ধর্মানুভূতি এতই প্রখর যে একজন বৃদ্ধা হিন্দু নারীকে পান খেতে দেখে রোজার সংযম নষ্ট হয়ে যায় এবং ঐ বৃদ্ধাকে পিটিয়ে জখম করতে হয়? তার গলায় পা চাপা দিয়ে হত্যা করতে উদ্যত হতে হয়? যিনি এসব করলেন, তিনি নাকি স্কুলের শিক্ষক ও মুক্তিযোদ্ধা। এই কি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা? এর জন্য কি বাংলাদেশের সব ধর্মের মানুষ জান বাজি রেখে যুদ্ধ করেছিল? আপনার ধর্মের অনুশাসন কি অন্য ধর্মের মানুষ পালন করতে বাধ্য? তাহলে ধর্মরাষ্ট্র পাকিস্তান ভেঙে, ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ সৃষ্টির কী প্রয়োজন ছিল?

বাংলাদেশের উদ্ভব হয়েছে ভাষা আন্দোলন ও তার ধারাবাহিকতায় সাংস্কৃতিক আত্মনিয়ন্ত্রণ এবং অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রামে বাঙালির আত্মবলিদানে। চার বার ক্ষমতায় আসীন থেকেও যদি মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগ তার ঐতিহাসিক অঙ্গীকার ও দায়িত্ব পালন না করে এবং কিছু বাহ্যিক উন্নয়নের আত্মগরিমায় ভুগে, জাতির সাংস্কৃতিক ও মননগত উন্নয়নে অনীহা প্রদর্শন করে, তাহলে তার বিষময় ফলও তাদের অচিরেই ভোগ করতে হবে। শত্রু চুপচাপ ঘরে বসে নেই!

  • তুষার গায়েন: কবি।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত