১০ এপ্রিল, ২০২৪ ২৩:০৫
সকলকে পবিত্র ঈদ উল ফিতরের শুভেচ্ছা। আজকের লেখার বিষয়টির একটা বিশেষ উদ্দেশ্য হল, আমরা মুসলমান ও অমুসলমানরা কতটুকু কাছের, কতটুকু দূরের, কতটুকুই বা পরষ্পরের তা নিয়ে একটু চিন্তা করার।
পবিত্র ঈদ উল ফিতর মূলত মুসলমান সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসব হলেও বিশ্বায়ন ও আধুনিক বিশ্বের কর্পোরেট যুগে তা মুসলমান অমুসলমান নির্বিশেষে পৃথিবীর অনেক লোকের উৎসবে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে অমুসলমানের ঈদ নিয়ে কথা বলতে গেলে এই ভূখণ্ডের দুটি প্রধান সম্প্রদায় হিন্দু ও মুসলমানদের সহাবস্থান ও কাল পরিক্রমায় তাঁদের সম্পর্কের উত্থান পতন, মান অভিমান সবকিছুই আসে।
মূল কথা, বাংলাদেশে তথা এই ভারতীয় উপমহাদেশে যুগ যুগ ধরেই হিন্দু ও মুসলমান দুই সম্প্রদায়ের লোক শান্তিপূর্ণ পরিবেশেই পরষ্পরের প্রতি বিশ্বাস, ভরসা, শ্রদ্ধা নিয়েই বসবাস করছে। যুগ যুগ ধরে হিন্দু মুসলমানের সম্পর্ক স্তরে স্তরে ভালো ছিল, উন্নত ছিল্ যেমন রাজায়-রাজায়, জমিদারে-জমিদারে, গেলাসে-গেলাসে, সাধারণে-সাধারণে। হিন্দু-মুসলমান জমিদার নির্বিশেষে প্রজাসাধারণও নির্যাতিত ছিল, সে প্রজা হিন্দু হোক বা মুসলমান হোক। এখানে জমিদারের ক্যাপাসিটি হিন্দু বা মুসলমান নয়, জমিদারের ক্যাপাসিটি। সমাজে প্রজাবান্ধব জমিদার যে ছিলেন না, তাও নয় তবে হাতেগোনা। দেশ ও সমাজের মূল চালিকাশক্তি সাধারণ জনগণ বরাবর অসাম্প্রদায়িক।
দুই সম্প্রদায়ের লোকের ওপরই সাম্প্রদায়িকতার অভিযোগ আছে। তবে সাম্প্রদায়িকতার কভারে যতকিছু চলে সব কিন্তু সাম্প্রদায়িকতা নয়। ভূমির প্রতি লোভ, দোকানের প্রতি লোভ, পদের প্রতি লোভ, নারীর প্রতি লোভ, মাছ, বালু, বাঁশ মহালের প্রতি লোভ, পেশাগত ঈর্ষা ইত্যাকার বিষয় সাম্প্রদায়িকতার মধ্যে পড়ে না সেগুলো যেই করুক না কেন। এগুলোতে সন্ত্রাসের ব্যবহার থাকলে ব্যবহারকারীরা ব্যক্তির ক্যাপাসিটিতে সন্ত্রাসী হতে পারে, সাম্প্রদায়িক নয়।
সাম্প্রদায়িকতা হচ্ছে কোনও বৈষয়িক লাভালাভ ছাড়া কোনও জাতি, সম্প্রদায় বা গোষ্ঠীর প্রতি অন্য কোনও জাতি, সম্প্রদায় বা গোষ্ঠীর যে বিদ্বেষ, ঘৃণা, স্নায়ুর চাপ উৎসারিত হয় তা। এটা যে নেই বাংলাদেশে তাও নয়। বাংলাদেশে আছে, ভারতে আছে, হিন্দুর মধ্যে আছে, মুসলমানদের মধ্যে আছে। তবে যেগুলো আছে সেগুলো পরিমাণে নিতান্তই কম। যাঁরা চর্চা করেন তাঁরাও সংখ্যায় কম। যতটুকু নিরেট সাম্প্রদায়িকতা আছে, যেখানেই আছে, যতটুকু আছে সেটা অপরকে ভালোভাবে না জানার কারণে উদ্ভুত। জ্ঞান, বিজ্ঞান, ইতিহাস, দর্শন, স্থাপত্যকলা, ক্যালিগ্রাফিসহ বিভিন্ন বিষয়ে, মানব সভ্যতার বিকাশে উভয় সম্প্রদায়ের পণ্ডিতদের, জ্ঞানীদের অবদান আছে। শিক্ষাবান্ধব সমাজের অনুপস্থিতিতে এগুলো উপলব্ধি করা কঠিন। দুচারজন বিচ্যূত ব্যক্তি যেকোনও সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি হতে পারেন না ভাবনায়, বিচারে বা আচারে।
দুই দেশের সাধারণ মানুষ মানবিক গুণে অনেক এগিয়ে । আমার দেখা অনেক অভিজ্ঞতার একটার কথা বলি। আমাদের পাশের পাতন গ্রামের বনমালীদার (বনমালী চন্দ, পেশা চুল কাটা, নরসুন্দর/ চন্দ্রবৈদ্য) ঘনিষ্ঠ বন্ধু বশির মিয়া মুহরির (গ্রাম্য ভাষায় মরীর/ মরীব) সাথে বহুমাত্রিক সম্পর্ক ছিল। দুই গৃহকর্তা পরস্পর বন্ধু বা ইয়ার, দুই বাড়ির মহিলারা পরস্পর বান্ধবী, বনমালী দা ও বশির মিয়ার মেয়েরা সই বা সখী, তাঁদের ছেলেরা পরষ্পরের ইয়ার। এক বাড়ির কান্নায় অন্য বাড়ির মাটির দেয়াল কেঁপে ওঠে। এক বাড়ির হাসি-ঠাট্টায় অন্য বাড়ির সদস্যরা মেতে ওঠেন। বনমালীদা ও বশির মিয়ার এক সাথে বাজারে যাওয়া, বাজার থেকে ফেরা, শহরে যাওয়া, সেখান থেকে ফেরা।
আমাদের সমাজে বিশেষ করে প্রান্তবর্তী পরিমণ্ডলে হাজার হাজার বনমালীদা ও বশির মিয়া রয়েছেন। মাঝে মধ্যে দুচারজন ‘বাওটা’ হিন্দু বা মুসলমানের জন্য আমাদের ঐতিহ্যবাহী সম্প্রীতি বিপন্ন হয়। সব জায়গাতেই একই পরিস্থিতি বিরাজমান। এর বাইরে বৈশ্বিক, আঞ্চলিক, উপ-আঞ্চলিক মতলবি রাজনীতির পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার তাপ। আরেকটি বিষয় হল, বাংলাদেশে মুসলমানের সংখ্যা বেশি। স্বাভাবিকভাবে এই সম্প্রদায়ে সবই বেশি- চোর, ডাকাত, মোল্লা, মুনশী, সাম্প্রদায়িক, অসাম্প্রদায়িক, ভালো লোক, ভদ্রলোক, প্রগতিশীল লোক সবই বেশি বেশি। এই মেশে হিন্দুর সংখ্যা কম, তাই চোরও কম, পীরও কম, সাম্প্রদায়িক লোক যেভাবে কম, অসাম্প্রদায়িক লোকও কম। ভারতে একই ব্যাকরণ। ব্যক্তির বিচ্যূতির দায় গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের ওপর বর্তানো যায় না। অনেক সময় শোনা যায়, মন্দিরের পূজারী নারী নির্যাতনে জড়িত বা মসজিদের ইমাম ফ্যান চুরির দায়ে অভিযুক্ত। ভালো করে চিন্তা করলে দেখা যাবে, পূজারী বা ইমাম নারী নির্যাতকও নন, ইমাম চোরও নন। আসলে, নারী নির্যাতক পূজারী হয়েছেন, চোর হয়েছেন ইমাম। সেই আবার ক্যাপাসিটির কথা। কোন কাজ কে কোন ক্যাপাসিটিতে করছেন সেটা বিবেচ্য বিষয়।
ঈদ মুসলমান সম্প্রদায়ের সমার্থক একটি উপলক্ষ্য অমুসলমানদের হৃদয়েও একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে। উৎসবে তাদের অংশগ্রহণ নিছক সহনশীলতার পরিচায়ক নয় বরং প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে গড়ে ওঠা বন্ধুত্ব ও সংহতির গভীর শিকড়ের বন্ধনের এক বিশেষ প্রমাণ। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে অসংখ্য উদাহরণ দিতে পারি যে সকল পরিস্থিতি ও পরিপ্রেক্ষিত পবিত্র ঈদের মতো উপলক্ষ্যকে একটি ঐক্যবদ্ধ শক্তিতে পরিণত করে, বিভিন্ন প্রেক্ষাপটের মানুষকে আনন্দ উদযাপনে করে একত্রিত।
বাংলাদেশে ঈদের ইতিহাস অসাম্প্রদায়িক সহাবস্থান এবং শুভেচ্ছার উত্তরাধিকারের সাথে জড়িত যা আমাদের জাতির পরিচয়কে রূপ দিয়েছে। আমাদের স্বাধীনতার প্রথম দিন থেকেই প্রতিষ্ঠাতারা এমন একটি সমাজের কল্পনা করেছিলেন যেখানে সকল ধর্মের মানুষ শান্তি ও সম্প্রীতির সাথে পাশাপাশি বসবাস করতে পারে। এই দৃষ্টিভঙ্গি একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক সংস্কৃতির ভিত্তি স্থাপন করেছিল যেখানে ঈদ একটি যৌথ উদযাপনে পরিণত হয়েছিল, ধর্মীয় সীমানা অতিক্রম করে এবং পারস্পরিক সম্মান বৃদ্ধি করে।
বাংলাদেশের প্রাণবন্ত সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে ঈদ ধর্মের সীমানা অতিক্রম করে সকলকে সম্পৃক্ত করে । যাঁরা এর আনন্দ উৎসবে অংশ নিতে চান তাঁরা চেতনাবোধে অভিন্ন। অমুসলমানরা সাগ্রহে তাঁদের মুসলমান ভাই ও বোনদের সাথে শুভেচ্ছা বিনিময়, খাবার ভাগাভাগি এবং একে অপরের প্রতি সদয় আচরণের জন্য যোগ দেন। ঈদের চেতনা আমাদের সমাজের প্রতিটি কোণে ছড়িয়ে পড়ে, মানবতার একটি সাধারণ উদযাপনে বিভিন্ন পটভূমির ব্যক্তিদের একত্রিত করে।
যাইহোক, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পটভূমির মধ্যে একটি প্রখর বাস্তবতা রয়েছে - বিশ্বব্যাপী সাম্প্রদায়িকতার উন্মোচিত আভা। আজকের আন্তঃসংযুক্ত বিশ্বে, যেখানে রাজনীতি প্রায়শই ধর্মীয় পার্থক্যকে ঘৃণ্য উদ্দেশ্যে কাজে লাগায়, সহনশীলতা এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধার নীতিগুলো ক্রমাগত হুমকির মধ্যে রয়েছে। সারা পৃথিবী জুড়েই আমরা বিভেদমূলক মতাদর্শের উত্থান প্রত্যক্ষ করি যা বিরোধের বীজ বপন করতে এবং বহুত্ববাদী সমাজের কাঠামোকে দুর্বল করতে চায়।
বৈশ্বিক সাম্প্রদায়িকতার এই যুগে, ঈদ উদযাপন অসহিষ্ণুতা ও ঘৃণার শক্তির বিরুদ্ধে আশা ও উদ্দীপনার আলোকবর্তিকা হিসেবে অতিরিক্ত তাৎপর্য বহন করে। যখন আমরা এই শুভ উপলক্ষ্যকে পালন করার জন্য একত্রিত হই, আমাদের অবশ্যই অন্তর্ভুক্তি এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধার মূল্যবোধকে সমুন্নত রাখার জন্য আমাদের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করতে হবে যা আমাদের ভাগ করা মানবতাবোধের কেন্দ্রস্থলে সমুন্নত রয়েছে। একইসাথে, আমাদের অবশ্যই আমাদের বিচ্ছিন্ন করতে চায় এমন বিভাজনমূলক বাগ্মিতাকে প্রত্যাখ্যান করে ধর্মনিরপেক্ষ সহাবস্থানের রক্ষী হিসেবে দাঁড়াতে হবে।
উপসংহারে বলা যায়, বাংলাদেশে অমুসলমানদের ঈদ নিছক ধর্মীয় উৎসবের উদযাপন নয় বরং আমাদের জাতিকে সংজ্ঞায়িত করে পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ব ও ঐতিহাসিক তাৎপর্যের স্থায়ী চেতনার প্রমাণ। আমরা যখন ক্রমবর্ধমান মেরুকৃত বিশ্বের জটিলতাগুলোর সম্মুখীন হই, তখন আমাদের পূর্বপুরুষদের দ্বারা উল্লিখিত উদাহরণ থেকে অনুপ্রেরণা গ্রহণ করি - বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের উত্তরাধিকার যা আমাদের সামনের পথকে আলোকিত করে চলেছে। আসুন আমরা একসাথে আশা, উদ্দীপনা ও সংহতির আলোকবর্তিকা হিসেবে দাঁড়াই, ভবিষ্যতের প্রতি আমাদের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করি যেখানে ঈদ শান্তি ও শুভেচ্ছার বার্তা গ্রহণ করতে চায় এমন সকলের উদযাপন।
লেখক পরিচিতি : ডেপুটি রেজিস্ট্রার, মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটি, সিলেট এবং লেখক, অনুবাদক ও নির্বাহী প্রধান, টেগোর সেন্টার, সিলেট।
আপনার মন্তব্য