নিরঞ্জন দে

১৭ এপ্রিল, ২০২৪ ১৫:১১

বেলা যায়, বহুদূরে পান্থ নিকেতন...

পহেলা বৈশাখ উদযাপন কি একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের বিষয়? না, বাঙালির জাতীয় বিষয়? না, বাষ্পীয়? না, বিজাতীয়? না, আবেগীয়? এটা সর্বজনীন না সংকীর্ণ?

ঘোর ফাইট চলছে! এটা একটা পুরাতন রোগের নতুন ভেরিয়েন্ট - নাম ভাইরালাইটিস!! সবাই কম বেশি এ ভাইরালাইটিসে আক্রান্ত। ভ্যাক্সিন এখনো আসেনি।

১৮ কোটি লোকসংখ্যার দেশে কতো পারসেন্ট মানুষ এসব নিয়ে মাথা ঘামান? কতো পারসেন্ট লোক রমনার বটমূল, মঙ্গল শোভাযাত্রা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, খেলা, মেলা সহ নানা উদযাপনের সাথে যুক্ত? ৬৮০০০ গ্রামের সবগুলোতে এসবের আয়োজন হয়কি এখনো? কিছু কিছু এলাকায় হয়। তাও হাল আমলে কমে আসছে দিন দিন। আমাদের গ্রামগুলো পাল্টে যাচ্ছে। দেশের অধিকাংশ মানুষের সমর্থন আছেকি এসব আয়োজনে?

সরকারী নির্দেশনা থাকায় পহেলা বৈশাখ যে মানে না সেও চাকরি বাঁচাতে তার প্রতিষ্ঠানে নানা আয়োজন করে। শোভাযাত্রা নিয়ে রোদের মধ্যে রাস্তায় হাটে। নানা কর্পোরেট পুঁজি বিনিয়োগ হয় নববর্ষ উদযাপনের নানা আয়োজনে, যুক্ত হয় নানা প্রতিষ্ঠান। ফলে পালে হাওয়া লেগেছে বটে কিন্তু পালের বাঁধনটি নড়বড়ে।

শহরে, গ্রামে, গঞ্জে আজ এতো যে লোকসমাগম বর্ষবরণের নানা আয়োজনে সেটা কতোটা জেনেশুনে বা বুঝে? কতোটা আবেগ এবং ভালোবাসা থেকে? বিশ্বাস থেকে? হয়তো বলবেন, সাধারণ মানুষের কাছে এটা প্রত্যাশা করা ঠিক নয়? আচ্ছা, তাহলে আমরাইবা কতোটা সেরকম? মানলাম, আমরা সবাই সেরকম, জেনেশুনে, বুঝে, বিশ্বাস করে, চেতনার জোরে, আবেগ থেকে এসবে যুক্ত হয়েছি। তাহলে বলুনতো, ১৮ কোটির কতো শতাংশ আমরা? মোট ভোটারের কতো শতাংশ?

দেশের অল্পসংখ্যক মানুষই কবি, সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ, নেতা, বিজ্ঞানী, শিল্পী, মন্ত্রী ইত্যাদি হন। তাঁদের কথা শুনে বা অনুসরণ করেই চলেন গোটা দেশের মানুষ। কিন্তু এখানে যদি সুরটা এক না হয়, ছন্দটা না থাকে, যদি ব্যত্যয় ঘটে তাহলে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে কারা পথ দেখাবেন? সবাই পথপ্রদর্শক হন না। যারা জাতিকে পথ দেখান, নেতৃত্ব দেন তারাই ভালো-মন্দ জানেন, বুঝেন,দূরদৃষ্টি রাখেন। তবে তাদের জনগণের আস্থা অর্জন করতে হয়, গণমানুষের চিন্তা-চেতনার খবরাখবর জানতে হয়। তখনই তারা সমষ্টির প্রতিনিধি হয়ে ওঠেন। এখানে ব্যত্যয় হলেই চোরাবালিতে পা আটকায় সমাজের।

দেশের অধিকাংশ মানুষ কি ভাবছেন? কি তাদের চেতনা ও বিশ্বাস সে খবর কি রাখি আমরা?

নগরাবদ্ধ আমাদের সকল চেতনার আস্ফালন। সুতরাং তাদের উপেক্ষা বা অবজ্ঞা করে, তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে সর্বজনীন উৎসব হয়না, হবেওনা। শহুরে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত মিলে এবং সরকারের সদিচ্ছায় জেলা, উপজেলা, থানা শহর গুলোতে এবং রাজধানী ঢাকায় যে উদযাপন হয় তাতে দেশের আপামর মানুষ বা গণমানুষ বা সাধারণ মানুষের সম্পৃক্ততা কতোটুকু। পেশাগত কারনে কিছু সাধারণ মানুষ এসবে আসেন, তাদের মোট সংখ্যা কতো? রমনার বটমূলে, মঙ্গল শোভাযাত্রায় কারা আসেন? কোন শ্রণির মানুষ? কৃষি নির্ভর সমাজ ব্যবস্থায় কৃষকের সুবিধার্থে এবং জমিদার বা রাজা-বাদশার খাজনা আদায়ের সুবিধার জন্য যে ফসলি সন চালু হয়েছিলো আজ তার উদযাপনের মূল স্রোতে কৃষক-মজুর কোথায়? কোনো আয়োজনে কি তাদের ব্যাপক হারে ডাকা হয়? সভ্যতার এবং অর্থনৈতিক ভিত্তির নির্মাণ হয় যাদের শ্রমে ও ঘামে সেই শ্রমিকরা কোথায়? কয়েক হাজার মানুষের সমাগম কোটি কোটি মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে কি?

বাংলাদেশটাতো অনেক বড়। আমার আঙিনাটাই নয়, আমার মহাসড়কটাই নয়, আমার ক্যাম্পাসটাই নয়। আমার মঞ্চ আর হলটাই নয়। যদিও এক আকাশের নীচে তবুও অসংখ্য ছাদ রয়েছে, ছাতা রয়েছে। সেখানে আস্থার বীজ বপন করিনি আমরা, সময় কেটেছে অনেক। এখন আমরা সর্বজনীন বলে যে তৃপ্তির ঢেকুর তুলি তাতে অম্লের আধিক্য নাকে লাগে।

সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের বিশ্বাস, ভাবনা, অবস্থানকে সম্মান জানাবেন না তাদের উদ্বোধিত করবেন - এটা ভাবার সময় আছে?

১৯৭১ সালের মু্ক্তিযুদ্ধের সময় সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ স্বাধীনতার পক্ষে ছিলো। এখনো সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ যদি মনেকরেন পহেলা বৈশাখ আমাদের উৎসব, এটা সর্বজনীন উৎসব তাহলে আর কেনো দ্বিধা দ্বন্দ্ব থাকেনা। আর যদি উল্টোটা হয় তাহলে মিডিয়ায়, টকশোতে পজেটিভ আলোচনা করে কোনও লাভ হবেনা। পায়ের তলায় মাটি কতোটা আছে সময়ে টের পাওয়া যাবে। মানুষকে যুক্ত করতে নাপারলে সেটাকে কিকরে 'মানুষের উৎসব' বলা যাবে। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ যদি সরে দাঁড়ায় তাহলে এসব উদযাপন করা কি আদৌ সম্ভব হবে? পাহারা দিয়ে, যুদ্ধ সাজে কতোদিন? সুতরাং সংখ্যা গরিষ্ঠ মানুষের কাছে যেতেই হবে এর বিকল্প নেই।

যদি আমরা ভাবি আমরা সঠিক, এসব উদযাপন সঠিক, সাংস্কৃতিক এ যাত্রা সঠিক - তাহলে সমগ্র দেশের মানুষের কাছে যেতে হবে সে বার্তা নিয়ে। সহজ সরল তরল যেভাবেই হোক। হাজার বছরের বাঙালির ভাষা, সংগ্রাম ও সংস্কৃতির যাত্রা নিয়ে নাগরিক বুদ্ধিজীবীর কঠিন কঠিন বক্তব্য - তাদের মন ছুঁয়ে যায়না। তাই তারা যা সহজে বুঝেন সেটা গ্রহণ করছেন প্রতিনিয়ত। সেভাবেই তাদের সম্মিলিত বোধ, চিন্তা-চেতনা তৈরি হচ্ছে। আর আমরা হঠাৎ একদিন ঘুম থেকে উঠে বলছি- দেশে রুচির দুর্ভিক্ষ চলছে!!

হাজার হাজার বা লক্ষ লক্ষ মানুষের অরাজনৈতিক সমাবেশ কি হয়না এদেশে? সেখানে টাকা নিয়ে নয় বরং নিজের টাকা খরচ করেই মানুষ আসে। ওখানে যে মানুষের ঢল নামে এর তুলনায় শহুরে এসব সর্বজনীন উদযাপন কি নগণ্য নয়? বরং ভাবার বিষয় কতোটা নগণ্য।

পহেলা বৈশাখ উদযাপন শুধু সর্বজনীন নয় বহুমাত্রিকও বটে। সামাজিক-সাংস্কৃতিক-ধর্মীয় এসব নানা দিক আছে এতে। প্রথা-প্রচলন-লোকবিশ্বাস আছে। নানা অনুষঙ্গ আছে। এ উপমহাদেশের ইতিহাস জানতে হবে, নিরপেক্ষ ইতিহাস। লোকসমাজ ও লোকবিশ্বাসের বিবর্তন জানতে হবে। একদিনে এসব হয়নি।

সনাতন ধর্মাবলম্বীদের চৈত্র সংক্রান্তি, চড়কপূজা, শিবের গাজন, অষ্টক নাচ, হরগৌরী নাচ, গঙ্গা পূজা, তেঁতো খাওয়া, হলুদ-নিম গায়ে মেখে স্নান করা, গণেশ পূজা, বড়দের বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্রণাম করা, মন্দিরে মন্দিরে গিয়ে হালখাতায় কাঁচাহলুদ আর সিঁদুরের টিকা লাগানো, মিষ্টান্নভোজন -- এসবই তো পহেলা বৈশাখের বা নববর্ষ উৎসবের অবিচ্ছেদ্য অংশ। কিন্তু এটা তো সর্বজনীন বলা হচ্ছেনা। কেউ দাবীও করছেনা। এটি একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য। বাংলা সনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রতি বছর সনাতনী পঞ্জিকা অনুসারে তারা নানা পার্বণ ও সংস্কার পালন করে থাকেন অতি প্রাচীণ কাল থেকেই। তারাও এসব বাদ দিতে পারবেননা। বাঙালির যৌগিক সংস্কৃতির উপাদান এগুলো। বৈসাবি, বিজু, ওয়ানগালা এসবও এখন আমাদেরই উৎসব। যদি মানতে চাইনা তাহলে ভিন্ন কথা।

কিন্তু মুসলমান-হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃষ্টান সহ সকল ধর্ম ও নৃগোষ্ঠীর মানুষকে নিয়ে যে মহামিলনের আয়োজন সেটাই সর্বজনীন নববর্ষ উদযাপন। সেখানেও নানা উপকরণ ও অনুষঙ্গ এসে মিলিত হবে। এটাই স্বাভাবিক। ঢাক-ঢোল-বাঁশি-দোতারার সাথে মিলবে আরও কতো কিছু। দেয়া-নেয়া ছাড়া মানবসমাজ কোথায় বিকশিত হয়েছে? পরিমিতি বোধ থাকলেই হলো। শার্টপ্যন্ট,টেবিল-চেয়ার, চা, কফি, মোগলাই, বিরিয়ানি আরও কতো কি নিয়েছি আমরা, দিয়েছিও প্রচুর।

বাঙলার মাসের নামগুলো দেখুন- সব নক্ষত্রের নাম থেকে নেয়া। সাত দিনের নাম গ্রহের নাম থেকে নেয়া। এখানে আবার অনেককেই হিন্দুরা দেবতা বানিয়ে নিয়েছেন, যেমন- শনি, রবি, বৃহস্পতি, শুক্র। আবার, গ্রহ তো ৯ জনই দেবতা, নবগ্রহ বেবতা। চন্দ্র,সূর্য, নদী, পাহাড়, গাছপালা, পশুপাখি, পাথর, মাটি, এমনকি জলে স্থলে অন্তরিক্ষে যাকিছু আছে হিন্দুরা সবকিছুতেই দেবতা খুঁজে। এটাকে বলে সর্বেশ্বরবাদ। এ এক গভীর অনুধ্যানের বিষয়। তারা সেটা ভাবুক।

সবার কাছে সব জিনিস সমান নয়। নিজের আদি ইতিহাস এবং রুটস্ জানলে এসব সহজেই নেয়া যায়। প্রাচীণ গ্রীক দেবতাদের নামেও পৃথিবীতে অনেককিছু নামকরণ করা হয়েছে, ইতিহাসের অংশ হয়ে আছে। বাংলাদেশেও আছে ইসলামপুর, হাজীগঞ্জ, রহিমপুর, দুর্গাপুর,লক্ষ্মীপুর,নারায়ণগঞ্জ ইত্যাদি শত শত নাম। তাতে কি আসে যায় বলুনতো? মাটি ও মানুষ তো ঠিকই আছে।

আমরা একে অন্যকে প্রতিপক্ষ ভাবছি এবং জ্ঞান ও যুক্তি মানতে চাইনা। একটি জাতি আজ চিন্তা-চেতনার জায়গায় খন্ডিত। বিশাল জনসংখ্যার মানুষকে দূরে রেখে, বিপরীতমুখী যাত্রায় রেখে কোনো একটি গন্তব্যে কখনো মিলিত হতে পারবো না আমরা। ততোদিন কোনো উৎসব প্রকৃত সর্বজনীন হবে না।

সংঘাত নয়, চাই আলোচনা, মতবিনিময়, জ্ঞান ও ইতিহাস চর্চা, উদার ধর্ম চর্চা। ধর্মে যা যা নিষেধ তা করবেন কেনো? আপনার রুচি বা সংস্কৃতিতে যা নিতে পারছেন না তা করবেননা। ডাবল স্ট্যান্ডার্ড নিয়ে চলবেন কেনো, অন্তরে পাপবোধ নিয়ে? ভেতরে ধারন করে তবে যুক্ত হোন।

যারা বাঙালির সর্বজনীন ঋদ্ধ সংস্কৃতির রথকে টেনে নিয়ে যেতে চান বহু দূর তারা নিজেরাই কিন্তু আবদ্ধ হয়ে গেছেন কিছু নির্দিষ্ট স্থানে, সংকীর্ণ গণ্ডিতে। সেই রথের রশিতে ব্রাত্যজনের হাত নেই, প্রাকৃতজনের হাত নেই, দূরে দৃষ্টি নেই। এ রথের রশিতে টান পড়বে না, চাকা নড়বে না। চারিদিকে শুধু রথী মহারথীদের ভিড়। অভাব নেই উপদেশক আর পৃষ্ঠপোষকের। পৃষ্ঠপোষকরা যেনো পৃষ্ঠে অন্যকিছু না দেন সেটাই ভাবার বিষয়। জাঁকজমক বা আড়ম্বর মানেই শক্ত ভিত্তি নয়। হইহুল্লোড় বা হুলস্থুল মানেই জনতার শক্তি নয়।

আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী... পথের শেষটাই বলে দেবে কোনটা সঠিক ছিলো।

লেখক: নাট্যব্যক্তিত্ব ও তথ্যচিত্র নির্মাতা।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত