মিহিরকান্তি চৌধুরী

১০ এপ্রিল, ২০২৪ ০০:২৬

শ্রদ্ধা ও স্মরণ : মো. দরছ আলী স্যার

মো. দরছ আলী সিলেটের শিক্ষাঙ্গনের এক বহুশ্রুত অত্যাবশ্যক নাম। বিগত শতকের আশির দশকের গোড়ার দিকে সিলেট সরকারি পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ের খ্যাতিমান প্রধানশিক্ষক। মূলত, মনস্বী শিক্ষক। ষাটের দশক থেকেই ইংরেজির শিক্ষক। একটি খেলার দলে সেটা ফুটবল, ক্রিকেট বা হকি যাই হোক একজন দলনেতা প্রথমে খেলোয়াড়, তারপর নেতা। একইভাবে, একটি স্কুল বা কলেজেও একজন প্রধানশিক্ষক বা অধ্যক্ষ প্রথমে শিক্ষক, পরে প্রতিষ্ঠান প্রধান।

প্রত্যেক পেশায় ব্রান্ড আছে। সিলেটের মধ্যেই যদি বিবেচনা করা যায়, তাহলে দেখা যাবে ডাক্তার পদের ব্রান্ড ডা. শামসুদ্দিন আহমেদ, প্রফেসর ডা. এম. এ. খালেক, প্রফেসর ডা. এম. এ. রকিব প্রমুখ; অধ্যক্ষ পদের ব্রান্ড অধ্যক্ষ প্রফেসর সলমান চৌধুরী,  অধ্যক্ষ প্রফেসর আবু হেনা, অধ্যক্ষ প্রফেসর কৃষ্ণকুমার পালচৌধুরী, অধ্যক্ষ প্রফেসর হাসান ওয়ায়েজ প্রমুখ; ইংরেজি শিক্ষকের ব্রান্ড অধ্যক্ষ কৃষ্ণকুমার পালচৌধুরী, মো. দরছ আলী, মো. আব্দুল মান্নান, আবু হেনা চৌধুরী প্রমুখ; প্রধানশিক্ষকের ব্রান্ড হচ্ছেন মো. দরছ আলী, বাবু অবনীকান্ত চৌধুরী প্রমুখ। এমনকি সহকারী প্রধানশিক্ষকেরও ব্রান্ড আছে। যেমন বাবু দিগেন্দ্রচন্দ্র দত্ত। তিনি আমাদের বড়লেখার পিসি হাইস্কুলে কর্মরত ছিলেন, বর্তমানে প্রয়াত। তিনি পুরো সিলেট বিভাগে এই পর্যায়ের কর্মদক্ষ ও বিচক্ষণ দুচারজনের একজন ছিলেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের ব্রান্ড প্রফেসর ছদরউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের ব্রান্ড প্রফেসর মুহম্মদ জাফর ইকবাল, প্রফেসর খলিলুর রহমান প্রমুখ। ব্রান্ড এমন এক বিষয় যে পদের স্তর নির্বিশেষে তা সমাজের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে। যেমন ইউনিয়ন চেয়ারম্যানের ব্রান্ড মো. এম. এ. রকিব (টুলটিকর), নার্স বা সেবিকার ব্রান্ড হাসি রানী দাস। এমনকি দারোগার ব্রান্ডও আছে। আশির দশকে সিলেটে কর্মরত এস আই নুরুল ইসলামের কথা নিশ্চয়ই অনেকের মনে আছে। মূল কথায় আসি, মো. দরছ আলী স্যার ছিলেন তাঁর পদের শুধু ব্রান্ড নয়, ব্রান্ড লিডার।  

মো. দরছ আলী স্যারের কথা মনে হলে সিলেট সম্বন্ধে নবদ্বীপের পণ্ডিতদের কথা প্রাসঙ্গিক মনে হয়, “শ্রীহট্টে মধ্যমা নাস্তি”। একটি উল্লেখযোগ্য মাত্রার প্রভাব ও প্রেরণাদানে সমর্থ একজন ব্যক্তিত্ব, প্রধানশিক্ষক হিসেবে তাঁর সুশৃঙ্খল আচরণ ও নিয়মনীতিঘনিষ্ঠ কঠোর পদ্ধতির জন্য স্বীকৃত। তাঁর নিয়মানুবর্তিতা ছাত্র ও শিক্ষক উভয়ের মধ্যেই এক ধরনের ইতিবাচক সাবধানতার অনুভূতি জাগিয়েছিল।

প্রশাসক হিসেবে তাঁর কঠোর খ্যাতি সত্ত্বেও তিনি স্কুল সম্প্রদায়ের মধ্যে একটি সম্মানের অবস্থান বজায় রেখেছিলেন।

রটনার চেয়ে বাস্তব পরিস্থিতি ভিন্ন ছিল। ছাত্ররা প্রথমে ভয়ে ভয়ে দরছ আলী স্যারের কাছে যায় তবে সেখানে ভিড়ার পর বুঝে পরিস্থিতি ভিন্ন। সময়ের সাথে সাথে স্যার সম্পর্কে ছাত্রদের উপলব্ধি বিকশিত হতে থাকে। তখন তারা আরও ঘনিষ্ঠভাবে যোগাযোগ করে। শেষ পর্যন্ত তারা লাভবান হয়। সুতরাং প্রাথমিক রিজার্ভেশন সত্ত্বেও ছাত্ররা দেখতে পায় যে দরছ স্যারের কাছে পৌঁছানো যায় এবং বিশেষ করে যারা একাডেমিক বিষয়ে দিকনির্দেশনা ও সহায়তা নিতে ইচ্ছুক। ভয়ভীতি থেকে শ্রদ্ধা ও প্রশংসার এই রূপান্তরটি দরছ আলী স্যারের কঠোর বাহ্যিকতার বাইরে অন্তর চরিত্রের নান্দনিক কোমলতার ইঙ্গিত দেয়।

অধিকন্তু, দরছ আলী স্যারের ব্যক্তিগত স্তরে শিক্ষার্থীদের সাথে জড়িত থাকার ইচ্ছা যেমন আনুষ্ঠানিক কাঠামোর বাইরে একাডেমিক সহায়তা প্রদান সহানুভূতি ও সহমর্মিতার বোধকে প্রদর্শন করে। তাঁর একাকী স্বভাবও কাঁর একটা ব্রান্ড ছিল। এর মধ্যেই তিনি কর্মমুখর ছিলেন, পেশাগত দায়িত্বে একনিষ্ঠ ছিলেন। শিক্ষকদের সাথে পক্ষপাতিত্ব করতেন না। কঠিন সিদ্ধান্ত নৈর্বক্তিকভাবেই আসত যদি আসার থাকে। সংগত কারণে শিক্ষকদের কেউ কেউ তাঁর ওপর অসন্তুষ্ঠ ছিলেন। তবে মনে রাখতে হবে, ভালো প্রশাসক সংশ্লিষ্ট সকলের বন্ধু হতে পারেন না। প্রধানশিক্ষক পদের বাইরে ইংরেজির ভালো শিক্ষক ছিলেন। সবকিছুর পরও তিনি ছাত্রদের সাথে অর্থপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

সামগ্রিকভাবে, মো. দরছ আলী একজন বহুমুখী ব্যক্তি হিসেবে আবির্ভূত হন যিনি, তাঁর সম্বন্ধে প্রচারিত ও প্রকাশিত প্রাথমিক ভীতিকর আচরণ সত্ত্বেও, তাঁর নির্দেশনা, সমর্থন এবং শেষ পর্যন্ত তাঁর উষ্ণতা এবং মানবতার মাধ্যমে তাঁর চারপাশের লোকদের সাথে প্রকৃত সংযোগ গড়ে তোলেন।

আমার পরিচালিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ‘অ্যাকাডেমি অব টু আরস’ এ অনেক গুরুগম্ভীর, শিক্ষা-সাহিত্য-সংস্কৃতিবিষয়ক সেমিনার, অনুষ্ঠান, সংবর্ধনা অনুষ্ঠান হয়েছে। ১৯৮৮ সালে একটি জাকজমকপূর্ণ পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। সাথে ছিল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। বিতর্ক প্রতিযোগিতা, উপস্থিত বক্তৃতা প্রতিযোগিতা থেকে শুরু করে সুকুমার বৃত্তির নানা বিষয়ের প্রতিযোগিতার পুরস্কার তো ছিলই, পাবলিক পরীক্ষা ও অভ্যন্তরীন পরীক্ষায় ভালো ফলাফলেরও পুরস্কার ছিল। প্রধান অতিথি ছিলেন কিংবদন্তীতুল্য শিক্ষক, সিলেট পাইলট হাইস্কুলের খ্যাতিমান প্রধানশিক্ষক জনাব মো. দরছ আলী। দরছ আলী স্যারের সাথে ১৯৮৬ সাল থেকে পরিচয়। ১৯৮৭ ও ১৯৮৮ দুই সালেই সিলেট জেলা প্রশাসন কর্তৃক আয়োজিত পুস্তক প্রদর্শনীতে আমার প্রতিষ্ঠান প্রথম পুরস্কার লাভ করে। দুই বারই স্যার এই প্রদর্শনীর কো-অর্ডিনেটর ছিলেন। তাঁর ব্যক্তিত্বের গাম্ভীর্য আমাকে তাঁর পরম ভক্ত বানিয়ে দেয়। ওই পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে দরছ আলী স্যারকে প্রধান অতিথি করায় অনেকেই আমাকে সাধুবাদ জানিয়েছিলেন। অনুষ্ঠানে তাঁর সহৃদয় উপস্থিতি শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও সুধীজনকে অনুপ্রাণিত করেছিল।

মো. দরছ আলী স্যার আমার সরাসরি শিক্ষক না হলেও আমি তাঁকে নিজের শিক্ষক মনে করতাম। সেই হিসেবেই সম্মান করতাম। তিনি একজন দৃঢ়চেতা ও নীতিপরায়ণ ব্যক্তি ছিলেন। প্রশাসক হিসেবে বা শিক্ষক হিসেবে ছিলেন স্পষ্টভাষী। অত্যন্ত অসাম্প্রদায়িক এক ব্যক্তিত্ব! প্রগতিশীল বোধ ও ভাবনায় যারপর নাই আশ্রিত ছিলেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত অনাড়ম্বর জীবনেযাপনে অভ্যস্ত এক ব্যক্তিত্ব। অধিকারী ছিলেন নীরবতাবান্ধর উচ্ছ্বসিত এক মন ও প্রাণের। শব্দ নিতান্তই অনুপস্থিত ছিল তাঁর জীবনে, চলাফেরায়, কথাবার্তায়। তাঁকে দেখলেই ‘প্লেন লিভিং অ্যান্ড হাই থিংকিং’ কাকে বলে অনুমান করা যেত। আজ বাংলাদেশ উগ্র প্রকাশের ভাবনায় ভারাক্রান্ত, রোগগ্রস্ত; বিকাশের ভাবনা পরাভূত। তাঁর মতো ব্যক্তিত্বের কাছে প্রকাশের চেয়ে বিকাশই সতত বেশি গুরুত্ব পেত।

আগেই বলেছি, স্যারের সাথে আমার পরিচয় ১৯৮৬-৮৭ সালের দিকে। আমাকে অত্যন্ত আপন মনে করে স্নেহ করতেন। তাঁর সাথে সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হয় শ্রদ্ধাভাজন অ্যাডভোকেট সুলেমান রাজা চৌধুরীর মাধ্যমে। তিনি সুলেমান রাজা চৌধুরী সাহেবের বন্ধু ছিলেন আর রাজা সাহেব ছিলেন আমার অভিভাবক ও ভগ্নিপতি (সুরাইয়া রাজা চৌধুরী সুরাইয়া আপার স্বামী)। এক সময় স্যারের রেফারেন্স নিয়ে আমার কাছে দুচারজন এসেছিলেন, বিশেষ বিশেষ বিষয়ের ড্রাফট করাতে। স্যার নাকি এই বলে পাঠিয়েছিলেন, অমুকের কাছে যান, ইংরেজি কিছু বোঝে, কিছু জানে। এটা ছিল আমার জন্য অনেক বড়ো সার্টিফিকেট!!! এর পর আমার কাজে আরও ভরসা পেলাম। দাগল সাইজের একটা সার্টিফিকেট!!! ওই সময়ে সিলেট সরকারি পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ের খ্যাতিমান অন্য ইংরেজি শিক্ষক ছিলেন মো. আসাদ উদ্দিন স্যার, প্র্যাকটিসিং। খুবই চমৎকার লোক। জেলা শিক্ষা অফিসার হয়ে পদোন্নতিজনিত বদলির ফলে আসাদ উদ্দিন স্যারের বলয়ের অনেক ছাত্র আমার প্রযত্নে চলে আসে। আসাদ স্যার নিজেই আমাকে রেফার করেছিলেন, পাঠিয়েছিলেন নিজের মেয়েকেও। পরবর্তীকালে, আসাদ স্যারের অকাল প্রয়াণে আমরা যারপর নাই মর্মাহত হই। অত্যন্ত ভালো লোক ছিলেন যেমনটি ছিলেন দরছ আলী স্যার। তাঁদের ব্যক্তিত্বের স্বাচ্ছন্দ্যময়, আনন্দদায়ক ও উষ্ণ দিক আমাকে প্রাণিত করে, করে উৎসাহিত। কথায় আছে, ‘অ্যা বুক শুড নট বি জাজড বাই ইটস কভার’। তাঁর আপাত কর্তৃপক্ষীয় ব্যক্তিত্বকে ঠিক রেখেও তিনি ছিলেন সহানুভূতিশীল এক ব্যক্তিত্ব। প্রশাসক থেকে একজন বন্ধুতে রূপান্তর ঘটেছে তাঁর এমন অনেক নজির অনেক ছাত্রের মনে গেঁথে আছে। তিনি প্রভূত মনস্তাত্ত্বিক সক্ষমতার অধিকারী ছিলেন।

মো. দরছ আলী স্যার ছিলেন নির্মোহ ও নিরহংকারী এক ব্যক্তি। তাঁর চলাফেরায়, বেশভূষায়, কথাবার্তায় উচ্চমার্গের এক সংযম পরিলক্ষিত হত। তাঁর শত শত ছাত্র দেশে বিদেশে আজ প্রতিষ্ঠিত। নিজ নিজ বিষয় জ্ঞানের বাইরে স্যারের সহজবোধ্যতা অনেককেই প্রভাবিত করেছিল। আমি তো বেশ কয়েকজনকে চিনি। সেটাকে স্যাম্পল স্টাডি মনে করলেও একটা রেজাল্ট বৈকি। সিরিয়াস পাঠক ছিলেন। যেমন ভালো বই চিনতেন তেমন অন্যদেরও চেনাতে পারতেন।
আজকাল তাঁর মতো শিক্ষক, প্রধানশিক্ষক, শিক্ষাবিদের অভাব রয়েছে। দুচারজন যে নেই তা নয় তবে বিশ কোটি জনসংখ্যার দেশে সেই সংখ্যা প্রায় শূণ্যের কোঠায়।

মো. দরছ আলী স্যার দার পরিগ্রহ করেননি। স্কুল হোস্টেলে থাকতেন। ধার্মিক ছিলেন কিন্তু গোঁড়া ছিলেন না। অবসরের পর শেষ বয়সে হজ্জব্রত পালনের জন্য মক্কা নগরীতে গেলে সেখানেই অসুস্থ হয়ে প্রয়াত হন।
এই মহৎপ্রাণ ব্যক্তির স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাই।

লেখক পরিচিতি :  ডেপুটি রেজিস্ট্রার, মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটি, সিলেট এবং লেখক, অনুবাদক ও নির্বাহী প্রধান, টেগোর সেন্টার, সিলেট।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত