মিহিরকান্তি চৌধুরী

২৩ মে, ২০২৪ ০০:৫৯

শ্রদ্ধা ও স্মরণ : আনহার চৌধুরী

এক অতি আপনজনের প্রস্থানে যারপর নাই ব্যথিত হয়েছি। তাঁর নাম আনহার আহমদ চৌধুরী, আনহার চৌধুরী নামেই সমধিক পরিচিত ছিলেন। বৃহত্তর সিলেটের সৃনামগঞ্জ এলাকার ভাটিপাড়া চৌধুরী পরিবারের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র একাধারে বৃহত্তর সিলেট তথা সারা দেশের এক সুসন্তান ছিলেন।

মেধাবী ছাত্র ছিলেন, পড়েছেন সেরা প্রতিষ্ঠানগুলোতে- সিলেট সররকারি পাইলট হাইস্কুল, সিলেট এমসি ইন্টারমিডিয়েট কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ছিলেন ক্লাসিক ইঞ্জিনিয়ারিং কর্পোরেশন লিমিটেড, ঢাকা এর ম্যানেজিং ডিরেক্টর, ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিক (ইউএপি) এর পরিচালক, গুলশান সোসাইটির সাবেক সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক। তিনি একজন বিশিষ্ট রোটারিয়ানও ছিলেন।

 ২২ মে ২০২৪ রাতে ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতালে বেশ কিছু স্বাস্থ্য জটিলতায় ভোগান্তির পর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৪। তাঁর স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করি।

তাঁর সাথে আমার বেশ কিছুদিনের যোগাযোগ, বছর পাঁচ সাত হবে। ফেসবুকে আমার লেখার একজন পাঠকও। অত্যন্ত সৃজনশীল মানসিকতার লোক। বেশভূষা থেকে শুরু করে চলন, বলন সব কিছুতেই সৃজনের ছাপ, পরিপাটী, সুস্থ জীবনধারার প্রতিফলন ছিল। ফেসবুকে যেসব বিষয়ে পোস্ট দিতেন তার মধ্যেও রুচির অত্যন্ত জোরালো ছাপ ছিল। আমি জানতাম না, তিনি দীর্ঘদিন ধরে ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত। ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতালের আইসিইউ-তে চিকিৎসাধীন ছিলেন। ক্যান্সারের স্ট্রেসের অতিরিক্ত নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে শ্বাসকষ্টজনিত রোগ তিনি মারাত্মক অসুস্থ ।

আজ থেকে মাত্র দশ বারোদিন আগে ১১ মে ২০২৪ তারিখে অধ্যক্ষ প্রফেসর গোলাম রসুল স্যারকে নিয়ে আমার একটি লেখা পড়ে তিনি হাসপাতালের বেডে থেকেই কমেন্ট অংশে লিখেন, “শ্রদ্ধেয় গোলাম রসুল স্যারকে নিয়ে একটি অসাধারন ও অতূলনীয় স্মৃতিচারণের জন্য আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ জানাই। আমি নিজে অসুস্থ থাকায় আপনার অতি উচুমানের লিখনীর প্রশংসা করার ইচ্ছা থাকা সত্বেও আজ এখানেই থেমে গেলাম।।”

আমি জানতাম না তিনি হাসপাতালের বেড থেকে লিখছেন। ভেবেছি সাধারণ কোনও অসুস্থতায় শারীরিক স্ট্রেস আছে। আমি একটি উত্তর দিলাম, “স্যার, আপনার উৎসাহে লেখক উজ্জীবিত। আপনি শীঘ্রই সুস্থ হয়ে উঠুন এই প্রার্থনা করি। অধ্যক্ষ প্রফেসর গোলাম রসুল স্যারের মতো ব্যক্তিত্ব এই সমাজের প্রকৃত সম্পদ। নতুন প্রজন্মের বাংলা পড়তে ও লিখতে জানে না অংশকে জানাতে এই লেখার ইংরেজি অনুবাদ এই সপ্তাহেই শেষ করব। স্যারের নাতিপুতিসহ তাঁদের, আমাদের ও অন্যদের ছেলেমেয়ে ও নাতিপুতিদের দুচারজনও যদি পড়ে তাহলে প্রচেষ্টা সার্থক হবে। যারা বাংলা পড়তে ও লিখতে জানে না তার জন্য তারা নয় বরং আমরাই দায়ী। শ্রদ্ধা ও শুভেচ্ছাসহ।।”

ভাবছিলাম, তাঁর স্বাস্থ্যের খোঁজখবর নেব, টেগোর সেন্টারের আগামী জানুয়ারির অনুষ্ঠানে ভাবিসহ তাঁকে দাওয়াত করব। এরই মধ্যে দুইতিন আগে ফেসবুকে তাঁর এক আত্মীয়ের স্ট্যাটাস থেকে জানতে পারি, তাঁর অসুস্থতার কথা, ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতালের আইসিইউ-তে চিকিৎসাধীন থাকার কথা। মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে উঠল। আমার মানবিক শক্তি ও সামর্থ্য দ্বারা অনুমান করা কঠিন ছিল, কতটুকু হৃদয় দিয়ে, আত্মা দিয়ে জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থেকে একজন লোক হাসপাতালের আইসিইউ-তে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরেকজন লোকের লেখা পড়তে পারেন, প্রশংসা করতে পারেন। এই মাত্রা ও পরিপ্রেক্ষিতের প্রশংসার পর কোনও লেখকের আচারিক কোনও পদক, পুরস্কার  সার্টিফিকেটের প্রয়োজন নেই। লেখক জীবনের অন্যতম সেরা এক প্রাপ্তি!!!  আমি বাকরুদ্ধ, কৃতজ্ঞতা জানানোর ভাষা নেই। শুধু প্রার্থনা করি, তাঁর পারলৌকিক জীবন যেন শান্তিময় হয়।  

মরহুম আনহার চৌধুরীকে অত্যন্ত সম্মান করতাম। তাঁর শ্বশুর ছিলেন খাদ্যবিভাগের মহাপরিচালক (ডিজি ফুড) মরহুম নুরুদ্দিন চৌধুরী, সিলেটের দাউদপুরে বাড়ি। দাউদপুরের চৌধুরী পরিবারের সাথে আমাদের যোগাযোগ, সম্পর্ক ছিল। আমাদের শাহবাজপুর এলাকায় ভূগা গ্রামে মরহুম আব্দুস শুকুর চৌধুরী ও মরহুম আব্দুস সহিদ চৌধুরীর পরিবারের সাথে তাঁর শ্বশুরবাড়িরও সম্পর্ক ছিল। আমার আরেক শ্রদ্ধাভাজন মরহুম সিএম তোফায়েল সামির ‘মই’ ছিলেন তাঁর শ্বাশুড়ি। তোফায়েল সামি স্যারের মুখে ও কলমে তাঁর ‘মই’ (খালা/ মাসি) এর অনেক গল্প শুনেছি। অন্যদিকে, মরহুম আনহার চৌধুরীর জামাতা হচ্ছেন আমার প্রিয়ভাজন ছাত্র মোস্তাফিজ আহমেদ চৌধুরী (মরহুম সবুর আহমেদ চৌধুরীর পুত্র)।  

বছরখানেক আগে এক হ্যাকার আনহার চৌধুরী সাহেবের ফেসবুক আইডি হ্যাক করে আমাকে মেসেঞ্জারে মেসেজ পাঠাতে শুরু করে। আনহার চৌধুরীর বেশ ধরে হ্যাকার বোঝাতে চেষ্টা করে যে, তিনি দুবাই এয়ারপোর্টে আছেন, ঢাকা আসছেন, সিলেট আসবেন। এক বিশেষ জটিলতায় চারটা টিকিটের জন্য একটি বিশেষ ট্র্যাভেল এজেন্সিকে ফোন করতে বলেন। ফোন করি। ১২,৮০০ টাকা বিকাশ করার অনুরোধ আসে। ঘটনাপ্রবাহ বিশ্বাসযোগ্যতায় রূপ নিতে যাচ্ছে এমন সময় আরও একটি মেসেজ আসে, “I can’t communicate with anyone. If I don’t have ticket now will get in trouble letter.’ এই মেসেজই বলে দেয় সে হ্যাকার। আনহার চৌধুরীর যে প্রোফাইল তিনি ভুল করে হলেও কখনও ‘later’ কে ‘letter’ লিখবেন না। এই একটিমাত্র ক্লু ওয়ার্ড আমার জন্য যথেষ্ট ছিল। বলা হয়ে থাকে, সব অপরাধী কোনও না কোনও ক্লু রেখে যায়। কথাটা যে সত্যি তার প্রমাণ পেলাম। অপরাধ করতেও যে শিক্ষার প্রয়োজন সেটা হ্যাকার জানত না, জানলেও ফুল প্রিপারেশন ছাড়া মাঠে নেমেছে। ওই রাতে বা পরের দিন সকালে আনহার চৌধুরী সাহেবের কাছে স্ক্রিনশটগুলো পাঠাই। জানতে পারি, তাঁর ভাই জনাব আহরার চৌধুরীসহ আরও অনেককে প্রতারণার ফাঁদে ফেলতে চেয়েছিল ওই হ্যাকার বা তার সংঘবদ্ধ গ্রুপ।

মরহুম আনহার চৌধুরী সদাহাস্যজ্জ্বল এক ব্যক্তি ছিলেন, ছিলেন অমায়িক। সকলের প্রতি বন্ধুবৎসল ছিলেন, পরোপকারী তো বটেই। সংস্কৃতিমনা ছিলেন, ছিলেন সংগীতের একনিষ্ঠ ভক্ত । নিজেও গান গাইতে জানতেন। একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষ ছিলেন, ছিলেন আপাদমস্তক একজন ভদ্রলোক যাকে কি না বলে ‘টোটাল জেন্টলম্যান’।  

মরহুম আনহার চৌধুরীর স্মৃতির প্রতি আবারও শ্রদ্ধা জানাই।

মিহিরকান্তি চৌধুরী : লেখক, অনুবাদক ও নির্বাহী প্রধান, টেগোর সেন্টার, সিলেট এবং ডেপুটি রেজিস্ট্রার, মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটি, সিলেট।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত