মাসুদ পারভেজ রূপাই

২৪ জুন, ২০২৪ ১২:১৬

খোলা চিঠি তোমাকে, প্রিয় লিও...

প্রিয় লিও,
জন্মদিনের শুভেচ্ছা নিও!

দুঃখের সময়ে সুখের সন্ধান করতে হয় আর তরতরিয়ে এগিয়ে চলা অনাবিল সুখের সময়ে দুঃখের দিনগুলোকে। ঝলকানি দিয়ে শুরু হয়েও তোমার জীবনে দুঃখ নেমে আসার দিনগুলো মনে পড়ে। এখন বুঝতে পারি কী অবর্ণনীয় দিন ছিলো সেই দিনগুলো। রোজারিও থেকে অচেনা-অজানা লা-মাসিয়ায় যাওয়ার পরে খাপ খেয়ে নিতে না পারার সময়, স্প্যানিশ পাসপোর্টজনিত ঝামেলায় মূল দলে খেলতে না পারার সময়, পরিবারের সবাইকে (বাবা ছাড়া) আর্জেন্টিনায় ফিরে যেতে হওয়ার সময় কিংবা প্রেমিকার সাথে দূরত্ব তৈরি হয়ে যাওয়ার সেই সময়...

বার্সেলোনার ক্যারিয়ারে সিনিয়র দলের হয়ে খেলা শুরু করার পরে অবশ্য একটা ঝামেলা শেষ হয়েছিল। কিন্তু আর্জেন্টিনার হয়ে খেলার বছর দুয়েকের মধ্যে তুমি বুঝতে পেরেছিল...তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছিলে ম্যারাডোনা হওয়ার কী ভীষণ যন্ত্রণা! তুমি বুঝতে পারছিলে আকাশী-সাদা জার্সির ওজন। তারপর থেকে তোমার জীবনে দুইটা পর্ব হয়ে গিয়েছিল। বার্সেলোনার ক্যারিয়ারে একের পর এক সাফল্যের অপর প্রান্তে হতাশা আর ব্যর্থতার চোরাবালি। হ্যাঁ, সেখানে ছোট্ট করে লেখা থাকবে একের পর এক ফাইনালে গিয়েও হেরে যাওয়া, সেখানে লেখা থাকবে পালাসিউস থেকে হিগুয়েন কিংবা প্যাকারম্যান থেকে ম্যারাডোনার ভুলভাল সিদ্ধান্ত। কিন্তু এপিটাফ তো তোমাকে নিয়ে!

বার্সেলোনার হয়ে অনিন্দ্যশৈলী ফুটনৈপুণ্যের চোখ ধাঁধানো প্রদর্শনীর সময়ে ফুটবলের পণ্ডিতরা যেখানে পেলে-ম্যারাডোনা ছাপিয়ে গ্রেটেস্ট অফ অল টাইম স্বীকৃতি দিচ্ছিল, রোজারিওতে সেই সময় তোমার ভাস্কর্য ভেঙ্গে দেওয়া হয়েছিল। বার্ন্যাবু কিংবা ওয়েম্বলি যখন তোমার ফুটশৈলীতে মোহাবিষ্ট হয়ে তোমাকে মহারাজা উপাধি দিচ্ছিলো, তখন আর্জেন্টাইনরা তোমাকে ম্যারাডোনার উপযুক্ত নয় বলছিল। তাঁদেরও দোষ কীভাবে দিই...যুগের পর যুগ চলে যাচ্ছে অথচ বিশ্বকাপ নেই, যুগের পর যুগ চলে যাচ্ছে অথচ মহাদেশীয় সাফল্য নেই। কিন্তু এত ব্যর্থতা ও হতাশার চাদর মুড়িয়েও তোমার পথচলা থেমে যায়নি। ওহ না, একবার থেমে গিয়েছিল এবং সেবার বিশ্বব্যাপী মিলিয়ন-বিলিয়ন ফুটবলপ্রেমীর হৃৎস্পন্দন থেমে গিয়েছিল। সেবার তুমি বুঝেছিলে নিশ্চয়ই, ভালোবাসার মানুষের কী অপরিসীম শক্তি!

তারপর আরও কিছুটা সময়ের অন্ধকার পেরিয়ে তোমার জাতীয় দলের ক্যারিয়ারে অবশেষে রোশনাই এসেছে। এবং সেই আলোর কী মহিমা...যে অপবাদ তোমাকে দেওয়া হয়েছিল তুমি তা ফিরিয়ে দিয়েছ তার চেয়ে কোটি-গুণ বেশি সাফল্যে। দেশকে ২৮ বছর পরে কোপা আমেরিকা জিতিয়েছ, তার কিছু সময় পরে ফাইনালিসসিমা এবং তারপরে দ্য আল্টিমেট প্রাইজ অফ ফুটবল; ফিফা ফুটবল বিশ্বকাপ। প্রত্যেকটা শিরোপায় তুমি টেন অন টেন পারফর্ম উপহার দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছ দ্য বয় ফ্রম রোজারিও ফুটবলের সর্বকালের সেরা ফুটবলার। এখন তোমার ফুটবলের সূচক নিয়ে আলাপ করা চলে। এখন পেছনে ফিরে তোমার বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারে পলক ফেলে বলা যায়; এই অসামান্য ক্যারিয়ারে তোমার সমকক্ষই শুধু নয় বরং তোমার ধারেকাছেও কেউ নেই। ফুটবলের সিংহাসনে তুমি একা। ফুট-এভারেস্ট চূড়ায় তোমার অপেক্ষা হয়তোবা চিরদিনের! কারণ, তোমার ক্যারিয়ারের অর্জন প্রায়ইজনের কাছে দিবাস্বপ্ন এবং অনতিক্রম্য।

কিন্তু একটা সময় সবাইকে থামতে হবে এবং সেইদিনের আশঙ্কায় এখনি আমার চোখ ছলছল করে ওঠে। ফুটবলে মেসির নান্দনিক শৈলী থেমে যাবে কিংবা মেসিকে বল পায়ে অবিশ্বাস্য সব কারিকুরি করতে দেখা যাবে না...জাগতিক নিয়মে মেনে নিতে হবে সেই দিনটা। কিন্তু ফুটবলকে তুমি যা দিয়েছ তাতে ফুটবলের আর কিছু না পেলেও বোধহয় চলবে!

জানি, হাঁটি হাঁটি পা পা করে আর মাত্র ক’টা রাঙ্গানো দিন। তারপর; এই ড্রিবল, ডিফেন্স চেরা পাস, ডিফেন্ডারদের চোখে চোখ রেখে ধুলো দেওয়া, অবিশ্বাস্য চিপ, ঠিকঠাক ফ্রি-কিক কিংবা সেই দুরন্ত সলো-রান থেমে যাবে। কিন্তু যে ফুটশৈলী উপহার দিয়েছ তাতে দিন চলে যাবে। আর ঘুরেফিরে অনুরণন ঘটাবে সেইসব অমলিন স্মৃতি। যা ফুটবলের পাথেয়, যা সমর্থকদের পাথেয়। ফুটবলকে এতটা আর কে দিতে পেরেছে...

হে প্রিয়,
এবারের জন্মদিন আলোকিত হোক, উদ্ভাসিত হোক এবং ফুট-আনন্দে ভরে উঠুক।

শুভ জন্মদিন হে সর্বজয়ী ফুটবলার; লিওনেল মেসি। ফুটবলের অবিশ্বাস্য সব অর্জন আর ভক্তদের অপার বিস্ময়ে ভাসানোর জন্য এই অধমের ভালোবাসা, শ্রদ্ধা ও শুভকামনা রইলো।

আরজগুজার,
মাসুদ পারভেজ রূপাই
চট্টগ্রাম, বাংলাদেশ।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত