মাসুদ পারভেজ, পিআইডি ফিচার

০৮ জুলাই, ২০২৪ ১২:২৫

ডিজিটাল থেকে স্মার্ট বাংলাদেশে উত্তরণ

স্বাধীন বাংলাদেশে বিজ্ঞানমনস্কতা এবং বিজ্ঞান শিক্ষা ও প্রযুক্তি ব্যবহারে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পথপরিক্রমায় আজকের স্মার্ট বাংলাদেশের অভিমুখে যাত্রা। এটা প্রযুক্তিনির্ভর রাষ্ট্র বিনির্মাণ প্রক্রিয়া, যেখানে জ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং নিজস্ব উদ্ভাবনী শক্তির সমন্বয়ে প্রত্যেক নাগরিক তাদের জীবন ও জীবিকার মান বদলে দেবে; পাবে অধিকারের নিশ্চয়তা এবং থাকবে কর্তব্য পালনে বদ্ধ পরিকর। স্মার্ট সিটিজেন, স্মার্ট ইকনোমি, স্মার্ট গভর্নমেন্ট ও স্মার্ট সোসাইটি-এ চারটি মূল স্তম্ভ নির্ধারণ করে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের কর্মপরিকল্পনা হাতে নিয়েছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োগে দেশ ও সমাজের উন্নতি নিশ্চিত করতে ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে ক্ষুধা-দারিদ্র্য মুক্ত স্মার্ট সোনার বাংলা গড়ে তোলার অঙ্গীকার করে ইশতেহার ঘোষণা করেন তিনি।

ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের কোটা থেকে বেরিয়ে রূপান্তরিত হয়েছে মধ্যম আয়ের দেশে। সাফল্যের এ ধারায় উজ্জীবিত হয়ে ‘টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা-২০৩০' অর্জনের মাধ্যমে সকলের জন্য টেকসই ভবিষ্যৎ অর্জনের পরিকল্পনায় এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। ২০৪১ সালের মধ্যে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে ২০২৫, ২০৩১ ও ২০৪১-এর সময়রেখার মধ্যে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। জলবায়ুর অভিঘাত থেকে বদ্বীপ রক্ষার জন্য ডেল্টা প্ল্যান ২১০০ প্রণয়ন করা হয়েছে। ডিজিটাল প্রযুক্তির সঙ্গে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যুক্ত হয়ে তৈরি করবে স্মার্ট বাংলাদেশ। সরকার গ্রিন ইকোনমি, দক্ষতা উন্নয়ন, ফ্রিল্যান্সিং পেশাকে স্বীকৃতি প্রদান এবং নগর উন্নয়নে কাজ করছে। তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের বাস্তবায়নে অন্তর্ভুক্তিমূলক ডিজিটাল সমাজ গড়ে তুলতে পিছিয়ে পড়া প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে উন্নয়নের মূল ধারায় নিয়ে আসতে ডিজিটাল ইনক্লুশন ফর ভারনারেবল এক্সেপশন (ডাইভ) -এর আওতায় আত্মকর্মসংস্থান ভিত্তিক প্রশিক্ষণ কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে।

রূপকল্প ২০৪১-এর সমন্বিত পরিকল্পনার দুটি মূল দর্শন রয়েছে। তার একটি হল ২০৪১ সালের মধ্যে মাথাপিছু আয় ১২ হাজার ৫০০ মার্কিন ডলারে উন্নীত করে বাংলাদেশকে উন্নত দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা। দ্বিতীয়টি হচ্ছে দারিদ্র্যকে শূন্যের কোঠায় নামিয়ে দেশকে সোনার বাংলায় রূপান্তর করা। বর্তমানে প্রায় প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ খাতেই ডিজিটাল সেবা ব্যবস্থা নিশ্চিত হয়েছে, যার সুফল ভোগ করছে জনগণ। শুরুতে ডিজিটাল ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে অনেক সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করতে হয়েছে। পর্যায়ক্রমে দেশে ডিজিটাল ব্যবস্থায় সেবা সম্প্রসারণের ফলে এ ব্যবস্থার সুফল ও সেবা প্রাপ্তি জনগণকে আগ্রহী করে তোলে। যা সম্ভব হয়েছে দূরদর্শী নেতৃত্বের সমন্বিত উদ্যোগের কারণে। আগামীতে যেসব দেশ প্রযুক্তি ব্যবহারে এগিয়ে থাকবে, তারাই ব্যবসা-বাণিজ্য, আন্তর্জাতিক লেনদেন এবং যোগাযোগের ক্ষেত্রে সবচেয়ে সুবিধাজনক অবস্থায় নিজেদের নিয়ে যেতে পারবে। বর্তমান বিশ্বে প্রযুক্তিনির্ভর ডকুমেন্টের গ্রহণযোগ্যতা সবচেয়ে বেশি, আমাদের ডিজিটাল এনআইডি ও মেশিন রিডেবল পাসপোর্টের (ই-পাসপোর্ট) গ্রহণযোগ্যতা এখন অনেক বেশি। অথচ বিদেশিরা আগে আমাদের দেশের কাগজপত্র খুব সহজে বিশ্বাস করতে চাইত না। এখানেই দৃশ্যমান হয় ডিজিটাল বাংলাদেশের গুরুত্ব ও সুবিধা।

চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সুফল গ্রহণের মাধ্যমে স্মার্ট বাংলাদেশ করতে হলে প্রয়োজন স্মার্ট সিটিজেন। শতভাগ শিক্ষিত নাগরিকেরা মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট বা কম্পিউটারের মাধ্যমে সমাজের সঙ্গে যুক্ত থাকবে; সরকারি ও বেসরকারি খাত প্রদত্ত পণ্য ও সেবা গ্রহণ করবে; বিশ্ব অর্থনীতির সাথে নিজেদের যুক্ত রাখবে। প্রযুক্তির মাধ্যমে সরকারের নীতি নির্ধারণে ভূমিকা রাখবে স্মার্ট সিটিজেনরা।

স্মার্ট বাংলাদেশে মানুষের মাথাপিছু আয় বর্তমানের চেয়ে পাঁচ থেকে গুণ বাড়বে। স্মার্ট অর্থনীতি সকলের সমান সুযোগ নিশ্চিত করবে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও রোবটিক্সের ব্যবহার হবে কৃষি, শিল্প, সেবাসহ সকল খাতে; ক্ষুদ্র-কুটির, মাঝারিসহ সকল ব্যবসার পরিবেশ সহজ করা হবে। স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে দেশে উদ্ভাবিত সাশ্রয়ী প্রযুক্তি শিল্প-বাণিজ্যে প্রয়োগ উৎসাহিত করার লক্ষ্যে রাষ্ট্র সহায়তা করবে। কমিয়ে ফেলা যাবে কায়িক শ্রম; সম্পদের হবে সুষ্ঠু ব্যবহার; কমবে অপচয়; বাড়বে উৎপাদনশীলতা; খরচ কমবে উৎপাদনের; উৎপাদন হয়ে উঠবে প্রতিযোগিতামূলক।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১২ ডিসেম্বর ২০২২ ঘোষণা করেন সরকারের 'স্মার্ট বাংলাদেশ' গড়ার কর্মপরিকল্পনা। তিনি জানান, প্রযুক্তির ব্যবহার সরকার পরিচালনা ব্যবস্থাকে দক্ষ, কার্যকর এবং সাশ্রয়ী করে তুলবে, সর্বোপরি সুশাসন প্রতিষ্ঠা নিশ্চিত করবে। সরকারের প্রতিটি সেবা হবে চাহিদা অনুযায়ী এবং সমন্বিতভাবে, স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক। আইওটি, মেশিন লার্নিং, ক্লাউড কম্পিউটিং ইত্যাদি প্রযুক্তির মাধ্যমে সরকার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং অন্যান্য উৎস থেকে প্রাপ্ত তথ্যাবলী কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে বিশ্লেষণ করে স্মার্ট নাগরিকদের স্মার্ট প্রতিনিধির সঙ্গে যুক্ত হয়ে সরকার পরিচালনার সিদ্ধান্তসমূহ গ্রহণ করবে। স্মার্ট বাংলাদেশের প্রযুক্তির মাধ্যমে দূর করা যাবে সব রকম সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য। সঠিক তথ্যপ্রবাহের ফলে কমে যাবে ভুল ও মিথ্যা তথ্য প্রচারের মাধ্যমে অনৈতিক সুযোগ। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে বিশ্ব প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য প্রযুক্তি সক্ষমতা একান্ত প্রয়োজন। শিল্প উৎপাদনের নতুন ধারায় তুলনীয় সক্ষমতা ছাড়া গ্লোবাল ভ্যালু চেইনে সম্পৃক্ত থাকা সম্ভব নয়। এজন্য স্মার্ট বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য অর্জনের জন্য সরকার প্রতিটি ক্ষেত্রে কাজ অব্যাহত রাখবে এবং সমন্বয় সাধন করবে।

ডিজিটাল কানেক্টিভিটি ছাড়া স্মার্ট সিটি বা স্মার্ট টেকনোলজি কোনটাই বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না। বাংলাদেশ আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে অনেক এগিয়ে রয়েছে। ২০২১ সালেই পরীক্ষামূলকভাবে দেশে ফাইভজি (5G) সেবা চালু করা হয়েছে এবং এরইমধ্যে ফাইভজি কানেক্টিভিটি সেবা নিয়ে জনগণের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করা হয়েছে। স্মার্ট সিটি ও স্মার্ট ভিলেজ বিনির্মাণে স্বাস্থ্যসেবা, কৃষি ও শিক্ষা ক্ষেত্রের উন্নয়নে ফাইভজি কানেক্টিভিটির সুবিধাকে কাজে লাগানো শুরু হয়েছে। স্মার্ট সিটির কনসেপ্ট বাস্তবায়নে নাগরিকদের সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন ঢাকা অ্যাপ তৈরি করেছে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন ৪৮ হাজার স্মার্ট লাইট স্থাপন করেছে, যা মোবাইল ফোন থেকেই নিয়ন্ত্রণ করা যায়। অনলাইনে ট্যাক্স আদায় শুরু করা হয়েছে।
ড্রোনের মাধ্যমে বাসা-বাড়িকে সার্ভের আওতায় নিয়ে আসা হচ্ছে। নাগরিক সেবার সকল কার্যক্রমকে পর্যায়ক্রমে আধুনিকীকরণ করা হচ্ছে। এখন ৩৩৩ এর মাধ্যমে নাগরিকরা কোন অভিযোগ করলে সাথে সাথে এর সমাধান করা সম্ভব হচ্ছে। বিভিন্ন প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণা করার জন্য বুয়েট-এ রিসার্চ অ্যান্ড ইনোভেশন সেন্টার ফর সাইন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং স্থাপন করা হয়েছে। দেশের প্রত্যন্ত গ্রামের উন্নয়নের জন্য এগ্রিকালচার, পাওয়ার এবং অন্যান্য সেক্টরের উপযোগী প্রযুক্তি উদ্ভাবনে কাজ করা হচ্ছে। দেশের প্রেক্ষাপটে স্মার্ট এগ্রিকালচার তৈরিতে বুয়েট এবং বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় একসাথে কাজ করছে। স্মার্ট ভিলেজের অন্যতম উপাদান স্মার্ট এগ্রিকালচার। স্মার্ট এগ্রিকালচার-এর জন্য আইওটি ডিভাইস ব্যবহারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

বিজ্ঞান, কারিগরি ও প্রযুক্তিনির্ভর বাংলাদেশ গড়ে তোলার যে ভিত্তি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তৈরি করে গেছেন, সে পথ ধরেই স্মার্ট বাংলাদেশের অভিযাত্রা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসনামলে দেশে প্রযুক্তির বিস্ময়কর অগ্রযাত্রা বর্তমানে পুরোপুরি দৃশ্যমান। অধিকাংশ সরকারি সেবা এখন হাতের মুঠোয়। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যবহার দেশের শিক্ষাব্যবস্থা থেকে শুরু করে চিকিৎসা, অর্থনীতি, রাজনীতি, নিরাপত্তা, সংস্কৃতিসহ প্রতিটি মৌলিক ক্ষেত্রে যুগান্তকারী বিপ্লব এনে দিয়েছে। ২০৪১ এর বাংলাদেশ হবে জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা- এ লক্ষ্যে কাজ করছে বর্তমান সরকার। তাই ডিজিটাল থেকে স্মার্ট বাংলাদেশে উত্তরণের মাধ্যমে একটি আধুনিক ও জ্ঞানভিত্তিক, বৈষম্যহীন ও উন্নত বাংলাদেশ কেবল সময়ে ব্যাপার।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত