অধ্যাপক ডা. শেখ মো. নাজমুল হাসান

২৬ জুলাই, ২০২৪ ১৪:৫৩

নাশকতা: সরকারবিরোধিতা, রাষ্ট্রবিরোধিতা ও চোখের জল

অস্ত্র মানুষকে খেতে দেয় না, মানুষের চিকিৎসা দেয় না; অস্ত্র দিয়ে মানুষ মেরে ফেলা হয়। মানুষকে মেরে ফেলার জন্য অস্ত্র বানানো হয়। পৃথিবীতে অস্ত্র বানানো নিষিদ্ধও নয়। অস্ত্র বানানোর জন্য গবেষণা করা হয়, অস্ত্র ব্যবহারের জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। অস্ত্র ব্যবহার করার জন্য পৃথিবীর প্রায় সকল দেশে বিভিন্ন নামে বিভিন্ন বাহিনী আছে।

আইন বা আদালত মানুষের ন্যায্য অধিকার সংরক্ষণের জন্য। কিন্তু পৃথিবীর বহু দেশে আদালতের মাধ্যমে বিচারিক মৃত্যুদণ্ড বা জুডিশিয়ারি কিলিং কার্যকর আছে। আদালতকে ন্যায় প্রতিষ্ঠার, অধিকার প্রতিষ্ঠার শেষ আশ্রয়স্থল বলা হয়, অথচ এই আদালতই মানুষকে মৃত্যুদণ্ড দেয়, মানুষকে সাজা দেয়।

এখন প্রশ্ন হলো- অস্ত্র দিয়ে কী অস্ত্রধারী যাকে ইচ্ছে তাকে মেরে ফেলতে পারে? আদালতের বিচারপতিরা কী যাকে ইচ্ছে তাকে শাস্তি দিতে পারে? নিশ্চয়ই পারে না। আর পারে না বলেই সারা পৃথিবীতে অস্ত্র ব্যবহারের নিয়মকানুন আছে, বিচার ব্যবস্থা পরিচালনার আইনকানুন আছে। এগুলো সব নির্দিষ্ট ব্যবস্থাপনা ও কাঠামো দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।

সমাজে বসবাসকারী মানুষের স্বাভাবিক অধিকার যখন ক্ষুণ্ণ হয় বা ঝুঁকির মধ্যে পড়ে, যখন মানুষকে সুবিধাপ্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলি সুবিধাপ্রদানে বাধাগ্রস্ত হয়, ক্ষতিগ্রস্ত হয়- তখন অস্ত্রের ব্যবহার, আদালতের উপস্থিতি অনিবার্য হয়ে পড়ে। সুতরাং কখনো কখনো মানুষের জীবনের চেয়ে সম্পদ বা জড়পদার্থের মূল্য বেশি হতে পারে। হতে পারে এবং হয় বলেই পৃথিবীতে অস্ত্র আছে, অস্ত্রের ব্যবহার আছে এবং আদালতের মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ড দেবার ব্যবস্থা আছে। ক্ষেত্রবিশেষে জীবের জন্য কান্নার চেয়ে, জড়ের জন্য কান্নার গুরুত্ব বেশি হতেই পারে। যে জীব দেশের জন্য, আমজনতার জন্য দুর্ভোগের কারণ, সে জীবের জন্য কান্না শোভা পায় না।

কোটা সংস্কার আন্দোলনে যেসব তরুণকে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে প্রাণ দিতে হয়েছে তাদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা রেখে আমি শুধু নাশকতাকারীদের উদ্দেশ্যে কথাগুলো বলছি। সিনেমার ভিলেন মার খেলে স্বস্তি লাগে, আনন্দ লাগে- এজন্য পরিচালকরা নানা কায়দাকানুন করে ভিলেনকে মারার দৃশ্য দেখায়। বাস্তবের ভিলেনরা মার খেলে, মরে গেলে তাতে আনন্দ না পেয়ে দুঃখ পাবার কী আছে? সব মানব তো মানবসম্পদ না, মানবঘাতি, দুষ্কৃতিকারী, নাশকতাকারীও আছে। সব মানুষের মৃত্যু দুঃখের না, কিছু কিছু মানুষের মৃত্যু কাম্য এবং সুখেরও। অনেক খারাপ মানুষের মৃত্যুর দাবীতে মিছিল-মিটিংও হয়।


সরকারবিরোধিতা একটি গণতান্ত্রিক অধিকার। এটা এতোটাই ন্যায়সঙ্গত অধিকার যে, পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশেই সরকারের বিরোধিতা করার জন্য সংসদে বিরোধী দল থাকে। শুধু থাকে তাইই নয়, বিরোধী দলের জন্য, বিরোধী দলের প্রধানের জন্য রাষ্ট্রকর্তৃক প্রদেয় সুযোগসুবিধাও থাকে। অর্থাৎ বিরোধিতাও একটা আর্ট, একটা শিল্প। বিরোধিতাও মানুষের কল্যাণেরই জন্য।

রাষ্ট্রবিরোধিতা পৃথিবীর কোনো দেশেই স্বীকৃত নয়। তারপরেও সরকার যখন বৃহৎ জনগোষ্ঠীর অধিকারকে ক্ষুণ্ণ করে তখন বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর পক্ষে প্রথমে সরকারবিরোধিতা এবং সরকারের অনড় অবস্থানের কারণে ক্রমে ক্রমে তা রাষ্ট্রবিরোধিতায় গড়াতে পারে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসই এর প্রমাণ। এভাবে নিয়মতান্ত্রিক বিরোধিতা এবং আন্দোলনের মাধ্যমে পৃথিবীর বহু দেশ স্বাধীনতা পেয়েছে। তারমানে রাষ্ট্রবিরোধিতাও বৃহৎ জনগোষ্ঠীর অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য, তাদের কল্যাণের জন্য। এটাও একটা আর্ট, একটা শিল্প। মানুষকে সাথে নিয়ে একটা নিয়মতান্ত্রিকতার মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাবার একটা প্রত্যয়ী প্রক্রিয়া।


আওয়ামী লীগ সরকারের অনেক ব্যর্থতা আছে। এই ব্যর্থতার তালিকা করলে তা অনেক বড়ো হবে। এই দেশের একজন সচেতন মানুষ হিসেবে সে ব্যর্থতাগুলো আমার অজানা নয়। যারা ফেসবুকে এবং পত্রিকায় প্রকাশিত আমার লেখাগুলো নিয়মিত পড়েন, তারা নিশ্চয়ই একমত হবেন যে, আওয়ামী লীগের ব্যর্থতাগুলিকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের কঠোর সমালোচনাকারীদের মধ্যে আমি একজন। আওয়ামী লীগের সমালোচনা যদি না করি, সারাক্ষণই যদি তার সবকিছুকে “ভালো ভালো” বলি, তবে তো দলটি খুশীর বন্যায় আকাশে ভাসবে, সংশোধনের ব্যবস্থা নেবে না।

একজন নিখোঁজ মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে, দুইজন সফল মুক্তিযোদ্ধার সহোদর হিসেবে আমার ওই সমালোচনামূলক লেখাগুলো দেখে অনেক সময়ে আমার সুহৃদমহলও আমাকে নিয়ে শঙ্কায় পড়ে যায়, আমি কী তাহলে বিগড়ে গেলাম! এই তো গতকালই ফেসবুকে একটা পোস্টে লিখেছি “জীবনের মূল্য বেশি, নাকি জড়পদার্থের মূল্য বেশি”। অনেকেই ধরে নিয়েছেন, আমি মিরপুর দশ নম্বরের ধ্বংসযজ্ঞ দেখে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কান্নাকে কটাক্ষ করে এই স্ট্যাটাস দিয়েছি। কারণ, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী হত্যাকাণ্ডের স্বীকার হওয়া কারো জন্য দৃশ্যমান চোখের পানি ফেলেননি। আমি এই লেখাটা লেখার জন্য ওই স্ট্যাটাসের মাধ্যমে মানুষের প্রতিক্রিয়া জানতে চাচ্ছিলাম। আমি সেটা পেয়েছি। আমার সুহৃদ পাঠকবৃন্দ তাদের মূল্যবান কমেন্টের মাধ্যমে আমাকে এই লেখাটি লেখার জন্য অনুপ্রাণিত করেছেন।

বিশ্ব মিডিয়ায় সরকারকে নিয়ে নেতিবাচক প্রচারণা হচ্ছে, আমি তা নিয়ে লিখেছি। কারণ, বিশ্ব মিডিয়ায় সরকারের অবস্থান ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন আছে। সেই দায়িত্বে যারা আছেন, তারা তাদের দায়িত্ব পালনের ব্যাপারে এগিয়ে আসুক। ব্যর্থতার পাশাপাশি আওয়ামী লীগ সরকারের অর্জনও আছে। বছরের প্রথম দিন সারা দেশব্যাপী বই উৎসব একটা চমৎকার অর্জন। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন আরেকটা ভালো ও প্রশংসনীয় অর্জন।

কোটা সংস্কার আন্দোলনকে পূঁজি করে যে নাশকতাগুলো হয়েছে সেগুলো কোথায় হয়েছে? মূলত যোগাযোগ ব্যবস্থাভিত্তিক স্থাপনা গুলোতে! মেট্রোরেল, সেতু, ফ্লাইওভার, টিভি সেন্টার, সেতুভবন, ইন্টারনেট কানেকশন ইত্যাদিতে। সরাসরি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উপরে জীবননাশী হামলা হয়েছে। হামলাগুলোর প্রকৃতিই বলে দেয়, সরকারের অর্জনের প্রতি ঈর্ষাকাতর হয়ে এগুলো করা হয়েছে। অনেক যায়গায় হামলার পরে মিষ্টি ও খাবার বিতরণ করা হয়েছে। কারা করেছে? কোটা সংস্কার আন্দোলনের তরুণরা? না, তারা নয়। তারা মিষ্টি বিতরণের টাকা কোথায় পাবে? জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দেবার মতো সরঞ্জাম তারা কোথায় পাবে? ফলে এগুলো ছিল পরিকল্পিত হামলা। এ হামলার প্রকৃতি সরকারবিরোধী ছিল না, ছিল রাষ্ট্রবিরোধী। আন্দোলনের প্রকৃতি সরকারবিরোধী হলে তাকে মেনে নেওয়া যেত, কিন্তু রাষ্ট্রবিরোধী নাশকতা মেনে নেওয়া যায় না, এটা সহ্য করা যায় না, সহ্য করা উচিত না। এ ক্ষেত্রে সরকার কঠোর হবে সেটাই স্বাভাবিক।


আওয়ামীবিরোধী বিভিন্ন সংগঠন কোটা সংস্কার আন্দোলনের ব্যানারকে পূঁজি করে সরকারবিরোধী নাশকতা করবে সেটা বুঝতে খুব একটা বুদ্ধিমান হবার দরকার ছিল না। গণজাগরণ মঞ্চের বিরোধিতা, হেফাজতের সমাবেশ, নিরাপদ সড়কের জন্য ছাত্র আন্দোলনের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা এটা বুঝতে সহায়তা করে। আগের ওসব সরকারবিরোধী ইভেন্টগুলিতে এটাও প্রমাণিত হয়েছে যে, সরকারবিরোধী সংগঠনগুলির বপু যতো বিশালই হোক-না-কেন তাদের সাংগঠনিক ক্ষমতা প্রায় শূন্যের কোটায়। এদের অবস্থা ব্যঞ্জনবর্ণের চন্দ্রবিন্দুর মতো, অন্যের ঘাড়ের উপরে বসে ছাড়া স্বাধীনভাবে কিছু করার ক্ষমতা এরা রাখে না। ফলে সাংগঠনিক ক্ষমতাহীন এসব সংগঠনসমূহ ব্যঞ্জনবর্ণের চন্দ্রবিন্দুর মতো শিক্ষার্থীদের ঘাড়ে চেপে স্বার্থসিদ্ধির সুযোগ নিয়েছে। এরা যা করেছে তা ঠিক করেনি, খুবই অন্যায় করেছে। সরকারবিরোধী কাজ করতে গিয়ে এরা রাষ্ট্রবিরোধী অপতৎপরতা চালিয়েছে। রাষ্ট্রের অনেক ক্ষয়ক্ষতি করেছে। মানুষের জীবননাশের দায় তাদের আছে। রাষ্ট্রবিরোধী অপতৎপরতার এ এক অনিবার্য ফলাফল।

তবে আওয়ামী লীগও এ ব্যর্থতার দায় এড়াতে পারে না; কারণ, এই আন্দোলনকে এই পর্যায় পর্যন্ত গড়াবার ব্যর্থতার দায় তাদের আছে। এই সমস্যার সহজ সমাধান খুঁজে পাওয়া সম্ভব ছিল, যা অঙ্কুরেই সমস্যাটিকে বিনাশ করতে পারতো। সরকারি চাকরির বাইরে কর্মনিশ্চয়তা সৃষ্টি করা খুবই জরুরি। প্রতিবছর ২২ লাখ তরুণ কর্মবাজারে প্রবেশ করে, পাবলিক সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে চাকরি পায় গড়ে ৩ হাজারেরও কম, যা মাত্র ০.১৪%, বাকী থাকে ৯৯.৮৬%। এদের জীবনের নিশ্চয়তা তৈরি করতে হবে। যে তরুণ আজ গবেষণা করবে, সমাজ গড়বে সেই তরুণ আজ চাকরির জন্য জীবন দিচ্ছে। স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরে দেশের এ অবস্থার জন্য এই তরুণ সমাজ দায়ী নয়। তরুণদের কর্মনিশ্চয়তা দেশকেই এগিয়ে নেবে।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত