২৮ জুলাই, ২০২৪ ১৪:২৭
শারীরিক প্রতিবন্ধী চন্দ্রবাহার বাইরের অসম পৃথিবী থেকে নিজেকে লুকাতে, পরে থাকে ঘরের এক কোনে। অদম্য আগ্রহ আর চেষ্টায় শত বাধা অতিক্রম করে পড়াশুনাটা সে চালিয়ে যেতে চেয়েছে সবসময়। কিন্তু দরিদ্র বাবা-মার পক্ষে তিন সন্তানের পড়াশোনার খরচ চালানো সম্ভব হচ্ছিল না। এ অভাবের প্রধান বলি হল চন্দ্রবাহার। তার পড়াশুনা বন্ধ হওয়ার উপক্রম। প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য দেওয়া বর্তমান সরকারের মাসিক শিক্ষা উপবৃত্তি তার জীবন বদলে দিল। অভাবের সংসারে চন্দবাহারের উপবৃত্তির টাকা যেন চৈত্রের কাঠ ফাটা দুপুরে এক পশলা বৃষ্টির মত। শুধু চন্দ্রবাহার নয়, প্রায় ৫ কোটি মানুষকে সরকার সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় ১৩০টির মত ভাতা, উপবৃত্তি বা অনুদান দিচ্ছে।
সরকার বছরব্যাপী নগদ ভাতা, খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি ও সুলভ মূল্যে খাদ্য সরবরাহের লক্ষ্যে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় 2০২৪-২৫ অর্থবছরে বাজেটে ১ লাখ ৩৩ হাজার ২৭২ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। যা মোট বাজেটের ১৭ দশমিক ০৬ শতাংশ এবং গত অর্থবছরের তুলনায় ৭ হাজার কোটি টাকা বেশি। এ খাতে উপকারভোগী বাড়বে প্রায় ২০ লাখ, আবার অনেক ক্ষেত্রে বেড়েছে ভাতার অঙ্কও। মন্ত্রণালয়ের পরিপত্রে জানানো হয়, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির সব টাকা উপকারভোগীর জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবহার করে নিবন্ধিত মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসের (এমএফএস) মাধ্যমে দিতে হবে। ২০২৫ সালের ৩০ জুনের মধ্যে তা নিশ্চিত করতে হবে। কোন উপকারভোগীর আঙুলের ছাপ নেওয়া না গেলে বা তার জাতীয় পরিচয়পত্র না থাকলে এ নিয়ম শিথিল করা হতে পারে। সরকার প্রদত্ত নাগরিক সেবা প্রাপ্তিতে জনগণের ভোগান্তি কমাতে প্রতিটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ সেবাসমূহকে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে প্রদানের পাশাপাশি সেবা সহজীকরণে নিত্যনতুন উদ্ভাবনী কার্যক্রম চলমান রয়েছে। ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার ও উদ্ভাবনীর মাধ্যমে শহর থেকে প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত নাগরিক সেবা প্রদানে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করে সুশাসন প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গঠনের লক্ষ্যে সরকার কাজ করছে।
মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা ১০ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩০ হাজার টাকা করার সুপারিশ করেছে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়। বর্তমানে দুই লাখ মুক্তিযোদ্ধা প্রতি মাসে ২০ হাজার টাকা ভাতা পাচ্ছেন। বয়স্ক ও বিধবা ভাতায় নতুন ২ লাখ বয়স্ক ও বিধবাকে যুক্ত করে মোট ৬০ লাখ মানুষকে ভাতা সুবিধার আওতায় আনা হচ্ছে। বার্ষিক গড় আয় ১০ হাজার টাকার কম এমন ৬৫ বছরের বেশি বয়সী পুরুষ ও ৬২ বছরের বেশি বয়সী নারীকে বয়স্ক ভাতা দেওয়া হয়। বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা ভাতাভোগী বেড়েছে ২ লাখ ৬০ হাজার ৮০০; ফলে এ খাতে মোট সুবিধাভোগীর সংখ্যা ২৭ লাখ ৭৫ হাজার; এ কর্মসূচির আওতায় ১৮ বছর অথবা এর বেশি বয়সী নারী যাঁদের বার্ষিক গড় আয় ১২ হাজার টাকার নিচে তাঁরা প্রতি মাসে এ ভাতা পাচ্ছেন। মা ও শিশু সহায়তা কার্যক্রমের আওতায় এ অর্থবছরে উপকারভোগীর সংখ্যা ১৫ লাখ ৪ হাজার ৮০০ জন থেকে ১৬ লাখ ৫৫ হাজার ২৮০ জনে উন্নীতকরণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। মা ও শিশু সহায়তা কর্মসূচির আওতায় ভাতা ৮০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে এক হাজার টাকা করা হয়েছে।
৮০ বছর বা এর বেশি বয়সী প্রবীণ নাগরিকবৃন্দ ২০২৪-২৫ অর্থবছর থেকে প্রতি মাসে ৬০০ টাকার পরিবর্তে ৯০০ টাকা হারে ভাতা পাবেন। ক্যানসার, কিডনি ও লিভার সিরোসিস রোগীদের জন্য আর্থিক সহায়তা কর্মসূচির আওতায় চলতি অর্থবছরে ৩০ হাজার উপকারভোগীকে এককালীন ৫০ হাজার টাকা দেওয়া হচ্ছে। এ অর্থবছরে এ সুরক্ষা বেষ্টনীতে উপকারভোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ৫০ হাজারে। হিজড়া জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে ৬ হাজার ৮৮০ জন থেকে থেকে উন্নীত করে ১২ হাজার ৬২৯ জনকে ভাতার আওতায় আনার পরিকল্পনা করা হয়েছে। বেদে জনগোষ্ঠীর জন্য ভাতা প্রদান কার্যক্রম চলমান থাকবে।
অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী নিরাপত্তা বেষ্টনী সুবিধা বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দিয়ে বলেছেন, এ কর্মসূচির উদ্দেশ্য ও কারা ভাতা পাচ্ছেন তা নিয়ে আগামী ৩০ এপ্রিলের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করতে হবে। সেই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে অর্থ মন্ত্রণালয় বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সুপারিশ অনুযায়ী পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন তৈরি করবে। তিনি আরও বলেন, প্রতিবন্ধীদের স্বার্থ এবং অধিকার সুরক্ষায় সরকারের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। এ অর্থবছর প্রতিবন্ধী ভাতাপ্রাপ্তদের সংখ্যা বর্তমানে ২৯ লাখ থেকে বৃদ্ধি করে ৩২ লাখ ৩৪ হাজার জনে উন্নীত করা হবে। এছাড়া প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের উপবৃত্তির হার বিদ্যমান ৯৫০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১০৫০ টাকায় উন্নীত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে।
তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে বেশি উপকৃত হচ্ছে প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠী। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় প্রতিবন্ধী শনাক্তকরণ জরিপ কর্মসূচির মাধ্যমে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ডিজিটাল ডেটাবেজ তৈরি করেছে। এ তথ্যভাণ্ডার ব্যবহার করে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি ও শিক্ষার্থীদের ভাতা-শিক্ষা উপবৃত্তি প্রদানের পাশাপাশি তাঁদের কর্মসংস্থানের সুযোগও সৃষ্টি হচ্ছে। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী এবং নিরক্ষরদের জন্য প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে ১০৯টি পাঠ্য বইয়ের ডিজিটাল টকিং বুক চালু করা হয়েছে। ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য ডিজিটাল শিক্ষা উপকরণ তৈরি ও বিতরণ করা হচ্ছে। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের চলাচল নিরাপদ করার জন্য বিভিন্ন আধুনিক সুবিধা সংবলিত ডিজিটাল স্মার্ট হোয়াইট ক্যান বিতরণ করা হচ্ছে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘আমার জীবনের একমাত্র কামনা, বাংলাদেশের মানুষ যেন তাদের খাদ্য পায়, আশ্রয় পায় এবং উন্নত জীবনের অধিকারী হয়।’ জাতির পিতা তাঁর এ চিন্তার প্রতিফলন ঘটিয়েছেন আমাদের সংবিধানে। তিনি ১৯৭২ সালের সংবিধানের ১৫ (ঘ) অনুচ্ছেদে সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার, অর্থাৎ বেকারত্ব, ব্যাধি বা পঙ্গুত্বজনিত কিংবা বৈধব্য, মাতাপিতাহীন বা বার্ধক্যজনিত কিংবা অনুরূপ অন্যান্য পরিস্থিতিজনিত কারণে অভাবগ্রস্ততার ক্ষেত্রে সরকারি সাহায্য লাভের অধিকার সংযুক্ত করে সামাজিক নিরাপত্তাকে রাষ্ট্রীয় কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত করেন। সুতরাং বলা যেতে পারে সংবিধানের ১৫(ঘ) অনুচ্ছেদের উপর ভিত্তি করে জাতির পিতা সদ্য স্বাধীন দেশে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি চালু করেন, কেননা তাঁর সামগ্রিক চিন্তা-চেতনায় সমাজের ঝুঁকিপূর্ণ, অবহেলিত, প্রান্তিক ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর সামাজিক সুরক্ষা, জীবনমান উন্নয়নের বিষয়টি সদাজাগ্রত ছিল।
জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী সম্প্রসারণের সঙ্গে সঙ্গে সমাজের ঝুঁকিপূর্ণ ও অবহেলিত জনগোষ্ঠীর সামাজিক সুরক্ষাকে আইনি বলয়ের আওতায় আনার জন্য প্রণয়ন করেছে জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশল, ভবঘুরে ও নিরাশ্রয় ব্যক্তি (পুনর্বাসন) আইন ২০১১, শিশু আইন ২০১৩, প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন ২০১৩, পিতামাতার ভরণপোষণ আইন ২০১৩, নিউরোডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী সুরক্ষা ট্রাস্ট আইন ২০১৩ এবং বাংলাদেশ জাতীয় সমাজকল্যাণ পরিষদ আইন ২০১৯।
দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র থেকে দেশকে মুক্ত করতে প্রয়োজন সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ। দারিদ্র্য বিমোচনে রাষ্ট্রের বিভিন্ন পদক্ষেপের মধ্যে অন্যতম পদক্ষেপ হচ্ছে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচী, কেননা সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচী দারিদ্র্য বিমোচনে অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। দরিদ্র ও বৈষম্যের শিকার জনগোষ্ঠীর সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ব্যতীত উন্নয়নশীল দেশ হওয়া সম্ভব নয়। সরকার দেশের সব দরিদ্র ও ঝুঁকিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বদ্ধপরিকর। এ লক্ষ্যে প্রতি বছর সামাজিক সুরক্ষার আওতা ও বাজেট বরাদ্দ উভয় বৃদ্ধি করা হচ্ছে। এ খাতে বাজেট বরাদ্দ ২০০৮-২০০৯ অর্থবছরের তুলনায় প্রায় আট থেকে দশ গুণ বেড়েছে। দরিদ্র ও অসহায় মানুষকে সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় আনার জন্য দুর্যোগপ্রবণ এলাকা, দরিদ্রতম এলাকা এবং জনসংখ্যার ঘনত্বের অনুপাতের মত বিষয়গুলো নেওয়া হচ্ছে বিবেচনায়। সুবিধাবঞ্চিত মানুষের কাছে সরাসরি সেবা পৌঁছে দিতে ডিজিটাল প্রযুক্তির বিকল্প নেই। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগ ও এটুআইয়ের সহযোগিতায় শতভাগ সেবা কার্যক্রম ডিজিটাল করার জন্য কাজ করছে। চলতি অর্থবছরের মধ্যে শতভাগ ভাতাভোগী মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ভাতা পাবেন। সরকারের পাশাপাশি উন্নয়ন সহযোগী, এনজিও, বেসরকারি উদ্যোক্তা ও সচেতন মহলের সম্মিলিত প্রয়াসে আমরা ২০৪১ সালের উন্নত বাংলাদেশ গঠনে ভূমিকা রাখতে পারব।
আপনার মন্তব্য