ওমর ফারুক লুক্স

১৬ মার্চ, ২০১৫ ০১:২৩

ফারসীম মান্নান মোহাম্মদীর প্রতি কিছু প্রশ্ন

বই মেলায় একটি অনানুষ্ঠানিক বৈঠকে অংশ নেওয়া অপরিচিত কিছু লোকের সঙ্গে অভিজিৎ রায়ের দেখা হয়েছিল, সে বৈঠকের আয়োজক ছিলেন বুয়েটের শিক্ষক ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী। এই বৈঠক নিয়ে প্রশ্ন আছে অভিজিৎ রায়ের বাবা শিক্ষাবিদ অজয় রায় এবং মুক্তচিন্তা আন্দোলনের অনেকেরই। এ প্রসঙ্গ নিয়ে কিছু প্রশ্ন করেছেন- ওমর ফারুক লুক্স।

জনাব ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী,
আপনার প্রতি আমাদের কিছু জিজ্ঞাসা। সম্ভব হলে উত্তর দিবেন।

 

জনাব, আপনি তো মাত্র কয়েকদিন আগেও ফেসবুকে খুব অ্যাক্টিভ ছিলেন। রোজ তিন-চারটা স্ট্যাটাস দিতেন, একটা-দুটো ছবি পোস্ট করতেন। এগুলো আমাদের টাইমলাইনে ঘুরে বেড়াতো। ফেব্রুয়ারি মাসের ২৬ তারিখ বিকেল বেলা পর্যন্ত আপনাকে খুব সচল দেখা গিয়েছে ফেসবুকে। কিন্তু আকস্মিকভাবে অভিজিৎ রায়ের হত্যাকাণ্ডের পর থেকে আপনি নিশ্চুপ। বিষয়টা হয়তো খুবই সাধারণ। আপনি ব্যস্ত মানুষ। ফেসবুকে কখন সচল থাকবেন আর কখন অচল হবেন এটা আপনার ব্যাপার। কিন্তু আমাদের সন্দেহবাতিক মন, নানা প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে। অভিজিৎদার মত ব্যক্তির মৃত্যু আমরা মেনে নিতে পারছি না। তাই চোখ-কান খোলা রেখে নানা বিষয় অনুসন্ধান করছি।

জীবিত থাকতে অভিজিৎ রায়ের সাথে আপনার অনেক সখ্য ছিল তা আমরা নানাভাবে দেখেছি। যোগাযোগও ছিল। কিন্তু আমরা বড়ই আশ্চর্যান্বিত হলাম, অভিজিৎ রায় খুন হলেন আর আপনি বিন্দুমাত্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলেন না! দুনিয়ার এতো মানুষ লক্ষ লক্ষ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছে, আর আপনি এই বিষয়টা বেমালুম চেপে গেলেন কেন? হতে পারে এটাও আপনার ব্যক্তিগত কারণ।

কিন্তু আপনার দেয়া বইমেলার আড্ডার নিমন্ত্রণে অংশগ্রহণ করে বাসায় ফিরতে গিয়ে অভিজিৎদা খুন হলেন, এটা নিশ্চয়ই এখন আর ব্যক্তিগত নয়। আপনি নিশ্চয়ই এটা অস্বীকার করতে পারবেন না। অভিজিৎদার মৃত্যু স্বাভাবিক কোনো ঘটনা নয়, এটা কোনো সড়ক দূর্ঘটনা নয়, কিংবা ছিনতাইকারী বা অজ্ঞানপার্টির কবলে পড়ে মৃত্যুও নয়। তার মৃত্যু একটা পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। আর এই পরিকল্পনার পেছনে কারা জড়িত, কারা কলকাঠি নেড়েছে, কারা সহায়তা করেছে, এটা জানার অধিকার অবশ্যই আমাদের আছে। এটা আমাদের জানতেই হবে। আর এই জানার জন্য যতই ঘনিষ্ঠজন হোন না কেন সন্দেহের বাইরে কেউ নন। জনাব, বলবেন কি, অভিজিৎদার মৃত্যুর পর হঠাৎ করে আপনি অনলাইন জগত থেকে গায়েব হলেন কেন? না ফেসবুক এসেছেন, না মোবাইল খোলা রেখেছিলেন
[আপনার মোবাইলে কিন্তু অনেকবার কল দেয়া হয়েছে, কিন্তু সেটা বন্ধ পাওয়া গিয়েছে। তাই বিষয়টা নিশ্চিত হয়েই বলছি।] একটা বিবৃতি বা স্ট্যাটাস পর্যন্ত কেন দিল না অভিজিৎদারে নিয়ে। কারণটা কি?

অজয় স্যার যদি বিডিনিউজ২৪.কম-এ দেয়া সাক্ষাৎকারে প্রসঙ্গটা না তুলতেন তবে তো কেউই জানতো না যে, অাপনাদের আয়োজিত সভা থেকে বের হয়ে বাসায় ফেরার পথে অভিজিৎদাকে খুন করা হয়। আমরা সংবাদমাধ্যম থেকে জানতে পারলাম আপনি আর অভিজিৎ-বন্যা আহমেদ একসঙ্গে বের হলেন। অভিজিৎদা টি্এসসিতে যাবার পর সঙ্গে সঙ্গে খুন হলেন আর আপনি নীলক্ষেতে বন্ধুদের সঙ্গে রাতের খাবার খেতে গেলেন। নীলক্ষেতে পৌঁছানোর আগেই আপনার অভিজিৎদা ও বন্যা আহমেদের ওপর নৃঃশংস আক্রমণের খবর পাওয়ার কথা। সেখানে আপনি কি করে বন্ধুর হত্যার খবর পেয়েও ঘটনাস্থলে ফেরত আসলেন না কিংবা ঢাকা মেডিক্যালেও গেলেন না? অথচ তিনি আপনার অনুরোধেই এই আড্ডায় অংশগ্রহণ করেছিলেন। আচ্ছা, আপনার কি একটা বারের জন্য উচিৎ ছিল না, একটা বারের জন্য হলেও পুত্রশোকে মুহ্যমান অজয় স্যারের সঙ্গে দেখা করা? তাঁকে সহমর্মিতা জানানো? অথবা হাসপাতালে মৃত্যুপথযাত্রী বন্যা আহমেদের সাথে দেখা করতে যাওয়া? এটা কি কোনো ধরনের দায়িত্বশীল আচরণ? আমার বাসা থেকে বের হয়ে একজন অতিথি রাস্তায় গিয়ে খুন হয়ে যাবে, এটা জানার পরও আমি চুপ থাকবো, এটা কি স্বাভাবিক আচরণ বলে? আপনার এই নিরবতা আমাদের মধ্যে নানা প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে।

আচ্ছা, অভিজিৎদা হত্যাকাণ্ডের পর আপনার মনে কি কোনো সন্দেহ জাগেনি। কারা করতে পারে এই কাজ? কারা জড়িত থাকতে পারে এখানে? নিজের মনে কি কোনো অনুসন্ধান চালিয়েছেন? ওই দিনের প্রোগ্রামে কারা কারা উপস্থিত ছিল, তাদের নাম-ধাম পরিচয় কি একটাবারের জন্য হলেও খোঁজ নিয়েছেন? কাউকে জিজ্ঞেস করেছেন? এগুলো জানলে প্রকাশ্যে বলার দরকার নেই, বরং গোয়েন্দা পুলিশকে গিয়ে বলবেন আশা করি।


বুয়েটের একজন সম্মানিত শিক্ষক হিসেবে আপনার কাছে আমরা দায়িত্বশীল আচরণ আশা করেছিলাম, কিন্তু আফসোস! অভিজিৎদার হত্যাকাণ্ডের পর যেখানে আপনি হতে পারতেন গুরুত্বপূর্ণ তথ্যদাতা, কারণ শেষ মুহূর্তের আড্ডা বা আলোচনা সভায় অভিজিৎদা-বন্যা আহমেদ আপনাদের সাথেই ছিলেন। অথচ আপনি সেটা না করে গোটা বিষয়টা বেমালুম চেপে গেলেন। কেন? আপনি কি কিছু জানেন? অথবা কাউকে সন্দেহ করছেন, যার নাম-ঠিকানা প্রকাশ পেলে আপনার সমস্যা হতে পারে?!! তাই কি চুপ করে ছিলেন?

আমরা কোনোভাবেই বলছি না, আপনি এই ঘটনায় কোনোভাবে সম্পৃক্ত। আপনি পরিকল্পনাকারী, কিংবা অন্যকিছু। কিন্তু আপনার কি মনে হয় আপনার অজ্ঞাতসারে কোনোভাবে ব্যবহৃত হয়েছেন? একটু চিন্তা করে দেখুন। এই কথাটা বললাম, কারণ সংবাদ মাধ্যমে অজয় স্যারের সাক্ষাৎকার অনুযায়ী, খুনিরা অভিজিৎ রায়-বন্যা আহমেদের পেছন পেছন চা খেতে গিয়েছিল টিএসসি পর্যন্ত। এই বিষয়টা একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের জন্ম দেয়। এরা কারা? বাহিরের লোক নিশ্চয়ই কেউ নয়। মেলা থেকে যারা আড্ডা দিতে দিতে বের হয়েছিল তাদেরই কেউ কি এই খুনের ঘটনায় জড়িত?


বিডিনিউ্জ২৪-কে দেয়া আপনার প্রতিক্রিয়ার কিছু অংশ। "'ফারসীম বলেন, তিনি এই বিজ্ঞান সাময়িকীর সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন প্রথম দিকে এবং সম্পাদক মাহমুদ বুয়েটে তার বিভাগেরই ছাত্র। “প্রথম বছর দেড়েক উপদেষ্টা হিসেবে সে আমার কথা শুনেছে, কথা রেখেছে। কিন্তু পত্রিকাটির পরিসর যত বৃদ্ধি পেয়েছে, যত তার নিজের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেয়েছে, তত সে আমার উপদেশ থেকে দূরে সরে গেছে।” তবে এই ‘দূরে সরে’ যাওয়াকে বিষয়টি মাহমুদের নিজস্ব বিষয় হিসেবে দেখছেন তার শিক্ষক ফারসীম। “তার পত্রিকা, সে কীভাবে চালাবে, এটা তাকেই ঠিক করতে হবে। একথাও ঠিক, বেশ কিছু বেঠিক মানুষের সাথে সখ্য দেখা গেছে, তবে আমি জানামাত্রই সম্পাদককে সতর্ক করেছি। তারপরও ঠিক পদক্ষেপ নেওয়া বা না নেওয়া তার দায়িত্ব। আমি তার কোনোই দায় গ্রহণ করব না।” এই বক্তব্যের পর থেকে বোঝাই যাচ্ছে আপনার পেটে আরো অনেক কথা আছে। একটা হত্যাকাণ্ডের প্রতিক্রিয়া জানাতে আপনি অনেক গভীরে গিয়ে বক্তব্য দিয়েছেন, এই হত্যাকাণ্ডের সাথে এটা অপ্রাসঙ্গিক হলে আপনি নিশ্চয়ই তা বলতেন না। তাই আমরা আপনার কাছে থেকে আরো কিছু শোনার প্রত্যাশায়। আশা করি নিরাশ করবেন না।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত