তসলিমা নাসরিন

১৮ মার্চ, ২০১৫ ১১:৪০

প্রবীর ঘোষ পুরুষতান্ত্রিক সমাজের প্রতিনিধি

ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি ৩০তম বার্ষিক অধিবেশনে সভাপতির বক্তব্যে প্রবীর ঘোষ বিজ্ঞানলেখক, গবেষক ড. অভিজিৎ রায় সম্পর্কে কিছু আপত্তিকর বক্তব্য দিয়েছেন। সে বক্তব্য নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হচ্ছে সবখানে। এ বিষয়ে লিখেছেন তসলিমা নাসরিন

লক্ষ্য করলাম প্রবীর ঘোষের হোমোফোবিয়া নিয়ে ধর্মমুক্ত মানুষেরা বিস্মিত। আমি বিস্মিত নই। কারণ আমি প্রবীর ঘোষের সীমাবদ্ধতা এবং সংকীর্ণতা সম্পর্কে জানি। একসময় তাঁর বই পড়ে আমি মুগ্ধ হয়েছি। এখনও ধর্মীয় কুসংস্কারের বিরুদ্ধে তাঁর কাজকে আমি খুব গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি। এই কাজের বাইরে প্রবীর ঘোষ একটা অশিক্ষিত, অসভ্য লোক।

প্রবীর ঘোষ, যতদূর মনে পড়ে, নব্বইয়ের শুরুর দিকে আমার ‘নির্বাচিত কলাম’ এর বিরুদ্ধে কলম ধরেছিলেন,এবং আমাকে অকথ্য ভাষায় গালাগালি করে প্রবন্ধ লিখেছিলেন। ‘নির্বাচিত কলাম’ তখন পশ্চিমবঙ্গে খুব জনপ্রিয়, আনন্দ পুরস্কারও পেয়েছে। এসব তাঁর মোটেও সইছিলো না, নাকি সত্যিই তিনি আপাদমস্তক একটা নারীবিদ্বেষী মানুষ, ঠিক বুঝে পাইনি। তাঁর ওই লেখাটি পড়েই আমি বুঝি যে নাস্তিক হলেই বা মৌলবাদ-বিরোধী হলেই একটা মানুষ নারীর অধিকারের পক্ষে বা মানবতন্ত্রের পক্ষে থাকে না।

দু’হাজার সালের দিকে নির্লজ্জের মতো লোকটি আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। হেসে, আমার পাশে বসে, ফটো তুলে নিয়ে যান। প্রশ্ন উঠতে পারে, প্রবীর ঘোষ একটা নারীবিদ্বেষী লোক জেনেও কেন তাঁর সঙ্গে আমি দেখা করেছি। আমি দেখা করেছি কারণ নারীবিদ্বেষী লোকদের সঙ্গে দেখা করায় আমার আপত্তি নেই। শত্রুর সঙ্গে মুখদেখাদেখি বন্ধ করার বদলে আমি বরং বিতর্কে বিশ্বাসী।

তাছাড়া ভেবেছিলাম, প্রবীর ঘোষের পরিবর্তন হয়েছে। হয়তো তিনি কিছুটা শিক্ষিত আর সচেতন হয়েছেন। তাঁর মতের কোনও পরিবর্তন যে হয়নি, তিনি যে আগের মতোই ক্ষুদ্র, সংকীর্ণ, অশিক্ষিত, নারীবিদ্বেষী রয়ে গেছেন তা ২০০৯ সালে আমাকে নিয়ে তাঁর আরও একটি লেখা বা সাক্ষাৎকার পড়ে বুঝতে পারি। তিনি লিখেছেন ‘বাংলাদেশের ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসীদের আবেগকে আহত করে ধর্মীয় উন্মাদনা তৈরির দায় তসলিমার’।

তারপর, মুসলিম মৌলবাদীরা আমাকে যে দোষটা দেয়, তিনি তাই দিয়েছেন, আমার কাজে নাকি মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী শক্তি খুশি হয়েছে। এখানেই শেষ নয়, চরম হিপোক্রেটদের মতো পরে বললেন, আমি নাকি ধর্মীয় মৌলবাদীদের শক্তি বৃদ্ধি করেছি। স্বামীকে ডিভোর্স করে আমি যে একা জীবন যাপন করছি, আমার এই সৎ এবং পুরুষের অধীনতা মুক্ত জীবনকে তিনি ‘উচ্ছৃংখল জীবন’ বলেছেন, আমার লেখাতেও নাকি আছে উচ্ছৃংখলতা। পুরুষতন্ত্র যে কত কুৎসিত এবং নোংরা হতে পারে, তা প্রবীর ঘোষের তসলিমা-বিরোধী লেখা না পড়লে বোঝা যাবে না।

আমি আজও বুঝিনা অভিজিৎ রায়ের মতো বুদ্ধিমান একজন মানুষ কী করে প্রবীর ঘোষের মতো একটা মাথামোটা লোককে গুরু মেনে চলতেন। তাঁর নারীবিদ্বেষকে নিতান্তই তসলিমাবিদ্বেষ ভেবে হয়তো অভিজিৎ ভুল করেছেন অথবা প্রবীর ঘোষের প্রতি অতিরিক্ত শ্রদ্ধা থাকার কারণে তাঁর কোনও অযৌক্তিক কথাকে অযৌক্তিক বলে মেনে নিতে অভিজিতের অসুবিধে হয়েছে। কিন্তু আজ, যখন সমকামের পক্ষে অভিজিতের বই লেখা হয়ে গেছে, তখন প্রবীর ঘোষের থলের বেড়াল কিন্তু বেরিয়ে গেছে। তিনি শুধু নারীবিদ্বেষী নন, তিনি সমকামীবিদ্বেষীও।

আজ অভিজিৎ বেঁচে থাকলে প্রবীর ঘোষকে কী করে ডিফেণ্ড করতেন আমার জানা নেই। হয়তো অভিজিৎ প্রবীর ঘোষকে ডিফেন্ড না করে তাঁকে গুরু পদ থেকে অব্যাহতি দিতেন। আমাদের দুর্ভাগ্য, সেই অব্যাহতির দৃশ্যটা আমাদের দেখা হলো না।

 

প্রবীর ঘোষের বক্তব্যের লিংক:

আপনার মন্তব্য

আলোচিত