কবির য়াহমদ

০৪ জুলাই, ২০১৬ ০০:২৭

শোক কেবল শক্তিই নয়, প্রতিরোধেও রূপান্তর হোক

গুলশানে দেশি-বিদেশি সাধারণ মানুষদের জিম্মি করে চালানো হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অন্যতম কালো অধ্যায়। শোকবিহ্বল বাংলাদেশ বিনত শ্রদ্ধায় পালন করছে দুই দিনের রাষ্ট্রীয় শোক। অনাকাঙ্ক্ষিত এ ঘটনায় নিহত ও তাঁদের পরিবারের প্রতি গভীর শোক ও সমবেদনা।

এ ঘটনা নজিরবিহীন। দীর্ঘদিন ধরে জেঁকে বসা উগ্র জঙ্গিবাদ আমাদের সমাজের ক্রমে বিস্তৃত হচ্ছে এটা তার একটা প্রমাণ। এখনই এ অবস্থা থেকে উত্তরণ না হলে অন্ধকার এক ভবিষ্যৎ আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছে। এটা কেবল কোন রাষ্ট্রের একান্ত বিয়োগান্ত ও দুঃখজনক ঘটনাই না, এ শোক ও আশঙ্কা সার্বজনীন। মানবিকতার বিরুদ্ধে এ অপরাধের বিস্তার যত তাড়াতাড়ি রুখে দেওয়া যাবে দেশ তত আগে নিরাপদ হবে।

ধর্মীয় মৌলবাদীদের মাধ্যমে সংঘটিত এ সন্ত্রাসী হামলা সাম্প্রতিক সময়ের বাংলাদেশে বিস্তৃত হওয়া উগ্রবাদের দিকনির্দেশক। এজন্যে নির্মোহ দৃষ্টিতে এর বিচার-বিশ্লেষণ শেষে নির্মূলের পদক্ষেপ গ্রহণ করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। রাষ্ট্রীয় এ দায়িত্ব পালনে সরকার ও প্রশাসন দায়বদ্ধ এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। একই সঙ্গে দেশের সকল শ্রেণির মানুষকে উগ্রবাদীদের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং অন্য সকল উপায়ে বর্জন করা উচিত। উগ্রবাদের এ আস্ফালন রুখতে পরমুখাপেক্ষি না হয়ে আমাদের সকলের উচিত স্ব স্ব অবস্থান থেকে নিজ দায়িত্ব পালন করা।

ঢাকার গুলশানে গত শুক্রবার রাতে ৭ জঙ্গি কেবল সেখানে অবস্থানরত অর্ধশতাধিক লোককেই জিম্মি করে নি, তারা কার্যত জিম্মি করে রেখেছিল পুরো দেশকে। পুরো রাতের দুর্বিষহ, আতঙ্ক ও ভয়াল অবস্থায় উদ্বিগ্ন ছিল দেশের মানুষ। জঙ্গিদের প্রতিরোধ করতে গিয়ে দুই পুলিশ কর্মকর্তার নিহত হওয়া দেশপ্রেমের অনন্য নজির। দেশকে রক্ষা করতে গিয়ে নিজেদের জীবনকে তুচ্ছজ্ঞান করেছিলেন তারা। বাংলাদেশ তাঁদের এ মৃত্যু না চাইলেও দেশপ্রেমিক এ দুই পুলিশ কর্মকর্তাকে বাংলাদেশ স্থান দেবে গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায়।

গুলশানের এ জিম্মি সঙ্কটের নেপথ্যে যারা তারা ধর্মীয় মৌলবাদের একেকটা প্রতীক। বিশ্বব্যাপী চলমান ধর্মীয় সন্ত্রাসের একটা অংশ এ ঘটনা ও হত্যাকাণ্ড। বিশ্বব্যাপী ইসলামিক স্টেট, আলকায়েদা, বোকোহারামসহ যেসব জঙ্গি সংগঠনের অস্তিত্ব রয়েছে তারা জোরপূর্বক ধর্মপ্রচারের অভিপ্রায়ে এসব নারকীয় হত্যাকাণ্ড ঘটাচ্ছে। এটাকে বিচ্ছিন্ন কোন ঘটনা ভাবার কোন কারণ নাই। দেশিয় জঙ্গিরা অনাকাঙ্ক্ষিত এসব ঘটনার জন্মদাতা- এটাও ভাবার কোন কারণ নাই। আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন নয়; হিযবুত তাহরীর, আনসারুল্লাহ বাংলাটিম, জামায়াতুল মুজাহিদীন (জেএমবি) তথা দেশিয় জঙ্গিরা এসব ঘটনা ঘটাচ্ছে তদন্তপূর্ব এসব দাবি প্রকৃত ঘটনাকে আড়াল করার অপচেষ্টা হিসেবেই প্রমাণিত হবে। আমাদের দুঃখজনক অভিজ্ঞতা হচ্ছে আমরা সত্য বলতে গেলে ভাবি এই বুঝি হেরে যাচ্ছি, তাই অস্বীকার প্রবণতা জেঁকে বসে সকল স্তরে। এই অস্বীকার তত্ত্বের কারণে লাভবান হয় অপরাধিরা; আর অস্বীকার তত্ত্বের অতিপ্রচারের কারণে ভেবে বসি জয়ী আমরা। অথচ বাস্তবতা ঠিক উলটো!

তাই এমতাবস্থায় প্রকৃত সত্যকে স্বীকার করে ব্যবস্থা গ্রহণই হবে সরকার, প্রশাসনের প্রাথমিক দায়িত্ব। কারণ অস্বীকার কোন সমাধান নয়, বরং সত্যস্বীকার করে সমাধানের পথ নিরূপণই প্রকৃত উপায়।

গুলশানের ঘটনা দেশি, না বিদেশি জঙ্গিদের দ্বারা সংঘটিত হয়েছে এটা এই মুহূর্তের অগ্রাধিকারভিত্তিক আলোচনা নয়। বাংলাদেশ এ ঘটনায় আক্রান্ত হয়েছে। এর পেছনে বিদেশি জঙ্গি নাই বলে তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলা নেহায়েত অপরাধ। এক্ষেত্রে যদি আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট (আইএস) কিংবা অন্য যেকোনো জঙ্গি সংগঠনের যোগ থাকে তবে সেটা স্বীকার করা উচিত। ক্রমে বিশ্বমানবতার হুমকি হয়ে ওঠা আইএস সংশ্লিষ্টতা স্বীকার করলে বিশ্বের শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো বিভিন্ন ছুতোয় এখানে ঘাঁটি গেড়ে বসতে চাইবে এ আশঙ্কা অমূলক ও ঠুনকো। বরং অস্বীকার সংস্কৃতি অন্ধকারের পূজারি ধর্মান্ধ মৌলবাদকে আরও বেশি শক্তিশালি করবে।

গুলশানের এ দুঃখজনক ঘটনা আমাদের জাতীয় সঙ্কট। এমন পরিস্থিতিতে সরকারকে একা মোকাবেলা করতে হবে এমন ভাবনা অর্বাচীনতা। উগ্রবাদ নির্মূলে দলমত নির্বিশেষে সকলের কাজ করা উচিত। এখানে কে আওয়ামী লীগ, কে বিএনপি, কে বামপন্থী দল, আর কে অন্যান্য দল সেটা মুখ্য নয়। কারণ এ রাষ্ট্র আমাদের, রাষ্ট্রের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়লে রাজনৈতিক দলগুলো কাদের নিয়ে রাজনীতি করবে?  

গুলশানের জিম্মি সঙ্কটে পুলিশ, র‍্যাব, বিজিবি, সেনাবাহিনী সহ সকল বাহিনীর আন্তরিক প্রচেষ্টার জন্যে তাঁদেরকে ধন্যবাদ। একসঙ্গে এত লোকের প্রাণহানি ঠেকানো যায় নি, এটা আমাদের ব্যর্থতা। আর ১৩ জনের জীবিত উদ্ধার করা আমাদের সফলতা। তবে চূড়ান্ত বিচারে হয়ত এক্ষেত্রে আমরা প্রাথমিকভাবে ব্যর্থ। এখন এ ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নেওয়ার দরকার। আমাদের সম্মিলিত এ বড় ব্যর্থতাকে সাফল্য হিসেবে দাবি করার অপরিণামদর্শী কোন উদ্যোগ না নেওয়াই হবে মঙ্গলজনক।

গুলশান ট্রাজেডিতে দেশি-বিদেশি যে লোকগুলো প্রাণ হারিয়েছে তাদেরকে আর ফেরানো যাবে না ঠিক, কিন্তু আর যাতে কেউ এভাবে প্রাণ না হারায় সে ব্যবস্থা করা দরকার। এজন্যে জঙ্গি নির্মূলে সৎ ও আন্তরিক প্রচেষ্টা জরুরি।

জঙ্গি সন্ত্রাসীদের আক্রোশের শিকার হয়ে যারা প্রাণ হারিয়েছেন, আহত হয়েছে হয়েছেন তাঁদের প্রতি বিনত শ্রদ্ধা, শোকস্তব্ধ বাংলাদেশ। এ শোক ভেঙে পড়ার নয়। এ শোক শক্তিতে রূপান্তর লাভ করুক, এবং এ শক্তি উগ্রবাদ প্রতিরোধ করুক!

কবির য়াহমদ : প্রধান সম্পাদক, সিলেটটুডে টোয়েন্টিফোর ডটকম

আপনার মন্তব্য

আলোচিত