শিবলী নোমান

০৫ জুলাই, ২০১৬ ১১:১৫

দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক নিরাপত্তা বলয় তৈরি হোক

গুলশান হামলার ঘোষিত শোকপর্ব শেষ হয় নি এখনো। মনের ক্ষত কতোটা জাগ্রত, সে না হয় বাদই দিলাম। অথচ এরই মধ্যে নানামুখী বিশ্লেষণের ভাণ্ডার আমরা খুলে বসেছি। নিজেরাই তদন্তকারী থেকে শুরু করে বিচারকও হয়ে উঠেছি।

আমাদের গপ্পের গরু গাছে নাকি গোয়ালে সে খেয়াল নেই। এমন একটি ঘটনা, যা একটি বড় পরিকল্পনার অংশ, তার চুলচেরা তদন্ত ছাড়াই যখন আমরা পরস্পরবিরোধী তথ্যের মধ্যে একটির পক্ষে অন্ধ অবস্থান নিয়ে ফেলি, তখন কানাগলি ছাড়া সামনে যাবার আর কোনো পথ থাকে না।

ঘটনার পর চাক্ষুস বিবরণ এটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিন্তু সেই বিবরণটি কার এবং কী উদ্দেশ্যে, সেটিও ভেবে দেখা জরুরি। গুলশানে সে রাতের ঘটনায় কিছু মিসিং লিংক আছে। সেগুলো নিয়ে তদন্তকারীরা নিশ্চয় সচেতন থাকবেন। কিন্তু দুটো বিবরণ একটু আলাদা করে আলোচনা করা জরুরি।

নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক, যিনি নিজেকে জিম্মি ছিলেন বলে জানিয়েছেন, তার পক্ষের বিবরণটা অনেকটা এমন, জঙ্গিরা সুরা-কলেমা পড়তে পারে কি না এবং মাথায় হিজাব আছে কি না, সেই যোগ্যতা পরখ করে করে খুনের ফায়সালা করে।

দ্বিতীয় বিবরণটা আমরা পাই হোলি আর্টিজানের কর্মীর বরাতে। সেই বিবরণ এমন, অস্ত্রধারীরা বাংলাদেশের কোনো নাগরিককে মারা হবে না বলে জানিয়েছিলো। তারা বলেছিলো, বিদেশিদের মারতে তারা এসেছে। প্রথম বিবরণটা চাউরের পর এই ঘটনা আইএস-এর এবং তারা মুসলিমদের মারতে চায় নি বলে সাধারণ্যে ধারণা তৈরি হতেই পারে। এই বিবরণের যে প্রভাব তা জঙ্গি হামলা সংক্রান্ত সরলীকৃত ধারণাকে প্রতিষ্ঠিত করতে সহায়ক ভূমিকা রাখে।

পরের বিবরণে বোঝা যায়, তাদের মূল লক্ষ্য কোনো ধর্ম নয়, ছিলো বিদেশি নাগরিকরা।

প্রথম বিবরণটা নিয়ে আপাতত কিছু বলছি না। কারণ ওই বিবরণ যে পক্ষ থেকে এসেছে, তাকে নিয়ে ইতোমধ্যে কিছু প্রশ্ন উঠেছে। আমরা বরং পরের বিবরণটাতেই একটু নজর দিই।

তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম, আইএস শুধু বিদেশি নাগরিকদেরকেই হত্যা করার জন্য এই পরিকল্পনা করেছিলো। তাহলে সঙ্গে সঙ্গে এই প্রশ্নটাও উঠে আসবে যে, বাংলাদেশে তাদের আস্তানা তৈরি করতে বিদেশি হত্যা এতো জরুরি কেন হয়ে গেলো? তাও প্রায় এক বছর ধরে ওরা বেছে বেছে শুধু ইটালি আর জাপানের নাগরিককেই পেলো?

এই প্রশ্নটা আমার ছিলো গুলশানের ঘটনারও আগে। তাভেল্লা চেজারের পর যখন রংপুরে কুনিও হোশিকে খুন করে দিনাজপুরে আবার সেই ইটালিয়ান ধর্মযাজকের ওপর হামলা হলো। প্রশ্নটা ঠিক আমার মাথায় নয়, এসেছিলো, ওই ধর্মযাজকের এক স্বদেশি সহকর্মীর মাথায়। তিনি আমাকে বলেছিলেন, ইটালির সঙ্গে বাংলাদেশের যোগাযোগ অনেক পুরনো। কেন তারা আমাদেরকে টার্গেট করলো? এরপরই প্রশ্নটা আমার মাথায়ও ঘুরছিলো। যদিও সেই সময় বিষয়টাকে স্রেফ কাকতাল বলে এড়িয়ে গিয়েছিলাম।

কিন্তু এবার আর মোটেই সেপথে যাওয়া যাচ্ছে না। ইটালির সঙ্গে আমাদের তেমন একটা দহরম মহরম টাইপ কূটনৈতিক সম্পর্ক কখনো ছিলো বলে শুনি নি। কিন্তু ব্যবসা-বাণিজ্য এবং রেমিটেন্সের ক্ষেত্রে এই রাষ্ট্রটি বাংলাদেশের জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ। আর জাপান তো আমাদের সবচেয়ে বড় উন্নয়ন সহযোগী।

শুধু তাই নয়, পদ্মাসেতু নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগে যখন বিশ্বব্যাংক মুখ ফেরালো, জাইকা তখনও বাংলাদেশের পক্ষেই কাজ করেছে। মেট্রোরেলের মতো উন্নয়ন তৎপরতায় তারা সম্পৃক্ত হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ যে চারটি রাষ্ট্রকে ঘিরে নিজের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা সাজাচ্ছে, ইটালি ও জাপান তাদের মধ্যে অন্যতম। বাংলাদেশে এদের জন্য পৃথক অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরির কথাও চলছে। এমন একটা পরিস্থিতিতে গত এক বছর ধরে আইএস বাংলাদেশে ইটালি কিংবা জাপানের নাগরিককে হত্যা করে কী বার্তা দিতে চায়?

গুলশানের ঘটনার পর জাইকা এদেশ থেকে প্রত্যাহার করে নিতে পারে বলে কয়েকটি গণমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে। ইটালিতে বসবাসরত বাংলাদেশি প্রবাসীদের ওপর নজরদারি বেড়েছে বলেও প্রকাশিত হয়েছে। খুব সহজ একটি সমীকরণ টেনে নেয়া মোটেই অসমীচীন হবে না যে, তাহলে এই হামলার মূল উদ্দেশ্য ছিলো বাংলাদেশকে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করা।

এমন একটি পরিকল্পনা করে আখেরে আইএস-এর ফায়দা কী, তা বোধগম্য না হলেও এই মুহূর্তে বাংলাদেশকে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করলে আখেরে লাভ কার কার, সেই তালিকাটি এখন জরুরি হয়ে পড়েছে। আমার বিবেচনায় এই তালিকায়, দেশের ভেতরের গোষ্ঠী বা বাইরের বিশেষ শক্তি দুটোই যার যার স্বার্থ বিবেচনায় স্থান পাবে।

সারাবিশ্বেই এখন ভাঙনের পর্ব চলছে। মানুষগুলো বড় থেকে কেন জানি স্বেচ্ছায় ছোট হতে চাইছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে ব্রিটেনের বেরিয়ে যাওয়া এই তালিকায় শেষ সংযোজন। দীর্ঘসময় ধরে এশিয়ার উদীয়মান শক্তিগুলো যেভাবে আঞ্চলিক সংহতি তৈরির জন্য কাজ করেছে, সেগুলো নিয়েও আপাতত কিছু সংশয় তৈরি হয়েছে। কিন্তু তার চেয়ে বড় সত্য হলো, এ অঞ্চলে বাংলাদেশের ভৌগলিক অবস্থান এমন এক জায়গায়, যেখানে হানা দেয়া সম্ভব হলে পুরো অঞ্চলটাকেই টালমাটাল করে দেয়া সম্ভব।

কাজেই বাংলাদেশকে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে অচল করে দেয়ার এক অভিন্ন নীলনকশা নিয়ে কয়েকটি ‘কমন ইন্টারেস্টে’ এক হওয়া শক্তিগুলোর তৎপরতায় বাংলাদেশে যে সন্ত্রাসবাদিতার দেখা মিলছে, তার পরিণতি ভোগ করতে হবে এ অঞ্চলের ছোট-বড় সব রাষ্ট্রকেই।

আর সে কারণেই এই মুহূর্তে সন্ত্রাসবাদ কিংবা নিরাপত্তা ইস্যুতে অন্তত দক্ষিণ এশিয়ার রাষ্ট্রগুলোকে একযোগে কাজ করতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। এখানে সার্কের মতো একটি ফোরাম রয়েছে। খুব সহজেই নিজেদের নিরাপত্তা প্রশ্নে এখানে তাই একটি কার্যকর জোট গড়ে তোলা যেতেই পারে।

এ অঞ্চলের রাষ্ট্রনায়কদের সত্যিকার অর্থেই ‘পূবে তাকাও’ ঝান্ডা উড়ানো, অথবা সাম্রাজ্যবাদী শক্তির দীর্ঘমেয়াদী নাকগলানো- এই দুয়ের মধ্যে একটিকে বেছে নিতে হবে এখনই। নাহলে সামনে সবার জন্যই অভিন্ন বিপদ।

 

আপনার মন্তব্য

আলোচিত