ভায়লেট হালদার

০৮ জুলাই, ২০১৬ ২৩:৩৭

ঐশীর নয়, অসুস্থ সমাজব্যবস্থার মৃত্যু চাই

মাত্র ষোল বছরের মেয়েটির নাম ঐশী, যার থাকার কথা ছিল প্রাণচাঞ্চল্য উদ্যম সেই অতটুকুন মেয়ের নামের সাথে যুক্ত হয়েছে পিতামাতা হন্তারক।

কেন খুন করলো ঐশী তার বাবা-মাকে। পৃথিবীর সকল সন্তানের কাছে তার পিতামাতা সবচেয়ে আপনজন, যাদের কাছে সন্তান সবচেয়ে নিরাপদ। সন্তানের বিশ্বস্ত আশ্রয় মা-বাবা। সেই আশ্রয়কেই বা নিরাশ্রয় করতে চায়! কেনই বা করতে চায়! যে বয়সে সন্তানের হাতে থাকার কথা বই, বন্ধু-বান্ধবদের সাথে খেলাধুলা, নাচ, গান শোনা, হই হুল্লোড় করে বেড়ানোর কথা। মা-বাবার কাছে টুকটাক বায়না থাকার কথা সেই সন্তানের হাতে কি করে খুন হয়ে যায় পিতা-মাতা!কেনই বা ঐশী তার বাবা-মাকে খুন করতে বাধ্য হয়েছিল? পত্রপত্রিকার মারফত আমরা ঐশীর জবানবন্দী জানতে পেরেছি সে নিজমুখে পিতামাতা হত্যার দায় স্বীকার করেছে।

পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে ঐশী তার মায়ের বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছে, ‘’আমি ছিলাম মায়ের দুই চোখের বিষ। মা আমাকে দেখতে পারত না। বাসায় ফিরতে রাত হলেই গালমন্দ করত। চরিত্র নিয়ে কথা বলত। বলত, তুই আমার মেয়েই না। মায়ের ওপর আমার খুব রাগ হতো। মায়ের চেয়ে বাবা তার কাছে প্রিয় ছিল। আর সবচেয়ে প্রিয় ছোট ভাই ঐহী। ওরা কেউ আমাকে বুঝতে চায়নি। সব দোষ আমার। আমি কয়েকবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছি।‘’ অর্থাৎ ঐশী ছিল পরিবার থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন।
মা-বাবাসহ পরিবারের সবাই তাকে অপছন্দ করতো। সে হয়ে পড়ে একা। এ কারণে পরিবারের চেয়ে বাইরের পরিবেশ তাকে বেশি টানত। কেন ঐশীর মা তাকে অপছন্দ করতো? কেন ঐশী একা হয়ে পড়েছিল? নেশা জগতে যখন ঐশী প্রবেশ করে তখন ঐশীর মা-বাবার চোখে কি ঐশীর কোন পরিবর্তন চোখে পড়েনি? কি কারণে ঐশী মাদকদ্রব্যের নেশায় নিজেকে ডুবিয়ে রাখতো? ঐশীর নেশার টাকাই বা কোথা থেকে আসতো? মাদকদ্রব্য কতটা সহজলভ্য হলে ঐশীর মত টিনেজারদের হাতে মাদকদ্রব্য এসে যেত?

সন্তানের মুখের দিকে তাকালে বা সন্তানের কোন পরিবর্তন প্রথমেই মায়ের চোখে আগে ধরা পড়ে। ঐশীর পিতামাতা কি কোন সহযোগিতা করেছিল ঐশীকে মাদকমুক্ত করতে? তার প্রতি কোন সহমর্মিতা দেখিয়েছিল? সন্তানকে ভুল পথ থেকে ফিরিয়ে আনতে কোন উদ্যোগ কি তারা নিয়েছিল? কোন ডাক্তারের পরামর্শ গ্রহণ অথবা রিহ্যাবে পাঠানোর ব্যবস্থা কি করেছিল তারা? কাদের হাত ধরে ঐশীরা নেশার জগতে প্রবেশ করে? কেনই বা ঐশী মাদকের নেশায় নিজেকে আচ্ছন্ন করলো। বাবা-মা আর ছোটভাই নিয়েই ঐশীদের সংসার। সেখানে কি এমন বিষয় ছিল যা ঐশীকে মাদক বেছে নিতে হলো! মা-বাবাকে হত্যা করতে হলো! নেশার জন্য প্রতিদিন একটা বড় অংকের অর্থের দরকার হতো, বাড়ি থেকে নানা কৌশলে বাবা-মায়ের কাছ থেকে টাকা নিত সে, একটা পুলিশ অফিসারের বেতনই বা কত? কিভাবে তার বাবা-মাই বা টাকার যোগান দিত! এমন হাজারও জিজ্ঞাসা আমার, আপনার...

খবরে জানা যায়, ঐশী পিতামাতা হত্যার দায় স্বীকার করে নিয়ে পুলিশকে জানিয়েছিল, তার এক বন্ধু উচ্চমাত্রার ঘুমের ট্যাবলেট এনে দেয় ঐশীকে। ঐশী ট্যাবলেটগুলো কফির সঙ্গে মিশিয়ে তার বাবা-মাকে পান করায়। বাবা-মা দুজনই কফিপানে অচেতন হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। তারপর ঐশী হত্যা করে তার মা-বাবাকে। টুকরো করার জন্য বাসায় ধারালো অস্ত্র না পাওয়ায় লাশ টুকরো করতে পারেনি। নিজ হাতেই ঐশী ঘরের মেঝের রক্ত মুছে পরিষ্কার করে তারপরে গোসলও করে।

২০১৩ সালের ২৫ আগস্ট আদালতে ঐশী বলে, ‘২০১৩ সালের ১৪ আগস্ট আমি ছয় পাতা ঘুমের বড়ি কিনেছিলাম। রাত ১১টার পর তিন পাতা বাবার কফিতে মিশিয়ে পান করাই। আর মায়ের কফিতে তিন পাতা মেশাই। কফি পান করার পর তাঁরা ঘুমিয়ে পড়েন। পরে আমি চাকু দিয়ে বাবাকে স্ট্যাব করি। এরপর বাবা মারা যান। বাবাকে হত্যার পর আমি হুইস্কি পান করি। বাবাকে হত্যার পর একইভাবে মাকে চাকু দিয়ে স্ট্যাব করতে থাকি। একপর্যায়ে মা গোঙাতে থাকেন। এরপর মা আমার কাছে পানি চান। আমি তাঁকে পানি খাওয়াই। এরপরও মা যখন মারা যাচ্ছিলেন না, তখন মায়ের গলায় চাকু দিয়ে স্ট্যাব করতে থাকি। পরে মা মারা যান। বাবা-মাকে হত্যার পর কাজের মেয়ে সুমিকে ডাকি। দুজনে লাশ টেনে বাথরুমে রাখি। পরে কৌশলে ছোট ভাইকে নিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে যাই।’ আদালতে ঐশী আরো জানায়, মা স্বপ্না রহমানকে হত্যার পর বঁটি দিয়ে চাবির গোছা কেটে চাবি নেয় সে। এরপর লকারের তালা খুলে নগদ প্রায় লাখ টাকা ও স্বর্ণালংকার নিয়ে সকালে কাজের মেয়ে সুমি, ছোট ভাই ঐহীকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। হত্যার পর দেশের বাইরে চলে যাওয়ারও পরিকল্পনা করে ঐশী।

ঐশীর এ স্বীকারোক্তি অসংলগ্ন ও অসত্য বলেই মনে হয়েছে। একেক সময়ে একেক রকম কথা বলেছে। কাকে আগে, কাকে পরে নাকি বাবা-মা দুজনকেই একসাথে হত্যা করেছিল এ বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে, কেননা ঐশীর জবানবন্দীর মধ্যে ভিন্নতা খুঁজে পাওয়া যায়। ঐশী তার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেওয়ার পাশাপাশি বেশ কয়েকবার আদালতে মা-বাবাকে খুনের কথা অস্বীকার করে। ট্রাইব্যুনালে এক লিখিত বক্তব্যে ঐশী জানায়, ঘটনার সময় সে অন্য স্থানে ছিল, তখন সে তিনি মদ পান করছিলেন। ঘটনা জানার পর সে পুলিশের কাছে যায়। ঐশীকে গ্রেপ্তারের পর পুলিশ বড় বড় লাঠি দিয়ে তাকে বেদম মারধর করে। মা-বাবাকে হত্যার কথা স্বীকার করতে বলে। স্বীকার না করলে তাকে আবারও রিমান্ডে নেওয়ার ভয় দেখায় পুলিশ। পরে বাধ্য হয়ে সে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। ঐশীর এই জবানবন্দী দেয়ার পেছনে অন্য কোন মোটিভ লুকানো আছে কিনা, কেউ তাকে হত্যার দায়ে ফাঁসিয়েছে কিনা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন ছিল!

ঐশীর আইনজীবী মাহবুব হাসান রানা বলেছেন, ‘ঐশীকে নিম্ন আদালত যে রায় দিয়েছেন, তাতে অনেক ধরনের ত্রুটি রয়েছে। আমরা আপিল করেছি।‘

আইনজীবী ফৌজদারি মামলার বিশেষজ্ঞ এস এম শাহজাহান বলেছেন, ‘তার বিচার প্রক্রিয়া ছিল ভুলে ভরা। মিথ্যা সাক্ষীর ওপর ভিত্তি করে তাকে সাজা দেওয়া হয়েছে। এছাড়া বয়সের ক্ষেত্রে মামলার বাদীর বক্তব্য গ্রহণ করেননি আদালত।‘

ঐশীর চাচার বক্তব্যনুযায়ী, ‘ঐশীর জন্ম ১৯৯৬ সালে। ঘটনার সময় ঐশীর বয়স ছিল মাত্র ১৬ বছর। তাই বয়স অনুযায়ী শিশু আদালতে ঐশীর বিচার হওয়ার কথা ছিল। এ ছাড়া ঘটনার সময় তিনটি ধারালো অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে মর্মে তদন্ত কর্মকর্তা তার প্রতিবেদনে উল্লেখ করলেও তিনি আসামি ঐশীর হাতের আঙুলের ছাপ আদালতে হাজির করেনি।‘

এতটুকু একটা মেয়ে, এত শান্ত মাথার কফিতে ঘুমের ঔষধ মিশিয়ে খাইয়ে দিয়ে একাই পরপর দুটি হত্যাকাণ্ড ঘটানো অসম্ভবই বটে। পাঠক, একবার ভেবে দেখুন, কেউ যদি প্রতিদিন চা বা কফি মগভর্তি করে পান করে সে চা, কফি মুখে দিলেই স্বাদের ভিন্নতা বুঝতে পারে। একটি কিংবা দুটি নয় ৩০পিস ঘুমের ট্যাবলেট মগের কতটা অংশ দখল করে অনুমান করে নিন। ঘুমের ট্যাবলেট তিতা স্বাদযুক্ত, তার সাথে যতই চিনি মেশানো হোক না কেন স্বাদে প্রতিদিনের সাধারণ কফির মত হবে না। স্বাদের ভিন্নতা থাকবেই। মাকে খুন করার পরে ঐশী সময় পায়, এরপরে বাবা বাড়িতে ফিরে এলে তাকেও ৩০টা ট্যাবলেট মিশিয়ে কফি পান করায়। ঐশীর মা সাধারণ কফির চুমুকে টের না পেলেও বাবা কেন টের পেল না! তিনি তো পুলিশে চাকুরী করতেন। মেয়ের অস্বাভাবিকতা কি পুলিশ বাবার চোখে একবারও পড়েনি? যে মা ঐশীকে দেখতে পারতো না সে মেয়ের হাতেই কফি পান করলো? কোন অসংলগ্নতা মায়ের চোখেও পড়েনি? এরপরে আসি, পিতামাতা হত্যার পরে ঐশী স্বাভাবিক ছিল, গোসল করেছিল, তারপরে সে ঘর থেকে বেরিয়ে গেছে। এতটুকু বয়সের একটা মেয়ের পক্ষে পরিকল্পনা করে ঠাণ্ডা মাথায় পিতামাতাকে হত্যা করা সম্ভব কিনা! হত্যার পরে খুব শান্ত স্বাভাবিক থাকা প্রফেশনাল কিলার ছাড়া কারো পক্ষে সম্ভব কিনা? প্রিয় পাঠক একবার হলেও ভেবে দেখবেন।

কে তুলে দিয়েছিল ঐশীর হাতে ছয়পাতা (৬০) ঘুমের ট্যাবলেট! কারাই বা বিক্রি করেছিল! এসব অসৎ ঔষধ ব্যবসায়ীর কি সাজা হয়েছে? কারা ঐশীর হাতে মাদক তুলে দিয়েছিল? সেসব মাদক ব্যবসায়ীদের আইনের আওতায় আনা হয়েছে? তাহলে নেশাগ্রস্থ ঐশীর কর্মকাণ্ডের জন্য কেন সে একাই এমন চরম শাস্তি পাবে? শিশুকিশোর অপরাধ সংশোধনাগারে রেখে তাকে সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে আনা যেত।

বেশ কয়েকদিন ধরে অনলাইন নিউজ পোর্টালে ’ঐশীর ফাঁসি ঈদের আগেই’ শিরোনামে খবর প্রকাশিত হচ্ছে। ঐশী যদি পিতামাতার খুনি বলেও প্রমাণিত হয় তবে তার ফাঁসি কি করে দেবে! কেননা সে যখন খুন করেছিল তখন তার বয়স ছিল মাত্র ষোল বছর। সে ছিল পরিবারের থেকে ভালবাসা বঞ্চিত, তার প্রতি পিতামাতার অবহেলা তাকে বহির্মুখী করে তুলেছে। ঘরটা মানুষের জন্য আনন্দের, ঐশীর জন্য তা ছিল নিরানন্দ। বাইরের জগত তার হাতে আনন্দ স্ফূর্তি আর বিনোদনের নামে তুলে দিয়েছে মাদকদ্রব্য। যে নেশার জগতে ঐশী হারিয়ে গিয়েছিল, যেখানে তার বিবেক, বিচার-বিবেচনাবোধ, মানবিক জীবন লুপ্ত হয়েছিল। শুধু একজন ঐশী নয় অগণিত ঐশী চরম অমানবিকতার শিকার আজ বাংলাদেশে, জীবনের মূল্যবোধ তাদের কাছে থেকে কেড়ে নিয়ে মাদক তাদের বানায় নির্বোধ। যদি ঐশীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় তবে তা হবে সমাজের জন্য তিরস্কার।

আমি ঐ সমাজের ফাঁসি চাই, যে সমাজ ঐশীদের পৃথিবীর আলো-বাতাস দেখায়, কিন্তু তার জন্য সুস্থ, সুন্দর আর মানবিক পরিবেশে বেঁচে থাকার নিরাপত্তা দিতে পারে না। আমি ঐ সমাজের ফাঁসি চাই, যে সমাজে পিতা-মাতা সন্তান জন্ম দেয় কিন্তু সন্তানকে প্রকৃত মানুষরূপে গড়ে তুলতে ব্যর্থ। আমি ঐ সমাজের ফাঁসি চাই, যে সমাজে ছোট ছোট শিশুদের হাতের নাগালে মাদকদ্রব্য পৌঁছে যায়। আমি ঐ সমাজ ব্যবস্থার ফাঁসি চাই, যেখানে শিশু-কিশোরদের নিরাপদ নিশ্চিত জীবনের ব্যবস্থা করতে পারে না। আমি ঐ সমাজের ফাঁসি চাই, যে সমাজে শিশু অধিকার ও মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হয়। আমি ঐ সমাজের ফাঁসি চাই, যে সমাজে মাদকদ্রব্য সহজলভ্য। যে সমাজ মানব শিশুকে মানব অধিকার থেকে বঞ্চিত করে অমানুষ তৈরি করে আমি ঐ সমাজের ফাঁসি চাই।

আমি ঐশীর ফাঁসি চাই না। কেননা ঐশীর মৃত্যুদণ্ড আমাদের সমাজ ব্যবস্থার দিকে আঙ্গুল তুলে অট্টহাসি হাসছে।

ভায়লেট হালদার : নারীবাদী লেখক ও 'আরক' পত্রিকার প্রধান সম্পাদক।
এ বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত