ইয়াহইয়া ফজল

২৬ জুলাই, ২০১৬ ২৩:০৯

‘সিলেট নিউজ- ওয়ান’ ও রাহমান ভাই

সিলেট অফিস থেকে কালের কণ্ঠ ঢাকা অফিসে প্রতিদিন আমরা যে ফাইলগুলো পাঠাই সেগুলোর নামকরণ করা হয় ‘সিলেট নিউজ ওয়ান’। প্রথম ফাইলটার নামের শেষে ওয়ান পরেরটার শেষে টু এরকম। সেই ২০০৯ সালের শেষভাগে যখন আমরা কালের কণ্ঠে কাজ শুরু করলাম তখন থেকেই প্রতিদিন এরকম চলছে। দীর্ঘদিনের চর্চা। কারেন্ট নিউজগুলো সাধারণত রাহমান ভাই করতেন। তাই এই নামে ফাইলটা তিনিই বেশি ক্রিয়েট করতেন। নিউজ থাক বা না থাক রাহমান ভাই অফিসে এসে কম্পিউটার চালু করে প্রথমেই একটা ওয়ার্ড ফাইল বানিয়ে নিতেন। স্বভাবতই প্রথম ফাইল তাই নাম হ‌তো ‘সিলেট নিউজ- ওয়ান’।

গত সোমবার (২৫ জুলাই) দুপুরের বিরতির পর অফিসে ফিরে যখন কাজ শুরুর প্রস্তুতি নিচ্ছি ঠিক এমন সময় ফোনটা এলো নূর ভাইর মোবাইলে। ওপাশে কথা বলা শেষ হতেই নূর ভাই তাগাদা দিয়ে বললেন, দ্রুত হাসপাতাল যাও। রাহমানের অবস্থা বোধ হয় ভালো না।

নূর ভাইয়ের বলা ‘ভালো না’ শব্দটা কেন জানি আলাদা করে কানে বাজলো। রাব্বি ও আমি প্রায় দৌড়ে নিচে নেমে মোটরসাইকেলে ছুটলাম হাসপাতালে। কিভাবে হাসপাতালে পৌঁছলাম বলতে পারব না। গিয়ে দেখি সব শেষ...

কিছুক্ষণ হতভম্বের মতো দাড়িয়ে থাকা। একটু স্বাভাবিক হতেই প্রথমে মনে হলো নূর ভাইকে খবরটা জানানো দরকার। ফোন দিলাম। ওপাশে নূর ভাই হ্যালো হ্যালো বলছেন। আমি কি বলব শব্দ খোঁজে পাই না। শেষে বললাম, সব শেষ।

নূর ভাই যা বুঝার বুঝে গেলেন। বললেন, তুমি থাকো আমি আসছি। প্রাথমিক ধাক্কা সামলে আমি আর রাব্বি পরিচিতজনদের ফোন দেওয়ায় ব্যস্ত হলাম। হঠাৎ মনে হলো ফেসবুকে খবরটা জানিয়ে দিলে সহজেই সবাই জেনে যাবে। ফেসবুকে ঢুকে লিখলাম- ‘রাহমান ভাই আর আমা‌দের মাঝে নেই’। এই ছয়টি শব্দ লেখতে আমার অনেকক্ষণ লেগে গেল, হাত তো রীতিমতো কাঁপছে।

খবর পেয়ে প‌রি‌চিতজনরা আস‌তে শুরু করলেন। রাহমান ভাইদের আত্মীয়রা আর গণমাধ্যমের অতি পরিচিত মুখগুলো। একটা সময় সিনিয়রদের সবাই চলে এলেন। সবাই মিলে পরবর্তী করণীয় ঠিক করতে ব্যস্ত হলেন। রাহমান ভাইয়ের ছোট ভাই কিছুক্ষণ পরপর নাকের কাছে হাত নিয়ে বুঝার চেষ্টা করেন রাহমান ভাইয়ের শ্বাস-প্রশ্বাস চলছে কিনা। সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে তিনি কাজটি করলেও আমার চোখে তা এড়ায় না। ডাক্তার মৃত্যু নিশ্চিত করার পরও তিনি আশা ছাড়তে পারেননি তখনও।

মরদেহ গোসল করানোসহ পরবর্তী কাজগুলো ঠিক হয়ে যাওয়ার পর সবাই ভাগ হয়ে কাজে লেগে গেলেন। নূর ভাই নিচে নেমে বললেন, সংবাদটা ঢাকা অফিসে পাঠাতে হবে। অন্য হাউসগুলোও তথ্য চাইবে।

আমাকেও এরই মধ্যে সহযোদ্ধাদের অনেকে  ফোন দিয়েছেন। নিউজ করতে হবে, রাহমান ভাই সম্পর্কে খুঁটিনাটি তথ্য চাই তাদের।

নূর ভাই ও আমি আপাতত ফিরে আসি অফিসে। রাব্বি মরদেহের সাথে যায় কাজিরবাজার মাদ্রাসায়। সেখানে গোসল করানো হবে রাহমান ভাইকে।

অফিসে ঢুকতে ঢুকতে নূর ভাই বলেন, দ্রুত নিউজটা ছেড়ে আবার আমাদের বেরুতে হবে। নিউজ ছাড়া হলো। কাজ শেষ। আমরা বেরিয়ে পড়ি ডায়াবেটিক হাসপাতালের উদ্দেশ্যে। গোসল শেষে রাহমান ভাইয়ের মরদেহ ওখানেই নিয়ে আসা হবে।

সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে হঠাৎ বিষয়টা মাথায় আসে- ‘সিলেট নিউজ ওয়ান’। কেমন যেন থমকে যাই। হঠাৎ পৃথিবীটাকে বড় নিষ্ঠুর লাগে।

হুট করেই পেছনে ফিরে গেলাম। চোখের সামনে ভেসে উঠলো একটি দৃশ্য- সি এম মারুফ ভাইয়ের মৃত্যুর পর সম্ভবত তাঁর জানাজার নামাজের ছবি দেখতে দেখতে রাহমান ভাই আনমনে বলেছিলেন, সংবাদের ছবি তুলতে তুলতে মারুফ ভাই ই সংবাদ হয়ে গেলেন।

রাহমান ভাইও তো সংবাদ হয়ে গেলেন! গত ছয় বছর ধরে বেশিরভাগ দিন যে মানুষটি অফিসে এসে ‘সিলেট নিউজ ওয়ান’ লিখে কাজ শুরু করতেন সেই মানুষটিরই মৃত্যু সংবাদ লিখে পঠাতে হল ‘সিলেট নিউজ ওয়ান’ নামে। বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। আহা কত ঠুনকো, অত অনিশ্চিত মানুষের জীবন।

মারুফ ভাইকে নিয়ে দুঃখ করে রাহমান ভাই যেদিন কথাটি বলেছিলেন সেদিন আমরা কেউ কি ঘুণাক্ষরে ভেবেছিলাম এমন অকালে নিজেই সংবাদ হয়ে যাবেন রাহমান ভাই...

লেখক: সাংবাদিক

আপনার মন্তব্য

আলোচিত