রনেন সরকার রনি

০৫ আগস্ট, ২০১৬ ০০:৪৭

আখতার আহমদ : রাজনীতির এক ধ্রুবতারার নাম!

১৯৬৭ সালের মাঝামাঝি সময়। ৬ দফার আন্দোলন এগিয়ে চলেছে স্বায়ত্বশাসন প্রতিষ্ঠার আন্দোনের দিকে। সেই উত্তাল সময়ে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ফিল্ডমার্শাল আইয়ূব খান সিলেট সফরের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। শুধু তাই নয় প্রেসিডেন্ট আইয়ূব খান সুনামগঞ্জের হাওরে গিয়ে পাখি শিকারেরও আগ্রহ প্রকাশ করেন। আইয়ূব খানের ঐতিহাসিক সেই সিলেট সফর বানচাল করার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করে তৎকালীন ছাত্রসমাজ। তারা কালো পাতাকা প্রদর্শনের কর্মসূচী ঘোষণা করেন। সেই সাথে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় আইয়ূব খানের সভায় জুতা নিক্ষেপ করার। কিন্তু নির্ধারিত সময়ে নিধারিত ব্যক্তিগণ আইয়ূব খানকে জুতা নিক্ষেপ করতে ব্যর্থ হন। পরে এক ছাত্রনেতা তার সহযোগীদের নিয়ে কীন ব্রিজের উপর থেকে আইয়ূব খানের উদ্দেশ্যে জুতা নিক্ষেপ করে কর্মসূচী সফল করেন। জুতা নিক্ষেপের সফল কর্মসূচীতে নেতৃত্বদানকারী সেই ছাত্রনেতার নাম আখতার আহমদ। অকোতোভয় বিপ্লবী বীর মুক্তিযোদ্ধা আখতার আহমদ।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিভীষিকাময় সময়ে সিঙ্গাপুরের এক যুদ্ধবিদ্ধস্ত বাঙ্কারে তাঁর জন্ম। ১৯৪৩ সালের ২৪ জুলাই। যুদ্ধ মাথায় নিয়ে তাঁর জন্ম, আবার সংগ্রামের মধ্য দিয়েই তিনি বেড়ে ওঠেন। ১৯৬০ সালে ম্যাট্রিক পাশ করেই জড়িয়ে পড়েন সক্রিয় রাজনীতিতে। বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন, ৬ দফা, ১১ দফা, আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন পেরিয়ে তিনি যখন অবতীর্ণ হলেন একাত্তরের রনাঙ্গনে, তখন তিনি সিলেট তথা বাংলাদেশের এক গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক নেতা। সত্তরের নির্বাচনে প্রাদেশিক পরিষদের প্রার্থী হিসাবে তিনিই প্রথম মনোনীত হয়েছিলেন। কিন্তু তিনি রাজী না হওয়া এডভোকেট লুৎফুর রহমানকে দলের পক্ষ থেকে মনোনয়ন দেওয়া হয়।

বালাগঞ্জের গহরপুর প্রাইমারী স্কুল থেকে পাঠশালা শেষে ভর্তি হলেন দি এইডেড হাইস্কুলে। তারপর মদন মোহন কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক এবং এম.সি কলেজ থেকে বি.এ পাশ করেন। ১৯৬৫ সালে সিলেট জেলা ছাত্রলীগের প্রথম নির্বাচিত কমিটির সাধারণ সম্পাদক হন। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে তিনি সিলেট জেলা মুজিব বাহিনীর প্রধান হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। স্বাধীন বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত প্রথম রাজনৈতিক দল জাসদ এর প্রথম কেন্দ্রীয় কমিটির সহ সম্পাদক ছিলেন। স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তৎকালীন ছাত্রনেতা সিরাজুল আলম খান, কাজী আরেফ আহমদ, আব্দুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে ১৯৬২ সালে গঠিত স্বাধীনতার ‘নিউক্লিয়স’- এ তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। সিলেটে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আন্দোলনও গড়ে উঠেছিল তাঁরই তত্ত্বাবধানে তাঁর উত্তরসুরীদের নেতৃত্বে। স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশেও বীর মুক্তিযোদ্ধা আখতার আহমদের দিন কেটেছে জেলে কিংবা আত্মগোপনে। জেল-জুলুম-হুলিয়া-দল-সংগঠন এরই মাঝে আবার সংসারী হওয়ারও ডাক পড়ে।

১৯৮২ সালের ৯ মার্চ তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। জীবন সংগ্রামে পরীক্ষা দিতে সহযোদ্ধা-সহধর্মিনী হয়ে আসেন বেগম শামীম আখতার। কিন্তু আখতার আহমদ-শামীম আখতার দম্পত্তির বৈবাহিক জীবন ৫ বছরও পূর্ণ করেনি। ১৯৮৬ সালের ৫ আগস্ট মাত্র ৪৩ বছর বয়সে নিভে যায় বীর মুক্তিযোদ্ধা আখতার আহমদ এর জীবন প্রদীপ। মরণব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ইংল্যান্ডের রয়েল ফ্রি হাসপাতালে তিনি মারা যান। ১০ মাস বয়সী শিশু সন্তানকে নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা স্বামীর স্বপ্ন আর আদর্শকে পাথেয় করে বেগম শামীম আখতার অবতীর্ণ হলেন জীবন সংগ্রামে।

৫ আগস্ট! মুক্তিকামী শ্রমজীবী মানুষের জন্য বিশেষ ভাবে স্মরণীয় একটি দিন। ১৮৯৫ সালের এই দিনে মৃত্যুবরণ করেছিলেন ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস, ১৯৭৬ সালের এই দিনে মারা যান এ যুগের বিশিষ্ট মার্কসবাদী চিন্তাবিদ কমরেড শিবদাস ঘোষ। সেই ৫ আগস্টেই পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন জননেতা আখতার আহমদ! জ্ঞানে-প্রজ্ঞায়-সংগ্রামে এঙ্গেলস কিংবা শিবদাস ঘোষের সাথে আখতার আহমদের তুলনা চলে না। কিন্তু একই আদর্শের উত্তরসুরী হিসাবে একই চেতনার উত্তরাধিকার বহন করে, একই স্বপ্ন বুকে নিয়ে দুনিয়ার সবচেয়ে বড় আদর্শের জন্য, মানুষের মুক্তির জন্য সংগ্রামে নিজেকে সমর্পণ করেছেন মার্কস-এঙ্গেলসের যোগ্য উত্তরসুরীর মত করেই। আখতার আহমদ আর কোনদিন আমাদের মাঝে ফিরে আসবেন না। কিন্তু তাঁর স্বপ্ন বেঁচে থাকবে, তাঁর সংগ্রামী জীবনের শিক্ষ-চেতনা পাথেয় হয়ে থাকবে তাঁর উত্তরসুরীদের কাছে। মাত্র ৪৩ বছরের স্বল্প জীবনে তিনি যে জীবন সংগ্রাম করেছেন এবং মূল্যবোধের যে শিক্ষা, যে উপলব্ধি দিয়ে গেছেন তা শুধু তাঁর উত্তরসুরীদের নয়, সকল বাম-প্রগতিশীল-গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মানুষের জন্যই এক অমূল্য সম্পদ।

লেখক : আইনজীবী, প্রগতিশীল রাজনৈতিক কর্মী।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত