আব্দুল করিম কিম

০৬ আগস্ট, ২০১৬ ২২:১০

রুখতে কালো নেভাই আলো

হঠাৎ করে লোডশেডিং বেড়ে গেছে । প্রচণ্ড তাপদাহের ভেতরে ঘণ্টার পর ঘন্টা বিদ্যুৎহীন থাকা কস্টকর । এভাবে লোডশেডিং বেড়ে যাওয়ায় ভাবছি, বিদ্যুতের ঘাটতি কী আবার শুরু হ'ল ? না এই লোডশেডিং ইচ্ছাকৃতভাবে করানো হচ্ছে ?
সরকারের ভেতর ঘাপটি মেরে আছে অনেক দুষ্টুলোক । সুন্দরবন নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে গণমানুষের প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করে এ দুষ্টু লোকেরা হয়তো 'লোডশেডিং' চাপিয়ে দিচ্ছে । যাতে মানুষ বিদ্যুতের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে সুন্দরবন রক্ষার চেয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ বেশি জরুরী ভাবে । বাংলাদেশে কোন কিছুই অসম্ভব নয় । দেশের জন্য সর্বস্ব উজার করে দেয়ার মানুষও এখানে আছে আবার প্রয়োজনে মাকে বিক্রি করে দেয়ার মানুষও আছে । সারারাত লোডশেডিং-এর কারনে ঘুমাতে পারিনি । নির্ঘুম রাতে সুন্দরবন নিয়ে অনেক ভেবেছি ।

আমি একজন পরিবেশকর্মী। কোথাও একটি গাছকাটার চেষ্টা চলছে জানলে প্রতিবাদ করার চেষ্টা করি। সিলেটের ছোট্ট একরত্তি জলারবন রাতারগুল রক্ষার জন্য কম আন্দোলন করিনি। মাত্র ১২৫০ হেক্টর ভূমির লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের ২৫হাজার গাছ কাটার পরিকল্পনার বিরুদ্ধ্যেও প্রতিবাদ করছি। কিন্তু এসব কিছু ছাপিয়ে সুন্দরবন নিয়ে ভাবলে মনটা বিষণ্ণ হয়ে যায়। বিনা দোষে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া সুন্দরবনকে কি বাঁচানো সম্ভব হবে না ? আমাদের দেশের সবচেয়ে বড় এ প্রাকৃতিক ঐশ্বর্যকে বিপন্ন করার মুর্খতা কী আমরা প্রতিরোধ করতে পারবো না?

যে কোন গণবিরোধী উদ্যোগ বন্ধ করতে ব্যাপক মানুষের অংশগ্রহনমূলক প্রতিবাদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে । সুন্দরবন রক্ষার জন্য ইতিমধ্যে বামধারার রাজনৈতিক দল সমূহের " তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি সুন্দরবন অভিমুখে লংমার্চ সহ একাধিক কর্মসূচি পালন করেছে। পথে পথে লংমার্চে সাধারন মানুষ স্বতস্ফুর্ত ভাবে অংশগ্রহন করেছে। এদিকে দেশের ৫৩টি পরিবেশবাদী সংগঠনের উদ্যোগে বিশিষ্ট নাগরিকদের সমন্বয়ে গঠিত 'সুন্দরবন রক্ষা জাতীয় কমিটি' রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিরুদ্ধ্যে কঠোর অবস্থান ব্যাক্ত করেছে।

জাতীয় কমিটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে সুন্দরবনের রামপালে নির্মাণাধীন ভারত-বাংলাদেশ কয়লাভিত্তিক যৌথ বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হলে তা হবে বিশ্বের ইতিহাসে ভয়ঙ্কর একটি পরিবেশধ্বংসী প্রকল্প । কমিটির আহ্বায়ক বিশিষ্ট মানবাধিকার নেত্রী ও মুক্তিযোদ্ধা এডভোকেট সুলতানা কামাল রামপাল চুক্তিকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সম্পূর্ণ পরিপন্থী বলেছেন। মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তি হিসেবে দাবি করা বর্তমান সরকার কীভাবে এই চুক্তি করল, সেই প্রশ্নও তিনি উত্থাপন করেছেন। দেশ-বিদেশে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের চরম উদ্বেগ প্রকাশের পরও সুন্দরবনের পরিবেশকে হুমকির মধ্যে রেখে এ বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে বলে তিনি অভিযোগ করেছেন । সাবেক তত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সুলতানা কামাল আওয়ামীলীগের দুর্দিনের একজন পরীক্ষিত বন্ধু। কিন্তু সুন্দরবন ইস্যুতে সরকার তাঁর উদ্বেগকে ধর্তব্যেই নিচ্ছে না ।

রামপালের এই পরিবেশবিধ্বংসী বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ইউনেস্কো ও রামসার। ভারতের এ প্রকল্পে যুক্ত থাকার কারণে নরওয়ে ভারতের এনটিপিসিতে অর্থ জোগান বন্ধ করে দিয়েছে। বেশ কিছু আন্তর্জাতিক ব্যাংকও এ প্রকল্পে টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। সুন্দরবন বিনস্টের এই প্রকল্পের বিরুদ্ধ্যে খোদ ভারতেও নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া রয়েছে। বিভিন্ন পরিবেশবাদী ও নাগরিক সংগঠন এ বিষয়ে প্রতিবাদ জানাচ্ছে। দেশের ভেতরে "তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ- বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি" রাজপথে ও 'সুন্দরবন রক্ষা জাতীয় কমিটি' টেবিল বৈঠকে রামপাল প্রকল্পের বিরুদ্ধ্যে নিয়মিত কর্মসূচি পালন করে জনমত গঠনে জোরালো ভূমিকা রাখলেও মূলধারার রাজনৈতিক সংগঠনগুলো এ ক্ষেত্রে মিনমিনে প্রতিক্রিয়া ব্যাক্ত করছে। সুন্দরবন রক্ষায় তাঁদের কোন কর্মসূচিও নেই।

সাম্প্রতিক সময়ে সংবাদপত্রের কলামে ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার মধ্যরাতের টক-শোতে সুন্দরবন ইস্যু আলোচিত হচ্ছে। বুদ্ধিবৃত্তিক লেখালেখি ও তর্ক-বিতর্ক দেখে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সচেতন মানুষ এখন প্রতিক্রিয়া ব্যাক্ত করা শুরু করেছে। অধিকাংশ প্রতিক্রিয়ায় সুন্দরবন ধ্বংস করে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র চাই না এমন মত প্রতিফলিত হচ্ছে । এ অবস্থায় সচেতন মানুষকে অহিংস উপায়ে সুন্দরবন রক্ষার আন্দোলনে যুক্ত করতে একটি ব্যাতিক্রমধর্মী যুগপৎ কর্মসূচি পালনের প্রস্তাব রাখছি । কর্মসূচির নাম হতে পারে-

'রুখতে কালো নেভাই আলো'

রামপালে নির্মাণাধীন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বাতিলের দাবিতে

তিন দিন এক ঘন্টা করে আলোবিহীন রাত কর্মসূচী

"তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ- বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি" ও 'সুন্দরবন রক্ষা জাতীয় কমিটি' যুগপৎ ভাবে দেশবাসীকে এ কর্মসূচি পালনের আহ্বান জানাতে পারে । এখানে 'রুখতে কালো' বলতে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বোঝানো হয়েছে । 'নেভাই আলো' বলতে ঘরের বিদ্যুৎবাতি এক ঘন্টার জন্য বন্ধ করে মানুষ জানিয়ে দেবে সুন্দরবন ধ্বংস করে বিদ্যুৎ চাই না।
এ কর্মসূচী তিন দিন পালনের কারন হবে প্রথম দিন হয়তো বেশি সচেতন ১০% লোক অংশ নেবে । দ্বিতিয় দিন কর্মসূচী পালনের সংবাদ শুনে আরও ৩০% মানুষ এতে যুক্ত হবে । তৃতীয় দিন দেখা যাবে সে সংখ্যা হু হু করে বেড়েছে । ঘরের ফ্যান চালু রেখে, এসি চালু রেখে শুধু আলো নিভিয়ে দিয়ে সুন্দরবন রক্ষায় এমন একটা অভূতপূর্ব প্রতিবাদে মানুষ কী সাড়া দেবে না ?
সরকার এ কর্মসূচী পালনে কাউকে বাঁধাও দিতে পারবে না । এ কর্মসূচী গ্রামে পালনের সুযোগ না থাকলেও নগর-মহানগরে পালন করাতো সম্ভবপর হবে । শুধু ঢাকা নগরীতেই যদি এক ঘন্টার প্রতিবাদী আঁধার নামে সরকার কী তাতে চাপের মুখে পরবে না ?

সুন্দরবন রক্ষার লড়াইয়ে মানুষকে জাগানোর এখনো সুযোগ আছে। এ দেশের মানুষ দেশের স্বার্থে সময়মত জেগে ওঠে । ফুঁসে ওঠে । বাংলার মানুষের জেগে ওঠার, ফুঁসে ওঠার অসংখ্য নজীর আছে । আমরা হয়তো মানুষকে ঠিক ভাবে জাগাতে পারছি না।

এক সময়ের পরিবেশবাদী বর্তমান সরকারের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কারণে সুন্দরবনের উপর নেতিবাচক প্রভাবের কথা স্বিকার করে নিয়ে জানিয়েছিলেন প্রকল্পটি না সরানোর পক্ষেই সরকার অটল থাকবে । কেন অটল থাকবে ? কার স্বার্থে অটল থাকবে ? এ প্রশ্ন তাঁকে কেউ করেনি । রামপালের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কারনে সুন্দরবনের যদি সামান্যতম ক্ষতিও হয় বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে সে ক্ষতির দায়ভার বহন করতে হবে । ভবিষ্যতে সুন্দরবন ধ্বংসের জন্য এককভাবে শেখ হাসিনাকেই ইতিহাস দোষী সাব্যস্ত করবে ।

আওয়ামীলীগের প্রকৃত শুভাকাঙ্ক্ষীরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে সর্বনাশা এ প্রকল্প বন্ধ করার পরামর্শ দিয়ে দেশ ও দল দুটোকেই বাঁচাতে পারেন । কিন্তু আমার ধারনা এ মুহূর্তে আওয়ামীলীগে স্বার্থহীন কোন পরামর্শ দাতা নেই । ক্ষতির বিষয়টা উপলব্ধি করেও অর্থমন্ত্রীর মত চুপ থাকাটাই সকলে উত্তম ভাবছে । কিন্তু রামপাল প্রকল্প অবিলম্বে বাতিল করা না হলে সুন্দরবন ধ্বংসের দায়ভার শেখ হাসিনার সরকারকে নিতেই হবে । অবশ্য সরকার যদি প্রকল্প বাতিলের সিদ্ধান্তকে পরাজয় বরণ ভাবে সেক্ষেত্রে 'সাপকেও মারা হবে, লাঠিও অটুট থাকবে' এমন একটি উপায় নিয়েও ভাবা যেতে পারে । আর তা হ'ল গণভোট ।

সুন্দরবনকে বিশ্বের প্রাকৃতিক সপ্তাশ্চর্য ঘোষণা করার জন্য প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের বিভিন্ন বিভাগ একদিন মানুষের কাছে ভোট চেয়েছিল । মানুষও পকেটের টাকা খরচ করে 'সুন্দরবন'-এর প্রচারের জন্য ভোট দিয়েছে । এখন আবার ভোট দিবে । সে ভোট হবে সুন্দরবন-এর পাশে রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ এর পক্ষে হ্যা ভোট, বিপক্ষে না ভোট ।

সরকারের মন্ত্রী, আমলা, কামলা, সুবিধাভোগী বিশেষজ্ঞ, তোষামুদে বুদ্ধিজীবী সবাই মিলে উন্নয়নের দোহাই দিয়ে রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ এর পক্ষে হ্যা ভোট চাইবে । দেশব্যাপী বড় বড় জনসভা করে উন্নয়নের ফিরিস্তি দেবে । এ সরকার যে দেশের কোন ক্ষতি করতে পারে না, সেটা নানা উপায়ে বোঝানো হবে । সরকারী প্রচার-প্রচারনার ডামাঢোলে মুগ্ধ হয়ে দেশবাসী হয়তো রামপাল প্রকল্পের পক্ষে 'হ্যা ভোট'ও দিয়ে দিতে পারে । আর জনতার রায় পেয়ে গেলেতো সরকারের কেল্লা ফতেহ । সরকারকে তখন আর দোষারোপ করা যাবে না । সুন্দরবন ধ্বংস করার দায়ে শেখ হাসিনার সরকারকে ভবিষ্যতে কেউ অভিযুক্তও করতে পারবে না । একজন সাধারন নাগরিক হিসাবে সুন্দরবন নিয়ে আমার এ ভাবনা তুলে ধরলাম ।

লেখক : সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা), সিলেট।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত