২৬ আগস্ট, ২০১৬ ২০:১৬
বাল্যকাল হতেই শুনে এসেছি দানবীর আর পি সাহার নাম, যাঁর পুরো নাম রণদা প্রসাদ সাহা, আর সেই সূত্রেই জানতে পারি টাঙ্গাইলের মির্জাপুরের নাম। গৃহত্যাগী নিঃস্ব কিশোর হতে কঠোর সংগ্রাম করে ধন কুবেরে পরিণত এই বরেণ্য ব্যক্তির প্রবাদপ্রতিম দানশীলতার কারণে সারা দেশে তিনি পরিচিত হন ‘দানবীর’ হিসাবে।
কিন্তু গত প্রায় এক দশক ধরে দেখছি নব্য ‘দানবীর’ রাগীব আলীর আবির্ভাবে মূল দানবীর বিস্মৃত প্রায়!
সিলেটের রাগীব আলী প্রথমে বিতর্কে আসেন ৭০ দশকে, সিলেট সরকারি পাইলট স্কুলের ছাত্রাবাসের জায়গায় ‘মধুবন সুপার মার্কেট’ নির্মাণ শুরুর মাধ্যমে। কথায় বলে, মারি তো হাতি, লুটি তো ভাণ্ডার। কৌশল খাটিয়েই যদি হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি কব্জা করা যায়, আর পি সাহা স্টাইলে কষ্ট করে ব্যবসা করে দানবীর হওয়ার দরকার কি? বিচিত্র কৌশলে পুত্রের নামে ৯৯ বছর মেয়াদে লিজ নেয়ার নামে দখল করে নেন দেবোত্তর সম্পত্তি তারাপুর চা বাগান, গড়ে তোলেন রাগীব রাবেয়া মেডিকেল কলেজ, হাউজিং এস্টেট।
শুরু হয় নামের আগে ‘দানবীর’ যোগ করে প্রচার প্রচারণা, নাগরিক সম্বর্ধনা, বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানের সভাপতি বা বিশেষ অতিথির পদ অলংকরণ। এর মধ্যে ডক্টরেটও জুটে যায়, বংশ পদবীতে যোগ হয় 'সৈয়দ'। পরিশেষে সর্বোচ্চ আদালতে তারাপুর চা বাগান ‘লিজ’ নেয়ার জালিয়াতি উদঘাটিত হলে পুত্র কন্যা জামাতাকে নিয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়ে দানবীরের আপাত রক্ষা।
আর উপাধিপ্রাপ্ত ব্যক্তির অগোচরেই এদেশে 'দানবীর' উপাধি যাঁর নামের সাথে যোগ হয়, সেই আর পি সাহা সম্পর্কে বহুল প্রচলিত কিংবদন্তী ছিল যে বাল্যকালে একদিন ভাত খেতে বসলে তাঁর বিমাতা ভাতের বদলে থালাতে ছাই বেড়ে দিলে তিনি রাগে দুঃখে বাড়ি হতে পালিয়ে যান। দরিদ্র ঘরের সন্তান রণদা মাত্র সাত বৎসর বয়সে তাঁর মাতাকে দেখেন সন্তান প্রসবকালে বিনা চিকিৎসায় ধনুষ্টঙ্কারে মৃত্যু বরণ করতে। বিমাতার অনাদরে ও যন্ত্রণায় চৌদ্দ বৎসর বয়সে বাড়ি থেকে কোলকাতায় পালিয়ে শুরু হয় টিকে থাকার সংগ্রামে কখনো কুলি, কখনো রিক্সা চালক, ফেরিওয়ালা। স্বদেশী আন্দোলনের জড়িয়ে হাজতবাসও বাদ যায়নি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে প্রথমে ‘বেঙ্গল এ্যাম্বুলেন্স কোর’-এ, পরবর্তীতে নবগঠিত বাঙালি পল্টন-এ যোগ দেন। তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত লেখা পড়া করা আর পি সাহা নিজ গুণে অসাধারণ কৃতিত্বের জন্য সেনাবাহিনীর কমিশন লাভ করে রাজা পঞ্চম জর্জের আমন্ত্রণে ১৯১৯ এ ইংল্যান্ড সফর করেন। কিছুদিন রেলওয়েতে চাকুরি করে সঞ্চিত যৎসামান্য অর্থ দিয়ে প্রথমে লবণ ও কয়লার ব্যবসা, পরে একে একে নৌ পরিবহন, বীমা, পাট, চামড়া, সরকারী খাদ্য শস্য ক্রয়, এমনকি তখনকার দিনে পাওয়ার হাউস (বিদ্যুৎ উৎপাদন) - সাফল্য আর সাফল্য। দেশ বিভাগের পূর্বেই রণদা বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান ব্যবসায়ী এবং শিল্প উদ্যোক্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পান।
সর্বক্ষেত্রে তাঁর অসামান্য বদান্যতার কারণে জীবদ্দশায় কিংবদন্তীতে রূপান্তরিত আর পি সাহা সারা দেশে খ্যাতি অর্জন করেন ‘দানবীর’ নামে।
মাকে বিনা চিকিৎসায় মরতে দেখার স্মৃতি তিনি ভুলতে পারেন নি তাই তাঁর প্রথম উদ্যোগ ছিল ১৯৩৮ সালে প্রতিষ্ঠিত 'কুমুদিনী ডিসপেনসারি' পরে ১৯৪৪ এ হয় সম্পূর্ণ দাতব্য প্রতিষ্ঠান কুমুদিনী হাসপাতাল যার উদ্বোধন করেন বাংলার গভর্নর লর্ড আর জি কেসি। পঞ্চাশের দশকে এদেশের প্রথম ক্যান্সার চিকিৎসা হয় এই হাসপাতালে, শুধু তাই নয় দেশ বিদেশের প্রথিতযশা চিকিৎসকরা সেবা প্রদানের জন্য আসতেন এই হাসপাতালে ।
তাঁর প্রপিতামহীর নামে ১৯৪৫ সালে স্থাপিত ভারতেশ্বরী হোমস দেশের প্রথম আবাসিক মহিলা বিদ্যালয়। এদেশের যে কোন giant event ভারতেশ্বরী হোমস এর ছাত্রীদের শারীরিক কসরত ব্যতিরেকে এখনো পূর্ণ হয় না।
১৯৪৩-৪৪ সালের মন্বন্তরের সময় রেডক্রস সোসাইটিকে এককালীন তিন লক্ষ টাকা দান করা ছাড়াও তিনি ক্ষুধার্তদের জন্য চার মাসব্যাপী সারাদেশে দুইশত পঞ্চাশটি লঙ্গরখানা খোলা রাখেন। মানিকগঞ্জের দেবেন্দ্র কলেজ, টাঙ্গাইলে কুমুদিনী কলেজ – আরও অসংখ্য কীর্তি। সম্পত্তি থেকে প্রাপ্ত লভ্যাংশ গরীবদের উদ্দেশ্যে ব্যয় করার জন্য ১৯৪৭ সালে গঠন করেন কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট অব বেঙ্গল ।
শুধু ব্যবসা ও মানব সেবাই নয়, যাত্রাপালা ও নাটকে তাঁর ছিল প্রবল উৎসাহ। একজন সৌখিন অভিনেতা হিসাবে আলমগীরের নাম ভূমিকায় অভিনয় করে তিনি যাত্রাঙ্গনে খ্যাতি অর্জন করেন। গ্রাম বাংলার এক সময়কার বিনোদনের এই মাধ্যমটির কবর রচনা করা হয়েছে ৮০র দশকের শুরুতে প্রিন্সেস লাকি খানকে অশালীন নৃত্যের জন্য যাত্রা পালায় introduce করার মাধ্যমে।
বিভিন্ন ক্ষেত্রে অসাধারণ সাফল্যের জন্য তিনি ব্রিটিশ সরকার 'রায় বাহাদুর' , ১৯৬৯ সালে পাকিস্তান সরকার ‘হেলালে পাকিস্তান’ ; বাংলাদেশ সরকার মরণোত্তর স্বাধীনতা পুরষ্কার এ ভূষিত করে এই দানবীরকে।
এদেশের মানুষের ভালবাসার প্রতি আস্থা রেখে যে আর পি সাহা ১৯৭১ এ দেশত্যাগে সম্মত হন নি, এদেশেরই রাজাকারদের সহায়তায় ৭ই মে তাঁর সাতাশ বৎসর বয়সী পুত্র সহ নারায়ণগঞ্জের খানপুর এলাকার সিরাজউদ্দৌলা রোডের বাড়ি থেকে পাকবাহিনী ধরে নিয়ে যাওয়ার পর আর তাঁদের কোনো খোঁজ মেলেনি।
আপনার মন্তব্য