ড. শাখাওয়াৎ নয়ন: কথাসাহিত্যিক, একাডেমিক, ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অফ সিংগাপুর

৩১ মার্চ, ২০১৫ ১৮:০৮

রক্ত, চাপাতি অথবা হিজড়াদের গানগুলি

ড. শাখাওয়াৎ নয়ন

ঢাকায় ওয়াশিকুর রহমান বাবুকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। হত্যাকারীদের মধ্যে দুইজন ঘটনাস্থলেই হিজড়াদের হাতে ধরা পড়েছে। ধৃত ব্যক্তিরা বলেছে, হুজুরের নির্দেশে তারা এই হত্যাকান্ড চালিয়েছে।

অনুভুতি:

(১) সবার উপরে ধর্ম সত্য, তাহার উপরে নাই।

(২) সরকারের চেয়ে হিজড়া শক্তিশালী।

‘সবার উপরে যেহেতু ধর্ম সত্য’ তাই আমরা এই ব্যাপারটাই প্রথমে আলোচনা করি। আলোচনার সুবিধার্থে কিছু প্রশ্ন দিয়ে শুরু করা যাক।

প্রথম প্রশ্ন: রক্তের ধর্ম কি? রক্ত কি হিন্দু নাকি মুসলমান? নাকি খ্রিস্টান, বৌদ্ধ? নাকি রক্তের কোনো ধর্ম নাই, ধর্মহীন? তাহলে যে অনেকে বলেন, মুসলিম রক্ত, হিন্দু রক্ত? এ সবের ফয়সালা কি?

ধর্মের নামে রক্তপাত, হত্যা? হঠাৎ করে পিছন থেকে এসে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে কুপিয়ে ধর্ম প্রতিষ্ঠা? এটা কি সমর্থনযোগ্য? আমি জানি, আমাদের দেশে অগনিত মানুষ পাওয়া যাবে, যারা যুক্তি দিবেন- ‘ধর্মের বিরুদ্ধে ঐ ছেলে অনেক খারাপ খারাপ কথা লিখেছে, তাই তাকে হত্যা করা হয়েছে। ঠিকই করেছে। কেউ কেউ আরেকটু আগ বাড়িয়ে বলবেন, ‘আরো আগেই তাকে হত্যা করা উচিৎ ছিল।‘ কী উচিৎ ছিল, কি ছিল না? তা নিয়ে বলাই বাহুল্য।

রাজাকার, মানবতাবিরোধী, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আন্তর্জাতিক মান-সম্মত হলো কি না? তা নিয়ে অনেকে গলা ফাটিয়ে ফেলেছেন। ইহুদী-নাছারা খ্রিস্টানদের ডেকে এনেছেন। কেউ কেউ মৃত্যুদন্ড রহিতকরণের পক্ষে মত দিয়ে নিজেকে উচ্চমান সুশীল হিসেবে প্রচারিত করেছেন। তারা কেউ চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে কুপিয়ে হত্যাকান্ডের বিরুদ্ধে একটি কথাও বলছেন না। ইতোপূর্বে আমরা লক্ষ্য করেছি, প্রখ্যাত লেখক, কবি হুমায়ূন আজাদ, ব্লগার রাজীব হায়দার, মুক্তমনা বিজ্ঞান বিষয়ক লেখক অভিজিৎ রায় এবং ওয়াশিকুর রহমান বাবু এদের সবাইকেই চাপাতি দিয়ে আক্রমণ করা হয়েছে। আক্রমণের শিকার একমাত্র হুমায়ূন আজাদ ছাড়া প্রায় সবাই সাথে সাথেই মৃত্যুবরণ করেছেন। কেউ কেউ বলেছেন, চাপাতি দিয়ে কোপানোর প্রাচীন নিয়মগুলি ঠিকমতো পালন করা হয়নি, তাই সেই যাত্রায় হুমায়ূন আজাদ বেঁচে গিয়েছিলেন।

দ্বিতীয় প্রশ্ন: চাপাতির ধর্ম কি? নাকি চাপাতিও রক্তের মতো? রক্তের মধ্যে অনেক জীবিত উপাদান থাকে কিন্তু চাপাতির মধ্যে তো তাও নেই।আমরা জানি এক ধরনের দা এর ধর্ম পরিচয় আছে। যেমন রাম দা। লম্বা ধরনের ঐ বিশেষ দা’য়ের নামকরণ কে করেছে, কে জানে? রামরাজ্য প্রতিষ্ঠায় কি এই দা’য়ের কোনো ভুমিকা ছিল?

সে যাই হোক, প্রতি ক্ষেত্রেই হত্যাকারীরা তাদের পবিত্র চাপাতিখানি ঘটনাস্থলে ফেলে গেছেন। এর কারণ কি? তারা কেন ফেলে যাচ্ছেন? তারা কি চাপাতির বিষয়টি প্রচারে আনতে চান?আমার মনে হয়, তারা শুধু হত্যা করতে আগ্রহী নন। একই সাথে তারা প্রচার উন্মুখ। তা না হলে অভিজিৎ রায় কে হত্যা করার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো স্থানকে বেছে নিত না। বইমেলার সময়কে বেছে নিত না। তারা চাইলে অন্য কোনো সময় এবং স্থান বেছে নিতে পারতো।

একই ভাবে আশিকুর রহমান বাবুকে হত্যা করার জন্য তেজগাঁও’র মতো জনাকীর্ন এলাকা বেছে নিত না। ইতিপুর্বে যেহেতু তারা লক্ষ্য করেছে, শত শত মানুষ থাকলেও কেউ এগিয়ে আসে না। তাই তারা এবার আর রাতের বেলায় নয়, দিনের বেলাতেই হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে। কিন্তু হত্যাকারীদের কপাল খারাপ, দুই হিজড়া এসে ঝামেলা বাঁধিয়ে দিয়েছে। হিসেব ঠিকই ছিল, কোনো সাধারণ মানুষ এগিয়ে আসেনি। হিজড়ারা নিশ্চয়ই তাদের হিসেবের মধ্যে ছিল না। আচ্ছা, হিজড়া নিয়ে দু’একটা প্রশ্ন করা যাক।

তৃতীয় প্রশ্ন: হিজড়াদের ধর্ম কি? কিংবা হিজড়াদের ব্যাপারে ধর্মগ্রন্থে কি বলা হয়েছে? মৃত্যুর পরে তাদের কি হবে? তারা বেহেস্তে নাকি দোযখে যাবে? তাদের মুসলমানি করানো যায় না, আবার ধর্মমতে বিবাহেরও ব্যবস্থা নেই। কারণ তারা মা-বাবা কিছুই হতে পারে না। এরা তাহলে কি উনমানুষ? নাকি মানুষের তৃতীয় ধরণ? আমি যতদূর জানি, হিজড়াদের ব্যাপারে ধর্মে তেমন কিছু বলা হয় নি। মৃত্যুর পরে তাদের জন্য কি ধরনের শাস্তি কিংবা পুরস্কারের ব্যবস্থা? কেউ জানলে, প্লিজ দয়া করে জানাবেন।

আমাদের সমাজ নানা রকম বৈষম্যে পরিপুর্ণ। আমরা ধনী-দরিদ্র, নারী-পুরুষ, হিন্দু-মুসলিম, হিজড়া-অহিজড়া ভেদাভেদ করে থাকি। আমরা হিজড়াদেরকে পারিবারিক, সামাজিক এবং রাস্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করেছি। সেই রকম দুইজন হিজড়া, মানবতার সাহায্যার্থে এগিয়ে এসেছেন। যে দেশে আজকাল কেউ অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে সাহস পায় না, সেদেশে ভয়ঙ্কর দুইজন খুনীকে তারা হাতে-নাতে ধরে ফেলেছেন।

নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন, আমাদের দেশে ইতিমধ্যেই এক দল লোক চাপাতি বন্দনা শুরু করে দিয়েছে। আরেক দল রক্ত নিয়ে মাতম। তৃতীয় লিংগের মানুষেরা এতো দিন এসবের বাইরে ছিলেন। তারা মুখে রঙ মেখে নাচ-গান করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। সেই তৃতীয় লিংগেরই দুইজন মানুষ হঠাৎ করে প্রমাণ করে দিয়েছেন। আমরা যারা এতো দিন নিজেদেরকে পুরুষ বলে দাবি করছি, তারা আসলে পুরুষ নই। আমরা যারা নিজেদেরকে মানুষ বলে দাবি করছি, আমরা আসলে মানুষ নই। আমরা যারা নিজেদেরকে এতোদিন মানবতাবাদী, সভ্য, শিক্ষিত, সুশীল, ক্ষমতাবান মনে করছি, আমরা আসলে তার কিছুই নই।

আমরা, আমাদের নিরাপত্তা বাহিনী, রাস্ট্র সবাই নপুংশুক। আমাদের মতো শত শত নপুংশুকদের সামনেই অভিজিৎ রায় খুন হয়েছেন। আমরা নিরবে দেখেছি। কেউ প্রতিবাদ করিনি। আজও খুনীদের ধরতে পারিনি। সেদিন যদি এতোগুলো নপুংশুক না থেকে একজন হিজড়াও থাকতো, তাহলে একজন খুনী হলেও তখন ধরা পড়ত। হে বংগজননী, তুমি আর কোনো নপুংশুকের জন্ম দিও না, সম্ভব হলে কিছু বীর, নয়ত হিজড়াই জন্ম দিও।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত