তেলেগু একটি দ্রাবিড় জাতি। বাংলাদেশে প্রায় দেড়শ বছর পূর্বে তেলেগুদের একটি বড় অংশ আসে। তারও পূর্বে তেল

০৮ এপ্রিল, ২০১৫ ১৩:৪৮

বাংলাদেশ, তেলেগুদের কী একটু সুযোগ দেয়া যাবে?

মিখা পিরেগু

প্রায় পাঁচ হাজার বছর পূর্বে অস্ট্রিকদের সমকালে দ্রাবিড়দের বসতি ছিল। পরে দ্রাবিড়রা ছড়িয়ে পড়ার পরও একটি ক্ষুদ্র অংশ ছিল। বাংলাদেশে তেলেগুদের একটি অংশ তাদেরই প্রতিনিধিত্ব করছে বলে মনে করা হয়। 

কথিত আছে ব্রিটিশ আমলে উনবিংশ শতাব্দীতে চা বাগান, সিটি কর্পোরেশন ও রেলওয়েতে কাজের জন্য ব্রিটিশরা পর্যাপ্ত দক্ষ বাঙ্গালি শ্রমিক না পেয়ে দক্ষিণ ভারতীয়দের নানান সুযোগ-সুবিধার কথা বলে প্ররোচিত করে এদেশে নিয়ে আসে। তৎকালীন সময়ে দক্ষিণ ভারতে অর্থনৈতিক মন্দা ব্যাপক আকার ধারণ করেছিল তাই দুবেলা দুমুঠো ভাতের আশায় ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য তেলেগুরা এদেশে পাড়ি জমায়।

হিন্দি এবং বাংলার পর তেলেগুই ভারতের সর্বোচ্চ ব্যবহৃত ভাষা। তেলেগু ভাষায় ৬০টি বর্ণমালা আছে। তন্মধ্যে ৪১টি স্বরবর্ণ, ১৬টি ব্যাঞ্জনবর্ণ ও ৩টি পরিবর্তনকারী বর্ণ রয়েছে। সারাবিশ্বে প্রায় ৯০ মিলিয়ন মানুষ তেলেগু ভাষায় কথা বলে। তেলেগু ভাষার ইতিহাস ও সাহিত্য অন্যান্য ভাষা থেকে বেশ সমৃদ্ধ।

প্রতি বছর ২৯ আগস্ট তেলেগু ভাষা দিবস পালন করা হয়। তবে দুঃখের বিষয় হচ্ছে আঞ্চলিকতার প্রভাব হোক বা অন্য কোনও কারণেই হোক বাংলাদেশে বসবাসকারী তেলেগুরা কেউই শুদ্ধ তেলেগু বলতে পারে না।

ঢাকার সায়েদাবাদ সিটিপল্লী, টিকাটুলি কলোনি, গোপীবাগ, কল্যাণপুর, সিলেটে বিভিন্ন চা বাগান ও ঈশ্বরদী রেলওয়ে কলোনীতে তেলেগুরা বাস করে আসছে। অন্যান্য আদিবাসীদের মতোই তেলেগুদেরও নিজস্ব ভূমি নেই। সিলেটে বসবাসকারী তেলেগুরা চা শ্রমিকের কাজ করে। পাবনার ঈশ্বরদীতে বাসকারী তেলেগুরা রেলওয়ের বিভিন্ন নিম্নপেশায় জড়িত আর ঢাকায় অবস্থানকারী তেলেগুরা ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের সুইপারি, ঝাড়ুদারি ইত্যাদি নিম্নশ্রেণীর পেশায় যুক্ত। কর্মব্যস্ত দিনের পরে দিন সকালে আবর্জনামুক্ত যে ঢাকা আমরা দেখি তা অনেকাংশে তেলেগুদেরই অবদান। ঢাকার তেলেগুরা এই কাজটি কবে থেকে করছে জানেন? ১৮৬৪ সাল থেকে ঢাকা সিটি কর্পোরেশন স্থাপন হবার পরপরই।

একটা জাতি কয়েকশ বছর ধরে দিনের পর দিন নিঃস্বার্থভাবে একটা শহরকে ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করছে, চা বাগানের উঁচু-নিচু টিলায় প্রচন্ড রোদে কিংবা তীব্র ঝড়-বৃষ্টিতে কাজ করছে। জীবিকার তাগিদে সমাজের নিম্নতম কাজটি বেছে নিতেও যারা কুন্ঠিত বোধ করেনি। তারা আজ কিভাবে আছে? কেমন আছে? রাষ্ট্রকি তাদের প্রতি কতটা আন্তরিক? এর উত্তর জানতে হলে অবশ্যই আপনাকে সায়েদাবাদ সিটিপল্লী, গোপীবাগ রেলওয়ে সংলগ্ন বস্তি কিংবা টিকাটুলী রাজধানী মার্কেট সংলগ্ন কলোনী বা সিলেটের চা বাগানগুলোতে যেতে হবে।

জীবন কতটা নিষ্ঠুর সেটা এই সব এলাকায় বসবাসকারী তেলেগুরা কয়েকশ বছর ধরে জানে। মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত এই জাতির পাশে দলিত, বঞ্চিত বা নিপীড়িত কোনও বিশেষণই যেন মানানসই নয়। তেলেগুরা ভালো বাংলায় কথা বলতে পারে না। নিজেদের অনেক চাওয়া-পাওয়া আর অতৃপ্তিগুলো সুন্দর করে গুছিয়ে বলা বা প্রতিবাদের ভাষা তেলেগুরা এখনও শিখতে পারেনি। হয়তো এটাই একমাত্র কারন হতে পারে।

তেলেগুদের শিক্ষার অবস্থা খুবই করুণ। হাতেগোণা কয়েকজন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়লেও ঝরেপরা শিক্ষার্থীর হার বেশী। এর পেছনে অর্থনৈতিক কারণ ছাড়াও অন্যতম প্রধান কারণ বাংলা ভাষায় পড়াশুনা করা। দ্রাবিড়ভাষী তেলেগুরা এখনও বাংলা শুদ্ধরুপে আয়ত্ত করে নিতে পারেনি। ফলে বাংলায় পড়াশুনা করা তেলেগুদের জন্য চ্যলেঞ্জিং। আর পর্যাপ্ত শিক্ষার অভাবেই তেলেগুরা নিজেদের অধিকার সম্পর্কে এখনও সচেতন নয়। যদিও জাতীয় শিক্ষানীতিতে এইরূপ জাতির জন্য মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষার কথা বলা রয়েছে তবুও সরকার এই ব্যাপারে উদাসীন।

তাছাড়াও সরকারী গেজেটভুক্ত না করায় তেলেগুরা সরকারি চাকুরি বা উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে কোটা সুবিধা পায় না। বাংলাদেশে বসবাসকারী তেলেগুরা নিজেদের সংস্কৃতি সম্পর্কে বেশ সচেতন। বাংলাদেশে তেলেগুদের মাঝে হিন্দু, খ্রিষ্টান ও হাতেগোণা কিছু মুসলমান ধর্মাবলম্বী রয়েছে। তেলেগু মহিলাদের শাড়ী পড়ার ধরণ থেকে শুরু করে শরীরে বিভিন্ন অলংকারের আধিক্য অন্যদের থেকে নিজেদের স্বতন্ত্র করেছে। প্রায় এক সপ্তাহ ব্যাপী আয়োজিত তেলেগু স্বতন্ত্র বিবাহরীতি অত্যন্ত ঐতিহ্যমন্ডিত। তবে অর্থনৈতিক অবস্থা বিবেচনায় আনুষ্ঠানিকতা সংকুচিত হয়ে থাকে।

তেলেগু সংস্কৃতির অন্যতম হাতিয়ার লাঠি খেলা বা লাঠি নাচ। নিজস্ব গানে অপরূপ ভঙ্গিমায় দলভিত্তিক এই নাচ যে কাউকে মুগ্ধ করতে সক্ষম। বিভিন্ন পূজার্চনা কিংবা হোলি উৎসবে এই নাচ দেখা যায়। হিন্দু তেলেগুরা নকাল্লামাপূজা সহ দক্ষিণ ভারতের প্রচলিত বিভিন্ন পূজা এখানেও পালন করে।

কীর্তনের সময় তেলেগু গানেই তেলেগুরা সৃষ্টিকর্তার আরাধণা করে থাকে। তেলেগু কীর্তন বা ধর্মীয় গানগুলোর মোহনীয় সুর ও সঙ্গীত আধ্যাত্মিকভাবে স্বর্গীয় অনুভূতির সৃষ্টি করে। কাছে থেকে না শুনলে শুধু লিখে এর মাহাত্ম প্রকাশ করা কখনও সম্ভব নয়। তেলেগু নববর্ষ উগাডী বিশেষত ঢাকার তেলেগুরা পশু বলি সহ ঐতিহ্যবাহী খাবারের আয়োজন করে পালন করে।

তেলেগু সংস্কৃতির আরেকটি সুন্দর দৃষ্টান্ত হল আলপনা। বিভিন্ন উৎসবে তেলেগু বধুরা বাড়ীর আঙিনায় মনের মাধুরী মিশিয়ে চুন দিয়ে রকমারি ডিজাইনের আলপনা আঁকে। তেলেগু ভাষায় একে ‘মুজ্ঞু’ বলা হয়। অবাক করা বিষয় হচ্ছে দৃষ্টিনন্দন এই আলপনাগুলো কাউকে শিখিয়ে দিতে হয় না। বংশ পরম্পরায় তেলেগুরা এই বিশেষ গুণ পেয়ে থাকে।

অবস্থানগত কারনে তেলেগুরা দেশীয় খাবারে অভ্যস্ত হলেও তেলেগুদের নিজস্ব কিছু ঐতিহ্যবাহী খাবার রয়েছে। টক খাবারের প্রতি তেলেগুদের দুর্বলতা আছে। তেলেগুরা টকজাতীয় ফল দিয়ে প্রায় দৈনিকই একটি বিশেষ ধরণের ডাল রান্না করে। তেলেগু ভাষায় একে ‘পুলচু’ বলা হয়। আর আম দিয়েও বিশেষ একটি আচার তেলেগুরা প্রায় অনিয়মিতভাবে বাড়িতে তৈরি করে।

তেলেগু বিয়ে কিংবা উৎসবে গৃহিণীরা চালের গুড়ি ও গুড় দিয়ে বাহারী পিঠা তৈরি করে থাকে। মিষ্টি স্বাদের এই পিঠাগুলোকে তেলেগু ভাষায় পংরালু, কান্তা, এরসুলু, বুরলু, অন্ডলু ইত্যাদি নামে চিহ্নিত করা হয়। বাংলাদেশে তেলেগুদের মাঝে বর্ণপ্রথা বিদ্যমান। যদিও আধুনিকতার ছোঁয়ায় দক্ষিণ ভারতে তেলেগুদের মাঝে বর্ণপ্রথা সেভাবে আর নেই। তবুও শিক্ষাগত কারণে এই গতিশীল সময়েও বাংলাদেশের তেলেগুরা কুসংস্কারের বেড়াজালে আচ্ছন্ন। তেলেগুদের মাঝে মাতকলু, মামুলু, গল্লুলু, ছাত্রুলু, নাইডু প্রভৃতি নামে বিভিন্ন ছোট-বড় গোত্র রয়েছে। তেলেগু সমাজে পঞ্চায়েত প্রথা বিদ্যমান। সংশ্লিষ্ট কারো কাছে তেলেগুদের সম্পর্কে কোনও সঠিক তথ্য না থাকলেও আনুমানিক বাংলাদেশে পঞ্চাশ হাজারেরও বেশি তেলেগু রয়েছে।

অপরূপ সুন্দর আমাদের এই বাংলাদেশকে আরও বৈচিত্রময়তা দিয়েছে বিভিন্ন জাতির স্বতন্ত্র ভাষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, প্রথা, রীতিনীতি। তেমনি তেলেগু জাতিও স্বতন্ত্র বৈশিষ্টে মহিমান্বিত। কালের বিবর্তনে ও সময়ের গতিময়তায় ঢাকা শহরের আবর্জনার স্তূপ, চা বাগানের বন্দুর টিলা-পাহাড় আর রেলওয়ের স্লিপারের মাঝে যে জাতির জীবন ঘুরপাক খাচ্ছে রাষ্ট্র কি তাদের কাছে কোনভাবে দায়বদ্ধ নয়? একটু স্বাভাবিক জীবননির্বাহের নিশ্চয়তা কি তেলেগুরা পেতে পারে?

মাইক্রোসফটের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সত্যনারায়ণ নাদেল্লার মতো বাংলাদেশের তেলেগুদের মাঝ থেকে কেউ বিশ্বদরবারে বাংলাদেশকে তুলে ধরবে এমন একটি স্বপ্ন কি তেলেগুরা দেখতে পারে?

মাননীয় বাংলাদেশ, তেলেগুদের কী একটু সুযোগ দেয়া যাবে?

আপনার মন্তব্য

আলোচিত