পরবাসী পথিক

০৮ জানুয়ারি, ২০১৫ ০২:১৩

সাম্প্রতিক তিনটি আলাদা ঘটনা এবং আমাদের সমকালীন অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক ভাবনা


ঘটনা ১ :
সোনালী ব্যাংক লিমিটেড আমাদের দেশের একটি প্রধান রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক l রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সবচেয়ে বড় এই ব্যাংক ২০১৫ খ্রিস্টাব্দের ৬ পাতার ক্যালেন্ডারের ৪ পাতায় মসজিদের ছবি থাকলেও ১ পাতায় হিন্দুদের কান্তজীর মন্দির ও ১ পাতায় বৌদ্ধদের স্বর্ণ মন্দিরের ছবি এঁকে দেওয়া হয়েছে! সোনালী ব্যাংকে কর্মরত অমুসলিমরা ৪ পাতায় ৮ মাস মুসলমানদের মসজিদকে সহ্য করলেও তাঁদের অনুভূতিতে কোন আঘাত লাগার কথা নয়; কেননা, ওরা তো অনুভূতিশুন্য!
কিন্তু সংখ্যাগুরু মুসলমানদের ২ পাতায় ৪ মাস মন্দির দর্শনে বাধ্য করে তাঁদের অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অপচেষ্টা হয়েছে বলে অভিযোগ করা হয় !
অবশেষে সোনালী ব্যাংক লিমিটেডের পরিচালনা পর্ষদের সদস্যরা ২ কোটি টাকা খরচে ছাপানো ৬ লাখ ক্যালেন্ডার প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য করেছে সোনালী ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে! ব্যাংক কর্তৃপক্ষ দুঃখ প্রকাশ করে নতুন করে আবার ক্যালেন্ডার ছাপানোর নির্দেশ দিয়েছে!
প্রভূ যিশু যেদিন প্রথম নাজারেথ শহরে নিজের গোষ্ঠীর সামনে বক্তৃতা দিয়েছিলেন, সেই দিনটাকে খ্রিস্টানরা খুবই গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিশ্বাস করে। মহাকালকে তারা ঐদিনটির আগে ও পরে দু’ভাগে ভাগ করে – অন্ধকার যুগ ও আলোকিত যুগ। অন্ধকার যুগটাই খ্রিস্টপূর্বাব্দ, আর আলোকিত যুগটাই খ্রিস্টাব্দ। সেই খ্রিস্টাব্দের ক্যালেন্ডার নিয়ে ৯০ ভাগ মুসলমানের দেশে এতো মাতামাতি করলে ধর্মীয় অনুভুতিতে আঘাত লাগেনা l অনুভুতিতে আঘাত লাগে কেবলি ক্যালেন্ডারে দেশের প্রাচীন স্থাপত্যের নিদর্শন কান্তজির মন্দির কিংবা বৌদ্ধ স্বর্ন মন্দিরের ছবি ছাপালে l

ঘটনা ২ : হজ্বের পর মুসলমানদের দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্মিয় সম্মিলন বিশ্ব ইজতেমাকে ‘পিকনিক’ বলে আখ্যা দিয়েছেন বলে অভিযোগ ওঠেছে আইনজীবি ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. তুহিন মালিক'র বিরুদ্ধে। ৫ জানুয়ারি একুশে টেলিভিশনে প্রচারিত এক টকশোতে তিনি এ মন্তব্য করেন বলে সরগরম সামাজিক যোগাযোগ সাইট ফেসবুক।

অভিযোগ বিএনপিসহ বিশ দলীয় জোটের অবরোধ কর্মসূচি বিশ্ব ইজতেমা উপলক্ষে স্থগিত হতে পারে এমন আশঙ্কায় তিনি আন্দোলন বন্ধ না করতে বিএনপির প্রতি অনুরোধ জানিয়ে বলেন- “বিশ্ব ইজতেমার জন্য আন্দোলন কর্মসূচী স্থগিত করা কোনো ক্রমেই ঠিক হবেনা। ফিরাউনকে ক্ষমতার মসনদে বসিয়ে তুরাগ পারে পিকনিক করলে ইসলামের দুই পয়সার উপকার হবেনা, বরং ফিরাউনের অবস্থান সুসংহত হবে, মসজিদ-মাদ্রাসা বন্ধ হবে, জিহাদী বইয়ের নামে ইসলামী সাহিত্য জব্দ করা হবে, আলেম ওলামাদের ফাঁসিতে ঝোলানো হবে। তাই ইজতিমার অজুহাতে আন্দোলন কোন ক্রমেই বন্ধ রাখা যাবেনা।”
৫ জানুয়ারি ঘিরে আওয়ামিলীগ-বিএনপির মুখোমুখি অবস্থানকে কেন্দ্র করে যখন রাজনীতির ময়দান উত্তপ্ত তখন তিনি এই মন্তব্য করেন বলে ফেসবুকে প্রচার হচ্ছে। বেগম খালেদা জিয়া তাঁর গুলশানের কার্যালয়ে 'অবরুদ্ধ' থাকার পর দেশব্যাপি টানা অবরোধ কর্মসূচির ঘোষণা করেন। এই কর্মসূচি যাতে কোনভাবেই স্থগিত না হয় সে জন্যে বিএনপি-জামায়াতপন্থি এই আইনজীবি তাবলিগ ইজতেমা সম্পর্কে এই বিরূপ মন্তব্য করেন বলে জানাচ্ছেন অনেক এক্টিভিস্ট।

এদিকে আসন্ন বিশ্ব ইজতেমা উপলক্ষে দেশ-বিদেশের মুসল্লিদের যাতায়াতের সুবিধার্থে তাবলিগ জামায়াতের এক প্রতিনিধি দল ৬ জানুয়ারি সন্ধ্যায় বেগম খালেদা জিয়ার সাথে সাক্ষাৎ করে অবরোধ কর্মসূচি স্থগিতের অনুরোধ জানান।

উল্লেখ্য, কয়েক মাস আগে আওয়ামিলীগ দলীয় সংসদ সদস্য ও মন্ত্রি আবদুল লতিফ সিদ্দিকি হজ্ব ও তাবলিগ জামায়াত সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করার কারণে মন্ত্রিসভা থেকে বহিস্কৃত হন এবং দেশের বিভিন্ন জায়গায় দায়ের করা মামলার প্রেক্ষিতে বর্তমানে তিনি জেলহাজতে আছেন।

সাবেক মন্ত্রি আবদুল লতিফ সিদ্দিকির বক্তব্যকে কেন্দ্র করে সারাদেশে ধর্মান্ধ গোষ্ঠী তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখায় এবং বিভিন্ন সভা-সমাবেশে তাঁর শাস্তি দাবি করে। ড. তুহিন মালিকের বক্তব্যের পর এখন পর্যন্ত সারাদেশে কোন প্রতিক্রিয়া দেখা যায় নি এবং কেউ তাঁর বিরুদ্ধে কোন বক্তব্যও দিতে দেখা যায় নি।

ঘটনা ৩ : গত ৫ই জানুয়ারী যুক্তরাজ্য আওয়ামীলীগের গণতন্ত্রের বিজয় দিবস উদযাপনের সমাপ্তি ঘটে সাম্প্রদায়িক উস্কানির মধ্যদিয়ে। শেষপর্যন্ত বিষয়টি পুলিশ পর্যন্ত গড়িয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা যায় আওয়ামী লীগের যুব ক্রীড়া সম্পাদক ও যুক্তরাজ্য যুবলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক তারিফ আহমদ ও যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি হরমুজ আলী শাহ নেওয়াজ নামক বিএনপির এক এজেন্ট কে সভা থেকে বের হয়ে যাওয়ার কথা বলেন।

শাহনেওয়াজ নিজেকে আওয়ামী লীগ হিসাবে দাবী করলে বঙ্গবন্ধু প্রকৌশলী পরিষদ যুক্তরাজ্যের সাধারণ সম্পাদক ও মহানগর আওয়ামী লীগের তথ্য ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক সুশান্ত দাশ গুপ্ত তা প্রতিবাদ করলে শাহনেওয়াজ তাকে ‘’মালাউন ‘’ বলে গালি দিলে সভাস্থলে হাতাহাতির সূত্রপাত ঘটে। তারই রেশ ধরে যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী সভা শেষে একই সুরে সুশান্ত দাশ গুপ্ত কে ‘’মালাউন’’ সহ অশ্লীল গালাগালি করেন বলে জানা যায় l



সকল ধর্মীয় এবং নৃ গোষ্ঠির সহাবস্থানের কথা থাকলেও রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান যখন শুধুমাত্র ধর্মীয় কারণে তাদের বর্ষপঞ্জিকার ছয়টি পাতার দুটি থেকে মন্দিরের ছবি ধর্মীয় মৌলবাদীদের চাপে সরাতে বাধ্য তখন শুধুই চেয়ে থাকা ছাড়া কি আর কিছুই আছে ?

একজন তুহিন মালিক শুধুমাত্র তার রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণে হ্জ্ব এর পরেই মুসলমানদের দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্মীয় সমাবেশ বিশ্ব ইজতেমা নিয়ে কটুক্তি করে পার পেয়ে যায় l তার কথায় স্পষ্ট এই প্রতিয়মান হয় যে ধর্মীয় আচার অনুষ্টানের চেয়ে বিরুধী জোটের আন্দোলন, খুন, এবং হরতাল শ্রেয় l এবং আমাদের দেশের ধর্মব্যাবসায়ীদের কল্যানে তার বিরুদ্ধে কোন সংখ্যাগুরু মানুষ টু শব্দটাও করেনা হয়না কোনো মামলা কিংবা রিট আবেদন l কিন্তু সেই একই শ্রেনীর মানুষ হ্জ্ব নিয়ে কটুক্তি করার জন্যে লতিফ সিদ্দিকীর মস্তকের মূল্য নির্ধারণ করেছিলো l

সর্বশেষ সম্প্রদিযকতার কফিনে শেষ পেরেক ঠুকলেন অসাম্প্রদায়িক চেতনার ঐতিহ্যে লালিত বাংলাদেশ আওয়ামিলিগ যুক্তরাজ্য শাখার ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক জনাব আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী l যার মুখদিয়ে উচ্চারিত হলো ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার সবচেয়ে ঘৃণ্য শব্দ মালাউন l শুধুমাত্র একজন বহুল পরিচিত বিএনপি এজেন্টকে সাপোর্ট দেওয়ার জন্যে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্র রাজনীতির মাধ্যমে উঠে আসা তরুণ মেধাবী এবং নিবেদিতপ্রাণ নেতা সুশান্ত দাস গুপ্তকে মালাউন সহ অশ্লীল গালি দিতে ভ্রুক্ষেপ করেননি তিনি l ওপর সুত্র থেকে জানা যায় জনাব আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীর আপন বড়ভাই ভাই আব্দাল চৌধুরী ইসলামী ঐক্য জোটের পুরো ইউরোপের প্রধান উপদেষ্টা l
আওয়ামিলীগ যুক্তরাজ্য শাখা দেশের জেলা শাখার মর্যাদা সম্পন্ন হলেও জেলা শাখা থেকে এর গুরুত্ব অনেক বেশি l মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত আওয়ামিলীগ যুক্তরাজ্য শাখা বাংলাদেশ এবং দলের জন্যে অনেক গুরুত্ব পূর্ণ ভুমিকা রাখছে l সঙ্গত কারণে যুক্তরাজ্য আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক পদটিও অনেক গুরুত্ব পূর্ণ l কিন্তু বাংলাদেশ আওয়ামিলীগের মত সংগঠনে যুক্তরাজ্য শাখার মত একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখার সাধারণ সম্পাদক হিসাবে এমন কুরুচি পূর্ণ সাম্প্রদায়িক ব্যক্তির নেতৃত্ব কি সংগঠনের অসাম্প্রদায়িক চেতনা, স্বাধীনতার মূল্যবোধ এবং রাজনৈতিক ঐতিহ্যের উপর সাম্প্রদায়িক দুর্গন্ধের নোংরা ছাপ ফেলবে না ?

উপরোক্ত তিনটি সাম্প্রতিক ঘটনা আলাদা হলেও ঘটনার মর্মার্থ একই সুত্রে গাঁথা l তিনটি ঘটনাই ঘৃণ্য সাম্প্রদায়িকতা কেন্দ্রিক l মুখে মুখে অসাম্প্রদায়িক চেতনার বুলি আওড়ালেও আমরা ধীরে ধীরে কতটা সাম্প্রদায়িক জঘন্য জানোয়ারে পরিনত হচ্ছি তা গত এক সপ্তাহের তিনটি ঘটনা থেকে সহজেও অনুমেয় l আমরা যতটা সাম্প্রদায়িক কঠিন সময় পার করছি তার চেয়ে কঠিন সময় অপেক্ষমান l আমাদের দেশে আইন আছে, অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী সরকার রয়েছে তার পরেও ইবোলা ভাইরাসের মত সাম্প্রদায়িকতা ছড়িয়ে পড়ছে মহামারীর মত l আর এই ভাইরাস একমাত্র যে ঠেকাতে পারে তা হলো আমাদের রাষ্ট্র যন্ত্র l কেবল মাত্র সরকারের সদিচ্ছা এবং মুক্ত বুদ্ধির মানুষের সহযোগিতায় এই ধর্মীয় উন্মাদনা এবং সাম্প্রদায়িকতা রোধ করা সম্ভব l আর না হলে স্বাধীনতার মূল্যবোধ, অসাম্প্রদায়িক চেতনা, সাংস্কৃতিক মুক্তি, আর্থ সামাজিক মুক্তি শব্দ গুলো কাজির গরুর মত কিতাবেই রয়ে যাবে , গোয়ালে কখনই আসবে না l

আপনার মন্তব্য

আলোচিত