মাসকাওয়াথ আহসান

২৫ আগস্ট, ২০১৮ ১৫:৪৩

জজমিয়া ও বিবিধ আইনের বেলুনেরা

রম্য

ওষুধের দোকানে অসুস্থ মায়ের জন্য ওষুধ কিনছিলো জামালউদ্দিন। কতগুলো লোক খবরের কাগজ খুলে কী একটা খবর নিয়ে কথা-বার্তা বলছিলো।

এক লোক বলে, আমি চ্যালেঞ্জ দিয়া কইতে পারি এই পোলাগুলি নির্দোষ; অগো "জজ মিয়া" বানাইতেছে।

জামালউদ্দিনের বুকের মধ্যে ধক করে ওঠে।

আরেক লোক বলে, কাউরে আকাশ-বিকাশ-ডন বানায় তো কাউরে বানায় জজমিয়া। আসল অপরাধী ধরতে পারলে ভালো। নাইলে একটারে তুইলা আইনা কয়, এই দেখেন কত বড় জজমিয়া ; হইলো আপনাগো ন্যায়বিচার; এখন বাড়িত গিয়া মুড়ি ভিজায়া খান।

প্রথম লোকটা বলে, তবে জজমিয়া হইতাছে ক্লাসিক ক্যারেক্টার; দেবদাসের লাহান। আকাশ-বিকাশ-ডন তার ধারে-কাছেও যাইতে পারে নাই।

জামালউদ্দিন দ্রুত ওষুধ নিয়ে বেরিয়ে আসে। দেবদাসের নামটা শুনে তার চোখ ছল ছল করে ওঠে। মনে পড়ে পারভীনের চাঁদপানা মুখটা। ভোর বেলা কোত্থেকে যেন শিউলি ফুল কুড়িয়ে এনে সে বালিশের পাশে রাখতো; ওর চুড়ির শব্দে জামাল উদ্দিনের বুকের ভেতরে সকাল হওয়ার আনন্দ বয়ে যেতো। পারভীন একটু পরে ডাকতো, উঠবা, নাকি কানে পানি ঢাইলা দিমু।

একদিন সকালের দিকে বারান্দায় গলা খাকারি দিয়ে হাজির হয় পারভীনের আব্বা। শ্বশুর সাহেব উত্তেজিত হয়ে বলে, এইভাবে আমার মাইয়াডারে ধোঁকা দিলা মিয়া।

পারভীন অবাক হয়, কী হইছে আব্বা; কী করছে সে! তার কী আগের পক্ষের স্ত্রী ও সন্তানাদি আছি; নাকি নতুন কোন চক্কর চালাইতাছে।

পারভীন কান্নায় ভেঙে পড়ে।

শ্বশুর সাহেব বলে, ওরেই জিগা কী করছে সে!

পারভীন জামালউদ্দিনের কলার চেপে ধরে, আমারে থুইয়া তোমার অন্য মাইয়ারে ভালা লাগলো ক্যান! আমারে তো তুমিই কইছিলা; আমি ঘরে ঢুকলেই নাকী আসমান ভাইঙা চান্দের আলো ঘরে ঢুইকা পড়ে।

শ্বশুর সাহেব বলে, এইডা হইতাছে শীর্ষ সন্ত্রাসী জজমিয়া। দেইখা মনে হয় ভাজা মাছ উলটাইয়া খাইতে পারে না; কিন্তু পকেটে আর্জেস গ্রেনেড নিয়া ঘোরে। ঠিক মতন দেখ মা, চকির তলায় আলু-পেঁয়াজের মধ্যে আর্জেস গ্রেনেড লুকাইয়া রাখছে কীনা।

জজমিয়া আর্তনাদের স্বরে বলে, আমি জজমিয়া না জামাল উদ্দিন। পুলিশের এক অফিসার আমারে ধইরা নিয়া গিয়া কইলো; আমি পুলিশে কাম করি; কিন্তু স্বপ্ন ছিলো লেখক হওয়ার; স্বপ্ন ছিলো এমন ক্যারেক্টার তৈরি করবো; যারে কেউ কখনো ভুলবে না। তাই তোর নাম দিলাম জজমিয়া। বিশ্বাস করেন শ্বশুর আব্বা, আমি অপরাধী না; আমি কোন অপরাধ করি নাই।

পারভীন তার আব্বাকে বলে, আমি হ্যার লগে থাকি; মানুষটা খুব ভালো আব্বা। রাইতে বাইরে কোন খুটখাট শব্দ হইলে সে ডরে; আমি দরজা খুইলা দেখতে যাই। অপরাধী কী আর এতো ডরপুক হয়। তা ছাড়া আমি খবরের কাগজে পড়ছিলাম; জজমিয়া হইতাছে সাজানো নাটক। একথা বলেই পারভীন ফিচ ফিচ করে কাঁদতে থাকে।

শ্বশুর সাহেব বিরক্ত হয়, শাবানার মতন অবুঝ হইসনারে মা। জজমিয়ার ঘরে আমি তোরে রাখুম না। সমাজে আমার একটা প্রেস্টিজ আছে।

পারভীনকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যায় তার আব্বা। এরপর জামাল উদ্দিন মনের দুঃখে ঢাকায় চলে আসে; ট্যাক্সি চালানোর কাজ নেয়। অসুস্থ মা আর ভাইবোনের দায়িত্ব না থাকলে; সে আত্মহত্যা করতো নিশ্চিত। কয়েকবার ট্রেন লাইনের পাশে আত্মহত্যা করতে গেছেও। কিন্তু সব সময় ট্রেন লেট থাকে; তাই তার আর আত্মহত্যা করা হয়নি। তবু মাঝে মাঝে মনে হয়, এ জীবন রেখে কী লাভ; যে জীবন জামালউদ্দিনের নয়; যে জীবন জজমিয়ার। লোকজন বার বার তাকে চিনে ফেলে জন্য বাসা বদলাতে হয়। সব সময় মনের মধ্যে ভয়, কেউ যদি চিনে ফেলে।

খবরের কাগজে পুলিশ বা র‍্যাবের মাঝখানে কোন অপরাধীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলেই জামালউদ্দিনের ভয় লাগে, ঐ তো জজমিয়া।

নোয়াখালীর সেনবাগে একটা চায়ের দোকানে সে বসে থাকার সময় পুলিশ এসেছিলো। জিজ্ঞেস করে, অই তোর ব্যাগের মধ্যে কী!

--মায়ের জন্য কতগুলি আতাফল কিনছিলাম।

--এইগুলি আতাফল না; আর্জেস গ্রেনেড; চল থানায় চল।

এই যে জামালউদ্দিন থানায় গেলো; এরপর সে জজমিয়া হয়ে বের হলো। থানার যন্তর-মন্তর ঘরে এক পুলিশ অফিসার একটা কাগজ এগিয়ে দিয়ে বলেছিলো, আজকে তোকে নিয়ে একটা সুপারহিট গল্প লিখেছিরে জজমিয়া। নামগুলো মুখস্থ কর। আদালতে বলতে হবে, কার কার নির্দেশে কাকে কাকে হত্যা করতে তুই গ্রেনেড হামলা করেছিস।

জজমিয়া পুলিশ অফিসারের পা চেপে ধরে বলেছিলো, আপনি দেশের মালিক; আমার জীবন ভিক্ষা দেন আলেমপনা।

পুলিশ অফিসার বলেছিলো, তোর অসুবিধা কী; তোর মায়েরে মাসে মাসে কিছু টাকা পাঠাবো; তোর ভাইয়ের চাকরির একটা ব্যবস্থা করা যাবে। তুই মনে কর তুই ফিল্ম স্টার; এইখানে স্যুটিং-এ আসছিস। টেলিভিশনের সাংবাদিকরা তোরে আদালতে আসা যাওয়ার পথে ক্যামেরা দিয়া ভিডিও করবে; পত্র-পত্রিকায় ছবি আসবে। এক নামে সবাই চিনবে। তুইতো সুপারস্টার হইয়া যাবি। এরপর সরকার তোরে দেখাইয়া "এই যে অপরাধী ধরছি" বলে বাহবা নেবে। আমারও ধর প্রমোশান হবে।

জামালউদ্দিন কাতর স্বরে বলেছিলো, অন্তত আমার নামটা জজমিয়া না দিলেই কী না!

--হয় না; তোরে আদালতে জজ-ব্যারিস্টারের সামনে আমার লেখা গল্পের ডায়লগ দিতে হবে; সেইখানে তোর নাম মিনিমাম জজমিয়া না হইলে গল্পে দম থাকে না।

  • মাসকাওয়াথ আহসান: সাহিত্যিক।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত