আব্দুর রশিদ রেনু

২৯ আগস্ট, ২০১৮ ১৭:৩০

সিলেটের ক্রীড়াঙ্গন: একজন টিপু মজুমদার

স্মরণ

সিলেটের ক্রীড়া সাংবাদিকতার পথিকৃৎ তিনি। টিপু মজুমদার নামে সবার মাঝে পরিচিত হলেও তাঁর পারিবারিক নাম দেবাশীষ মজুমদার টিপু।

বাবা বকুল মজুমদার ছিলেন হোমিও চিকিৎসক, মা অজন্তা মজুমদার ছিলেন গৃহিনী। ১৯৫৩ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি সিলেট নগরের কালিঘাট এলাকায় জন্ম নেওয়া টিপু মজুমদার মাত্র ৪৯ বছর বয়সে ২০০২ সালের ২৯ আগস্ট ইহলোক ত্যাগ করেন।

ক্রীড়াঙ্গনেই যার জীবনের অধিকাংশ সময় কেটেছে। ছিলেন ক্রিকেটার, আম্পায়ার ও ক্রীড়া সাংবাদিক।

সাংবাদিকতার আধুনিকতার যুগেও বলতে গেলে সিলেটের ক্রীড়া সাংবাদিকতায় এখনো পেশাদারিত্ব আসেনি। অথচ গত শতাব্দীর আশির দশকে সিলেটের মাঠে যেসব খেলাধুলা হতো তার সংবাদ টিপু মজুমদারের লেখনীতে উঠে আসত। নিজে সরাসরি কোনো সংবাদমাধ্যমে কাজ না করায় নিজের প্রতিবেদনগুলো অকাতরে বিলিয়ে দিতেন স্থানীয় সাংবাদিকদের মাঝে। এমনকি পরের দিন যেন খেলার খবরটি পত্রিকার পাতায় ছাপানো হয় সেই তদবির করতেন তিনি।

তখনকার দিনে স্থানীয় পত্রিকায় ক্রীড়ার জন্য আলাদা কোনো পাতা বা স্থান ছিল না। ঢাকা থেকে প্রকাশিত সংবাদপত্রেও ঢাকার বাইরের খেলাধুলার সংবাদ ছাপা হতো না বললেই চলে। সেই বৈরি পরিবেশে সিলেটের খেলাধুলার সংবাদ যাতে জাতীয় পত্রিকায় ছাপা হয় সেই দায়িত্ব অনেকটা নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন টিপু মজুমদার।

ক্রীড়া সাংবাদিকতার আগে তিনি ছিলেন সিলেটের তুখোড় ক্রিকেটার। প্রথম বিভাগ ক্রিকেট লিগে উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান হিসেবে পরিচিতি ছিল তাঁর স্থানীয় ক্রিকেটাঙ্গনে। ৭০-৮০ দশকজুড়ে নৈপুণ্যের সঙ্গে সিলেটে প্রথম বিভাগ ক্রিকেটে খেলেন বঙ্গবীর অগ্রগামী ক্লাব, ইয়ং ভিক্টর ক্লাবসহ বেশ ক’টি ক্লাবের হয়ে। মাঠে শুধু চার-ছয় হাঁকানো আর প্রতিপক্ষের উইকেট তালুবন্দি করার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না টিপু মজুমদারের ক্রিকেট ক্যারিয়ার। ব্যাট-প্যাড তুলে রাখার পর উইকেটের পেছনে দাঁড়ান আম্পায়ারের ভূমিকায়। ১৯৮২ সালে বিসিবির পরীক্ষায় সিলেটের যে চারজন আম্পায়ার উত্তীর্ণ হন টিপু মজুমদার তাদের একজন। অন্য তিনজন ছিলেন বিরাজমাধব চক্রবর্তী মানস, আলী আশরাফ চৌধুরী খালেদ ও মোহাম্মদ বদরদ্দোজা বদর। সেই থেকে আমৃত্যু সিলেট স্টেডিয়ামে বিভিন্ন ক্রিকেট টুর্নামেন্টে আম্পায়ারে ভূমিকা পালন করেন টিপু মজুমদার। পাশাপাশি যুক্ত হন ক্রীড়া সাংবাদিকতায়।

বলতে গেলে টিপু মজুমদারের হাত ধরেই সিলেটের খেলাধুলার সংবাদ স্থানীয় সংবাদপত্রসহ জাতীয় পত্রিকায় স্থান পেত। আমরা যারা আজ ক্রীড়া সাংবাদিকতায় জড়িত তাদের অন্যতম পথপ্রদর্শক তিনি। কাজ করেছেন সিলেটের প্রাচীন সংবাদপত্র যুগভেরী, দৈনিক জালালাবাদ, বার্তাবাহকসহ বেশ কয়েকটি পত্রিকায়।

১৯৯৬ সালে অধুনালুপ্ত দৈনিক আজকের সিলেটে কাজ করার সময় একটি ঘটনার মধ্য দিয়ে টিপু মজুমদারের সাথে আমার পরিচয়। হঠাৎ একদিন সন্ধ্যায় চরম উত্তেজিত হয়ে তিনি আজকের সিলেট অফিসে প্রবেশ করেন। অফিসে পা রেখেই সম্পাদকের (ইকবাল কবির) নাম ধরে ডাকাডাকি শুরু করলেন। ‘কে এই ফাজলামি করেছে’ জানতে চাইলেন। তাঁর হাকডাকে কম্পিউটার সেকশনের লোকজন নিউজ রুমে চলে এলো। পাশের রুম থেকে আসলেন দাদা (ইকবাল কবির)। এসে উনাকে শান্ত করলেন। প্রথমে অনেকটা ভয় পেয়েছিলাম। তবে দাদা আসার পর পরিস্থিতি মুহূর্তে স্বাভাবিক হয়ে এলো। পরে জানতে পারলাম ওই দিনের একটি সংবাদে টিপু মজুমদারের পরিবর্তে ‘পুটি মজুমদার’ ছাপা হয়েছে। শেষ পর্যন্ত পরদিন পত্রিকায় সংশোধনী ছাপা ও কে করছে তাকে সনাক্ত করে সম্পাদক বিচার করার আশ্বাস দিলে রাগে অগ্নিমূর্ত ধারণকারী টিপু মজুমদার খুব সহজেই স্বাভাবিক হয়ে যান।

পরবর্তী সময়ে এ ধরণের ঘটনা আরো কয়েকবার ঘটেছে। উনার কর্মস্থল, সিলেট প্রেসক্লাব বা যে কোন সংবাদপত্র অফিসে টিপু মজুমদারের উপস্থিতির প্রতিটি মুহূর্ত ছিল উপভোগ্য। কেউ কেউ ভয়ে ভয়ে থাকতেন যে, কখন তিনি উত্তেজিত হয়ে যান। আবার কেউ কেউ উনাকে উত্তেজিত করেও মজা পেত। তাঁর এমন সহজ সরল আচরণ ও হাসিমাখা মুখ সবাইকে আকৃষ্ট করত। আপন করে নিতেন সকলকে।

১৯৭১ সালে তিনি মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। টিপু মজুমদারের মতো নির্লোভ মানুষ সমাজে খুব কমই আছে। তেমন কোনো কিছুতেই লোভ ছিল না তার। লোভ ছিল শুধু সিগারেটের প্রতি। একটি সিগারেট যেনো ছিলো তার কাছে মহামূল্যবান কোনো বস্তু। পরিচিতজনদের কাছে তাঁর প্রত্যাশিত জিনিসটার নাম ছিল এই সিগারেট।

সিলেটের ক্রীড়া সাংবাদিকতার এক উজ্জ্বল নক্ষত্র টিপু মজুমদার ২০০২ সালের এক সন্ধ্যায় আকস্মিকভাবেই এই নশ্বর পৃথিবী ছেড়ে চলে যান না ফেরার দেশে। দিনটি ছিল ২৯ আগস্ট। প্রতিদিনের মতো ওইদিনও তিনি ছিলেন কর্মক্ষেত্রে। সন্ধ্যার দিকে একটি খেলা সংবাদ আনতে কর্মস্থল যুগভেরী থেকে বের হন তিনি। আর ফিরে আসেননি। চিরদিনের মতো হারিয়ে যান তিনি। এখনও চোখের সামনে বেশে উঠে টিপু মজুমদারের বুক টানিয়ে হেটে যাওয়ার দৃশ্য। দেখতে দেখতে চলে গেল উনার মৃত্যুর ১৬টি বছর।

টিপু মজুমদার মৃত্যুর পর উনাকে সিলেটের সংবাদপত্র ও আর ক্রীড়াঙ্গনে কিভাবে বাঁচিয়ে রাখা যায় বারবার সেই চিন্তাটি আসে মাথায়। ভাবলাম সিলেট জেলা স্টেডিয়ামের প্রেস গ্যালারিটি টিপু মজুমদারের নামে করা যায় কি না। বিষয়টি নিয়ে প্রথমে আলোচনা করি তরুণ ক্রীড়া সংগঠক আখতারুজ্জামান মান্না ভাইর সাথে (যিনি মারা যান ২০১৬ সালের ২৪ জানুয়ারি)। তখন জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন আহমদ আরিফ। মান্না ভাই আমাকে নিয়ে গেলেন সাধারণ সম্পাদকের কাছে। প্রস্তাব শুনে আহমদ আরিফ বললেন নামকরণ করতে গেলে অনেক কিছু করতে হয়। আমি বললাম প্রেসবক্সের উপরে ‘টিপু মজুমদার প্রেসবক্স’ লিখে নেব। কিছু না বলায় মৌনতা সম্মতির লক্ষণ ভেবে লিখে নিলাম। মান্না ভাই সাহস দিলেন লিখে নেওয়ার জন্য। এমন কি তিনি উপস্থিত থেকে রিকাবীবাজার থেকে একজন আর্টিস্ট এনে এক বিকেলে প্রেসবক্সের নাম লেখা হলো ‘টিপু মজুমদার প্রেসবক্স’।

নাম লেখার প্রায় এক যুগ পর জেলা ক্রীড়া সংস্থার কার্যনির্বাহী কমিটিতে এটি অনুমোদন পায়। ২০১৪ সালে সিলেট জেলা স্টেডিয়াম আন্তর্জাতিক ফুটবলের অভিষেক হলে স্থান পরিবর্তন হয় প্রেসবক্সের। খবর পেয়ে স্টেডিয়ামে গিয়ে দেখলাম নামকরণের কি হলো? নতুন স্থানের প্রবেশ মুখেই আরও সুন্দরভাবে গ্লাসের মধ্যে টিপু মজুমদারের ছবিসহ লিখে রাখা হয়েছে ‘টিপু মজুমদার প্রেসবক্স’। জীবনের অনেকটা সময় যিনি সিলেট স্টেডিয়াম পাড়ায় কাটিয়েছেন তার নামে প্রেসবক্সের নামকরণে কিছুটা ভূমিকা রাখতে পেরে ভাল লাগছে।

কৃতজ্ঞচিত্তে ধন্যবাদ জানাচ্ছি জেলা ক্রীড়া সংস্থার দায়িত্বে থাকা সকল সাধারণ সম্পাদকসহ সংশ্লিষ্টদের। যারা সযতনে ধরে রেখেছেন ‘টিপু মজুমদার প্রেসবক্স’টি। যার মাধ্যমে তিনি বেঁচে থাকবেন যুগ যুগ ধরে।

  • আব্দুর রশিদ রেনু: ক্রীড়া সম্পাদক, দৈনিক সিলেট মিরর।
  • [প্রকাশিত লেখায় মতামত, মন্তব্য ও দায় লেখকের  নিজস্ব]

আপনার মন্তব্য

আলোচিত