মাসকাওয়াথ আহসান

০৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ ১৭:০৬

‘সহমত ভাই’ বিশ্ববিদ্যালয়

রম্য

পুষ্প-মঞ্জুরি কমিশনের প্রধান অত্যন্ত বিক্ষুব্ধ। এই বুড়ো বয়েসেও ফেসবুকিং করতে গিয়ে দেখেছেন, অত্যন্ত গঠনমূলক স্ট্যাটাসের মন্তব্যে ‘সহমত ভাই’ না লিখে বেশির ভাগ লোক লিখে যায় ‘ভিন্নমত ভাই’। এ থেকে উনার ধারণা জন্মে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ঠিক মতো ‘সহমত ভাই’ দর্শন শেখাতে ব্যর্থ হয়েছে। সুতরাং বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা ব্যবস্থায় সংস্কার আনা প্রয়োজন।

কমিশন সদস্য বলেন, সহমত স্যার। আমরা বরং এক কাজ করি; বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের নিয়মিত বদলির ব্যবস্থা করি। যেমন, কোন এলাকার পুলিশ কর্মকর্তা সাংসদ মহোদয়ের সঙ্গে ‘সহমত ভাই’ দর্শন অনুসরণে ব্যর্থ হলে তাকে খাগড়াছড়িতে বদলি করে দেয়া হয়।

আরেক কমিশন সদস্য মন্তব্য করেন, তাহলে তো খাগড়াছড়িতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

কমিশন প্রধান বলেন, প্রতিষ্ঠা করতে হলে হবে। কিন্তু তাই বলে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ‘ভিন্নমত ভাই’-এর পাঠ দিয়ে উন্নয়নের শত্রুতা করবে; তা তো হয় না; এভাবে চলতে দেয়া যায় না।

কমিশন সদস্য আশ্বাস দেন, সাম্প্রতিক সময়ে খুব অল্প সংখ্যক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককেই ‘ভিন্নমত ভাই’ বলে বিবৃতি দিতে দেখা গেছে। ভিন্নমত ভাই র‍্যালিতে ব্যানার হাতে দশ-বারোজন দাঁড়িয়ে থাকে। বাকিরা ছিলো ‘সহমত ভাই’-এর ছায়ার তলে।

প্রশ্রয় পেয়ে বেড়ে যাওয়া পিয়ন মোকসেদ বলে, স্যার এই দশ বারোজন শিক্ষক নিয়াই তো খাগড়া ছড়ি বিশ্ববিদ্যালয় শুরু করা যায়।

পুষ্প-মঞ্জুরি কমিশনের প্রধান বলেন, ওরে পাগল, খাগড়াছড়ি-টড়ি এমনিতেই ‘ভিন্নমত ভাই’ প্রবণ এলাকা। এরা ওখানে গেলে প্রত্যেকদিন আদিবাসী নারী নির্যাতনের বিচার চাই বলে ব্যানার নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে।

কমিশন সদস্য বলেন, স্যার ওদের আদিবাসী বললে যদি অধিকার-টধিকার বেশি দিতে হয়।

কমিশন প্রধান হাসেন, ঘরের মধ্যে বললে অসুবিধা নাই; বাইরে এদের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী বলতে হবে।

কমিশনের আরেক সদস্য প্রশ্ন রাখেন, স্যার স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের তো বদলির চাকরি; অতো স্বাধীনতাও নেই; কিন্তু তারা দেখলাম, ছাত্র-ছাত্রীদের ‘সহমত ভাই’ দর্শন শেখাতে খুবই ব্যর্থ হয়েছেন।

কমিশন প্রধান বলেন, আসলে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাটা বড্ড ভুল। কবিতা-টবিতাগুলোর মধ্যে প্রচণ্ড ‘ভিন্নমত ভাই’ রয়ে যায়। মুখ রক্ষার জন্য সিলেবাসে রবীন্দ্র-নজরুল রাখতে হয়। কিন্তু এই দুটি লোকের বড্ড ভিন্নমত ভাই রোগ ছিলো। ভেরি নেগেটিভ পোয়েটস।

এক কমিশন সদস্য প্রস্তাব দেয়, সহমত ভাই দর্শন নামে বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি বিভাগ খুললে কেমন হয়। ছাত্ররা যে বিষয়েই পড়ুক সহমত ভাই দর্শনের একটা কোর্স তাদের করতেই হবে। এতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অবিরাম কারণে-অকারণে সহমত ভাই বলতে শেখানোর মেশিন হয়ে উঠবে।

কমিশন প্রধান বলেন, ভেরি গুড আইডিয়া ইনডিড। বিভিন্ন সেক্টরের ‘সহমত ভাই’ দর্শনের সুফল ভোগকারীদের ভিজিটিং ফ্যাকাল্টি হিসেবে নিয়ে আসা যাবে। ছাত্ররা যদি দেখে, একটা অত্যন্ত সফল লোক বড় গাড়ি হাঁকিয়ে স্যুট পরে এসে ‘সহমত ভাই দর্শন’-এর সুফলগুলো সম্পর্কে বলছে; তাহলে ছাত্ররা বুঝবে ‘ভিন্নমত ভাই’ দর্শন শেখানো শিক্ষকগুলো লুজার; গাড়ি চাপা পড়ে মরা লোক। সুতরাং, সহমত ভাই বলে যে, গাড়ি-ঘোড়া চড়ে সে।

এক সংশয়বাদী কমিশন সদস্য বলেন, ভিন্নমত স্যার। ফেসবুকে এরকম সহমত ভাই রাজনৈতিক নেতা-পুলিশ-প্রশাসক-সেলিব্রেটি-মোটিভেশনাল স্পিকারদের সঙ্গে আগে তরুণ-তরুণীরা যেমন সেলফি তুলে গদগদ হতো; আজকাল সেটা বেশ কমে এসেছে। অনেকেই দেখলাম অতীতের এমন সেলফিগুলো মুছে দিয়েছে।

কমিশন প্রধান তেতে ওঠেন, খোদ কমিশনেই যদি আপনার মতো ভিন্নমত ভাই দর্শনের লোক থাকে; তাহলে আর আমরা সহমত ভাই দর্শনে বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কার কী করে করি!

কমিশন প্রধান পিয়নকে ইশারা করেন।

পিয়ন একটি হেলমেট পরে হাতুড়ি নিয়ে হাজির হয়। সংশয়বাদী কমিশন সদস্যকে জিজ্ঞেস করে, এইবার বলেন দেখি স্যার, পুষ্প মঞ্জুরি প্রধান স্যারের সঙ্গে আপনার কোন ভিন্নমত আছে কীনা!

  • মাসকাওয়াথ আহসান: সাহিত্যিক।
  • [প্রকাশিত লেখায় মতামত, মন্তব্য ও দায় লেখকের নিজস্ব]

আপনার মন্তব্য

আলোচিত