আব্দুল হাই আল হাদী

০৩ অক্টোবর, ২০১৮ ১৪:৩৮

ঘুমিয়ে গেছে শ্রান্ত হয়ে আমার গানের বুলবুলি...

’গানের পাখি গেছে উড়ে শূন্য নীড়
কণ্ঠে আমার নাই সে আগের কথার ভিড়
আলেয়ার এ আলোতে আর আসবে না কেউ কুল ভুলি’

’চৌধুরী’ বংশগত পদবী হলেও কখনো কোনদিন সেটির ব্যবহার দেখা যায়নি। ’আরীফ ইকবাল’ নামেই তিনি পরিচিত ছিলেন সবার কাছে। ঘনিষ্ঠতার সূত্রে একদিন সে প্রসঙ্গটি উত্থাপন করলে তিনি সহাস্যে বলেছিলেন, দেখেন, এসব ব্যাপারগুলো সমাজে মানুষে মানুষে ব্যবধান বাড়ায়, বৈষম্য তৈরি করে। আরও দশজনের মতো হয়ে, সমাজের দশজনের একজন হয়ে বেঁচে থাকার মজাই আলাদা। ’চৌধুরী’ শব্দটি সাধারণ থেকে কেমন জানি এক আলাদা আবহ তৈরি করে। আমি সেটি চাইনা, কর্মের মাঝেই আমি বেঁচে থাকতে চাই। এই ছিলেন আমাদের আরীফ ভাই! তাকে বুঝার জন্য এ একটি দৃষ্টান্ত-ই যথেষ্ট। ’বিশালত্বের মাঝে ক্ষুদ্রতার অনুভূমি’- এ গুণটি তাঁকে অসাধারণত্ব দান করেছিল। শরতের বকুল বকুল-বিছানো পথে, মানুষের ভালবাসা আর শ্রদ্ধার সে মানুষটি বড় অকালে মৃত্যুর চিরসত্যের হাত ধরে চলে গেছেন চিরদিনের জন্য।

আরীফ ভাই জানতাম অনেক আগে থেকে। তিনি এডভোকেট ইকবাল আহমেদ চৌধুরীর ছেলে, এক বড়লোকের সন্তান-এরকম একটি পরিচিতি ছিল সবার মতো আমার কাছেও । দেখলে হাই, হ্যালো ইত্যাদি আনুষ্ঠানিকতার মাঝেই সীমাবদ্ধ ছিল দু’জনের সম্পর্ক। ২০১২ সালের এপ্রিল কিংবা মে মাস। নর্থ ইস্ট ইউনিভার্সিটি তখন সবেমাত্র সরকারের অনুমোদন পেয়েছে। একাডেমিক কার্যক্রম তখনো আরম্ভ হয়নি । সে ’আঁতুড়ঘরে’ অধ্যাপক ড.তোফায়েল স্যার, অধ্যাপক ড. জয়নুল আবেদিন জ্যাক স্যার, আবেদিন ভাই, রাহাত আজিজ, রাসেল ভাইসহ কয়েকজনের সাথে আমারও যোগদান করা হয়। সেখানে গিয়ে পেলাম সে আরীফ ভাইকেও। তিনি ছিলেন জনসংযোগ কর্মকর্তা। একটি নতুন অপ্রস্তুত ইউনিভার্সিটিকে যথাযথ লাইনে নিয়ে আসতে যে কত কঠিন, তা সেখানে কাজ না করলে কোনদিনই বুঝতে পারতাম না। সেটি  ছিল এক কঠিন চ্যালেঞ্জ আমাদের সবার জন্য । উদ্বোধনী অনুষ্ঠান সফল করার জন্য আমরা নিরন্তরভাবে খেটে গেলাম। মাঝে মাঝে অযাচিত বাধা আর ঝামেলা কাজকে যেন রুদ্ধ করে দিত চাইতো। আস্তে আস্তে বসার ব্যবস্থা হলো, উদ্বোধনী অনুষ্ঠানও হলো অত্যন্ত ঝাঁকজমকের সাথে। সে সময় যে মানুষটি পুরো টিমের অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করতেন, তিনি হচ্ছেন আরীফ ইকবাল।

নর্থ ইস্ট ইউনিভার্সিটিতে যোগদানের পরেই আরীফ ভাইয়ের সাথে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। প্রতিদিনের ক্লান্তিহীন পথচলায় ঘটে যাওয়া ছোটখাটো ঘটনাগুলো আমরা ভাগাভাগি করতাম, পরামর্শ চাইতাম পরস্পরের কাছে। ঘনিষ্ঠতার মাত্রা আনুষ্ঠানিকতা ছেড়ে বন্ধুত্বে রূপলাভ করলো। সম্পর্ক এ পর্যায়ে উন্নীত হলো যে, আমাদের পরস্পরের মধ্যে  একধরণের নির্ভরশীলতা তৈরি হলো। কোন বিষয়-ই তাঁর সাথে শেয়ার না করলে যেন তা অতৃপ্ত থেকে যেত। অনুরূপভাবে তিনিও যেন কোন কিছু, এমনকি গোপনীয় কিছু হলেও, শেয়ার না করে পারতেন না। গ্রামের বাড়িতে প্রায়ই আমরা ছুটে যেতাম সবার অজান্তে। কত কথা, কত গল্প, কত আড্ডা!!

এরমাঝেই আমার ব্যক্তিজীবনে নেমে এল নিকষকালো অন্ধকারের এক অদ্ভুত অধ্যায়। বিপদের ঘনঘটায় আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ়। ব্যাপারটি কারও সাথে শেয়ার করা যাচ্ছিলনা। অনেক চিন্তা করলাম কার সাথে ব্যাপারটি শেয়ার করা যাবে কিংবা কার কাছে যথাযথ পরামর্শ পাওয়া যাবে! শেষ পর্যন্ত যে মানুষটির সাথে ব্যাপারটি নিয়ে কথা বললাম। ব্যাপারটি শুনে তিনি সহানুভূতির প্রকাশ করলেন অত্যন্ত মমতাভরা হৃদয় দিয়ে। কি করতে হবে, সে ব্যাপারেও পরামর্শ দিলেন। জীবনের ক্রান্তিকালীন সে সময়ে যখন যা করার প্রয়োজন, তিনি সর্বান্তকরণে সবই করেছেন। তিনি কেবল একজন কলীগ ছিলেন না, ছিলেন একজন আদর্শ বন্ধু ও অভিভাবক।

রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান আরীফ ইকবাল। বাবা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, আওয়ামীলীগের সভাপতি। সেজন্য বিভিন্ন কাজে প্রতিদিন দেখতাম নানা শ্রেণী-পেশার লোকজন আসতো তার কাছে। তিনি সবার সাথে হৃদত্যাপূর্ণ ব্যবহার করতেন। মানুষের দু:খে দেখেছি অকাতরে নিজেকে নিয়োজিত করেছেন। তিনি ছিলেন সহকর্মীদের প্রতি আন্তরিক, গরীবের বন্ধু, অসহায়ের সহায়। যে যে ঘাটে আটকা পড়তো, সবাই ছুটতো আরীফ ভাইয়ের কাছে। তিনি কাউকেই কখনো নিরাশ করতেন না।

সে অসাধারণ মানুষটি, ব্যতিক্রম বন্ধুটি, আদর্শ সহকর্মীটি গতকাল মঙ্গলবার, ২ অক্টোবর, ২০১৮ ইং সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় চলে গেছেন অনন্তের পথে। ’জন্মিলে মরিতে হইবে অমর কে কোথা কবে’-সে সত্যের পথ ধরে আরীফ ভাই চলে গেছো না ফেরার দেশে। অনেক অব্যক্ত কথা, অনেক অনেক কাজ করার কথা ছিল আপনার সাথে। ভালো থাকুন, আরীফ ভাই। পার্থিব জীবনের মতো পরকালের সে জীন্দেগীও হোক হাসিমাখা, আনন্দময়। কেন জানি  নজরুলের সেই কালজয়ী গানটি বারবার গুনগুনিয়ে গাইতে মন চাচ্ছে-

ঘুমিয়ে গেছে শ্রান্ত হয়ে আমার গানের বুলবুলি।
করুণ চোখে চেয়ে আছে সাঝের ঝরা ফুলগুলি।।

ফুল ফুটিয়ে ভোর বেলা কে গান গেয়ে
নীরব হ’ল কোন বিষাদের বান খেয়ে
বনের কোলে বিলাপ করে সন্ধ্যারাণী চুল খুলি।।

কাল হতে আর ফুটবে না হায়, লতার বুকে মঞ্জরী
উঠছে পাতায় পাতায় কাহার করুণ নিশাস মর্মরী।

গানের পাখি গেছে উড়ছে শূণ্য নীড়
কণ্ঠে আমার নাই সে আগের কথার ভিড়
আলেয়ার এ আলোতে আর আসবে না কেউ কুল ভুলি।।

আব্দুল হাই আল হাদী, লেখক ও পরিবেশকমী, নর্থ ইস্ট ইউনিভার্সিটির সাবেক সহকারী রেজিস্টার।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত