আসিফ আযহার

১৬ অক্টোবর, ২০১৮ ০১:৩৯

শাবিপ্রবির ভর্তি পরীক্ষা এবং একটি প্রশ্ন

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) ভর্তি পরীক্ষার দিন সকালে সিলেটের দক্ষিণ সুরমায় দাঁড়িয়ে আছি। আমার মতো আরও হাজার হাজার মানুষ সেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। আমার মতো অনেকেই ঢাকা থেকে এসেছেন। আগের দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা ছিল। সেখানে একজন পরীক্ষার্থীকে নিয়ে গিয়েছিলাম। রাতের বাসে সিলেটের উদ্দেশ্যে রওনা হই যাতে আমার সাথের পরীক্ষার্থীটি সকালে শাবিপ্রবির ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে পারে।

বাসের অন্য সকল যাত্রীরাও ছিল হয় পরীক্ষার্থী অথবা তাদের অভিভাবক। বাস যখন সিলেটে পৌঁছাল তখন সাড়ে নয়টা হয়ে গেছে। অর্থাৎ পরীক্ষার হলে প্রবেশের সময় হয়ে গিয়েছে। আমি আতঙ্কের সাথে আবিষ্কার করলাম আমার মতো হাজার হাজার মানুষ শহরে প্রবেশের জন্য যানবাহন খুঁজছেন কিন্তু এতো মানুষকে নিয়ে যাওয়ার মতো কোন যানবাহন নেই। আমি নিশ্চিত হয়ে গেলাম আমার সাথের পরীক্ষার্থীটি আর কোনভাবেই পরীক্ষায় অংশ নিতে পারবে না!

কারণ দক্ষিণ সুরমা থেকে পরীক্ষার হলে হেঁটে যেতে হলে কমপক্ষে একঘণ্টা সময় প্রয়োজন। এতো সময় আমাদের হাতে নেই। আবার কোন যানবাহনও নেই। হঠাৎ যে দু-একটি সিএনজি ছুটে আসছে সেগুলো দখলের জন্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ লেগে যাওয়ার অবস্থা! দেখলাম এসব সিএনজিওয়ালারা দশগুণ পর্যন্ত বেশি ভাড়া আদায় করছে। এদিকে আবার প্রতি মিনিটে মানুষের সংখ্যা আরও বাড়ছিল। আমাদের পেছনেও কয়েকশ বাস আসছিল। সামনেও শত শত বাস এসেছিল।

এতো বেশি পরিমাণ বাস ধারণের ক্ষমতা ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ছিল না। ফলে স্বাভাবিকভাবেই যানজটের সৃষ্টি হয়েছিল। ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত যানজট কথা বাদ দিলেও হবিগঞ্জ থেকে শুরু হওয়া যানজটের কথা না বলে পারা যায় না। এদিন ছাড়া জীবনে আর কখনও হবিগঞ্জে যানজট হতে দেখিনি। এ যানজট আমাদেরকে কয়েক ঘণ্টা পিছিয়ে দিয়েছিল। ভর্তি পরীক্ষার আগের রাতে অন্তত: পঞ্চাশ হাজার মানুষ সিলেটের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছিলেন।

তাদের অনেকেই নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সিলেটে পৌঁছাতে পারেননি। আবার অনেকে সিলেটে পৌঁছেও পরীক্ষার হলে যেতে পারেননি। ভাবতে অবাক লাগে শাবিপ্রবির ভর্তি পরীক্ষায় হাজার হাজার শিক্ষার্থী অংশ নিতে পারেনি কেবল যানবাহনের অভাবে। দক্ষিণ সুরমায় আটকে পড়া কয়েক হাজার শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের স্বপ্নভঙ্গের এই নির্মম দৃশ্য সেখানে দাঁড়িয়ে নিজের চোখে দেখছিলাম। পরীক্ষার হলে প্রবেশের সময় যখন পেরিয়ে গিয়েছে তখনও দক্ষিণ সুরমায় অবস্থানরত অসংখ্য শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকরা যানবাহন খুঁজছিলেন।

বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে কিংবা বর্ডার গার্ড স্কুলে অথবা এমসি কলেজে পরীক্ষা দেবে এমন অনেক শিক্ষার্থীদেরকে সেখানে সাড়ে নয়টায়-দশটায় যানবাহন খুঁজতে দেখেছি। এক অভিভাবককে জানালাম তাঁর মেয়ে আর কোনভাবেই পরীক্ষা দিতে পারবে না। কারণ ইতোমধ্যে প্রায় দশটা বেজে গিয়েছিল এবং পরীক্ষা কেন্দ্র রাগীব রাবেয়া মেডিকেলে যেতে হলে কমপক্ষে আরও চল্লিশ মিনিট সময়ের প্রয়োজন ছিল।

এই সংবাদটি শুনে পরীক্ষার্থী মেয়েটি অসহায়ের মতো কাঁদছিলো। অভিভাবক ভদ্রমহিলা তিক্তস্বরে জানালেন সিলেটের মানুষের জন্যই পরীক্ষার্থীদের এই দশা! আমি ভদ্রমহিলাকে জানালাম আমার সাথের পরীক্ষার্থীটিও পরীক্ষায় অংশ নিতে ব্যর্থ হয়েছে এবং সে সিলেটের মানুষ! আমি নিজেও সিলেটের মানুষ! সিলেট শহরের মানুষ! একথায় ভদ্রমহিলা কিছুটা বিব্রত হলেন।

যাই হোক, সকাল দশটার পরে হেঁটে হেঁটে শহরে প্রবেশ করি। দেখলাম অনেক জায়গায় অনেক খালি সিএনজি দাঁড়িয়ে রয়েছে। দু-একজনকে বললাম তারা দক্ষিণ সুরমায় গিয়েছিলেন কিনা। তারা জানালেন দক্ষিণ সুরমায় এতো যাত্রীর কথা তারা জানেন না। তারা শহরের মধ্যেই পরীক্ষার্থীদের নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। পরে জানলাম, শহরের ভেতরেও নাকি প্রকট যানবাহন সঙ্কট ছিল এবং পাঁচ-ছয়গুণ পর্যন্ত ভাড়া আদায় করা হয়েছে।

এসব ঘটনা শাবিপ্রবির ভর্তি পরীক্ষার দিনটিকে ঘিরে সৃষ্টি হওয়া অসংখ্য ঘটনার একটি ক্ষুদ্র অংশ মাত্র। ছোটবেলা থেকেই এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার দিনটিকে দেখে আসছি। কিন্তু এবছরের মতো এতো অচলাবস্থা আর দেখিনি। প্রশ্ন হলো আগামী বছর পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? এবছর অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে, এতো বেশি বহিরাগত মানুষের ধারণক্ষমতা সিলেট শহরের নেই। আবাসন এবং পরিবহন ব্যবস্থা দুটোরই এতো ধারণ ক্ষমতা নেই।

আগামী বছর পরীক্ষার্থীর সংখ্যা আরও বাড়বে। সেক্ষেত্রে পরিস্থিতি কী হতে পারে? অনেকে ওরসের সময়কার উদাহরণ দিয়ে বলেছেন সিলেটে আরও বেশি মানুষের জায়গা হওয়া সম্ভব। এটি সঠিক উদাহরণ নয়। কারণ ওরসের সময় এক লক্ষ মানুষ মাজারে খোলা জায়গায় অবস্থান করে; হোটেলে নয়। আর ওরসের ক্ষেত্রে যানবাহনের প্রয়োজন হয়না। এ সমস্যার আসলেই কোন সমাধান নেই।

এ সমস্যাটি আমাকে কয়েক বছর আগের একটি ঘটনার কথা মনে করিয়ে দিয়েছে। ২০১৪ সালে শাবিপ্রবির ভর্তি পরীক্ষার কয়েকদিন আগে হঠাৎ দেখি সিলেট শহর থেকে একটি বিশাল মিছিল শুরু হয়েছে। মিছিলটির নেতৃত্বে রয়েছেন আলী আহমদ নামক জনৈক ভদ্রলোক। মিছিলের বিষয়বস্তু হল শাবিপ্রবি এবং যশোর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা বাতিল করতে হবে। সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা বাতিলের জন্য আন্দোলনকারিদের যে কমিটি হয়েছিল সেটির সভাপতি ছিলেন কয়েস লোদী।

আন্দোলনকারিদের সাথে কথা বলে আমি যা বুঝেছিলাম তা হল, যেহেতু মুহম্মদ জাফর ইকবালের মাথা থেকে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার ধারণাটি বেরিয়েছে অতএব সেটি প্রতিহত করা এক প্রকার কর্তব্য। ধারণাটি অন্য কারও মাথা থেকে বের হলে বোধ হয় তারা বিরোধিতা করতেন না। এই আন্দোলনকারিদের কাছ থেকে আমি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় শিখেছিলাম। সেটি হল দুনিয়ায় যতো গুরুত্বপূর্ণ আইডিয়াই আসুক, দেখতে হবে তা কার মাথা থেকে বের হল!

কেবলমাত্র মুহম্মদ জাফর ইকবালকে হেনস্তা করার জন্যই শাবিপ্রবি ও যশোর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা পণ্ড করা হয়। এরপর আগের মতোই কেবল শাবিপ্রবির ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। অদ্ভুত ব্যাপার হল, আমার পরিচিত যে ক’জন এইচএসসি ও আলিম পাশ পরীক্ষার্থীকে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার বিরুদ্ধে আন্দোলনে দেখেছি তাদের একজন ছাড়া আর কেউই বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই একক ভর্তি পরীক্ষায় টিকতে পারেনি!

এসব বিরক্তিকর স্মৃতি আর বাড়িয়ে লাভ নেই। সারা দেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আলাদা ভর্তি পরীক্ষার জন্য যে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে তার সমাধান কী তা আমরা ভালো করেই জানি। প্রত্যেকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব ভর্তি পরীক্ষায় সে বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু লোক আর্থিকভাবে লাভবান হয়। সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার ক্ষেত্রে এ আর্থিক লাভের বিষয়টি থাকবে না। তাই অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষই সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষায় আগ্রহী নয়।

আলাদা ভর্তি পরীক্ষার জন্য যে দুর্ভোগ সৃষ্টি হয় তাতে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কিছু আসে যায় না। এ সমস্যাটি তাদের নয়, আমাদের। তাই এটি অত্যন্ত স্পষ্ট ব্যাপার যে, এ সমস্যার সমাধান আমাদেরকেই করতে হবে। কিন্তু কোন পথে?

  • আসিফ আযহার: শিক্ষার্থী, ইংরেজি বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত