সঞ্জীবন সুদীপ

১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৫ ১৪:২৫

অভিজিৎ স্মরণ: ‘এক অভির রক্ত থেকে লক্ষ অভি জন্ম নেবে’

ধর্মীয় উগ্রবাদীদের হাতে প্রাণ হারানো বিজ্ঞান লেখক, গবেষক, ব্লগার ও মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা ড. অভিজিৎ রায়ের ৪৪তম জন্মদিন আজ ১২ সেপ্টেম্বর। অভিজিৎ রায়ের মৃত্যুপরবর্তী প্রথম জন্মদিনে তাঁকে স্মরণ করেছেন গণজাগরণ মঞ্চ কর্মী সঞ্জীবন সুদীপ

অভিজিৎদা’র সাথে আমার প্রথম কথা হয় ‘রকমারি’ যখন ফারাবীর হুমকিতে দাদার বই সরিয়ে নিয়েছিল। প্রথম এবং শেষ দেখা ২০১৫ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি। আরিফ রহমানের বই 'তিরিশ লক্ষ শহীদ; বাহুল্য নাকি বাস্তবতা"র মোড়ক উন্মোচন করবেন আম্মা ফেরদৌসি প্রিয়ভাষিণী। খুব সম্ভবত চারটায় নজরুল মঞ্চে স্লট নেয়া হয়েছিল। কিন্তু আম্মার খুব শরীর খারাপ, নজরুল মঞ্চের অল্প কয়েকটি সিঁড়ি টপকানোই তাঁর কাছে হিমালয় জয়। অগত্যা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেই মোড়ক উন্মোচন পর্ব সারা হলো। আরিফ বললেন, শুদ্ধস্বরে দাদা এসেছেন। আমরা গেলাম।

শান্তা আপু দাদার বই কিনে অটোগ্রাফ নিলেন। অটোগ্রাফ নেয়ার পরে ফটোসেশন, ক্যামেরায় আমি। দাদার কোনো ছবিই ভালো আসছিল না, বিপরীতে বন্যা আপুকে খুব প্রাণবন্ত লাগছিল। (এখনকার বন্যা আপুর কোনো ছবির দিকে আমি তাকাতে পারিনা, এত অল্প সময়ে কারো চেহারার এতটা পরিবর্তন আমি দেখিনি)।

আমি রসিকতা করে বললাম, দাদা, আপনার চেহারা অতোটা ভালো নয়, আপুর চেহারা ফটোজেনিক। শুনে দাদা খুব হাসলেন। বন্যা আপুও। জানতাম না এই হাসিমুখের ছবি দিয়ে মাত্র এক সপ্তাহ পরেই ব্যানার ছাপাতে হবে, 'অভিজিৎ রায়'রা হারলে হারবে বাংলাদেশ'...

ফেব্রুয়ারির ২৬ তারিখ রাতে আমি টিউশনি করে বাসায় ফিরেছি। প্রথমেই খবরটা দিলেন শান্তা আপু। আমি ধপ করে চেয়ারে বসে পড়লাম। প্রথম ফোন দিলাম ইমরান ভাইকে। বললেন, হাসপাতালে যাচ্ছি। সাবধানে আয়।

ক্যামেরা নিয়েই বের হলাম। রিয়াজ ফোন দিল, বন্যা আপুর জন্য রক্ত লাগবে। পলাশকে ফোন দিয়ে দ্রুত যেতে বললাম। ইমার্জেন্সিতে পৌঁছে দেখলাম, শাহবাগের সহযোদ্ধারা আগেই পৌঁছে গেছেন। ইমরান ভাই অজয় স্যারকে নিয়ে বেরিয়ে আসছেন, অজয় স্যারের মুখ পাথরের মতো। এই ঘোর দুঃসময়েও এতটুকু ভেঙে পড়েননি।

আমি আর রিয়াজ গেলাম খুন হওয়ার জায়গাটিতে, ফুটপাথে পড়ে আছে থকথকে মগজ, চশমা, বন্যা’পুর আঙুল আর ছোপছোপ রক্ত। রিয়াজ ছবি তুললো। আমরা আবার হাসপাতালে গেলাম। ডাক্তারদের সাথে কথা বলে ইমরান ভাই জানালেন, বন্যা আপু মোটামুটি নিরাপদ। খানিকটা স্বস্তি পেলাম।

মনে আছে শেষবার যখন আমি আর রিয়াজ হাসপাতাল থেকে বের হই, আমরা ঠিক বুঝতে পারছিলাম না আমরা কোথায় যাব। ইমার্জেন্সি গেইটের সামনে ফুটপাথের বেঞ্চিতে আমরা কিছু সময় চুপচাপ বসে থাকলাম। কেউ একজন ফোন দিয়ে টিএসসিতে যেতে বললো, আমরা রিকশায় উঠলাম।

টিএসসিতে এসে দেখলাম, রোড পেইন্টিং চলছে। ছাত্র ইউনিয়নের নেতাকর্মীদের দেখলাম। ইমরান এইচ সরকার সবার সাথে কথা বলছেন। আমরা বিচ্ছিন্নভাবে দাঁড়িয়ে কথা বলছি, রাতের টিএসসিতে শীতের বাতাস। এক অদ্ভুত নৈঃশব্দ্য জাপটে ধরে আছে পুরো চরাচর।

মাঝরাত পার হবার পরে বাসার দিকে রওনা দিলাম। বাসার গেটের সামনে আমরা থামতেই একটা হোন্ডা ব্রেক করলো, চমকে উঠলাম। পরে দেখলাম, আমাদের বিল্ডিং এরই একজন।

বাসায় ঢুকে দেখি সবাই চুপচাপ বসে আছে। কেবল ইমরান ভাই দেশি বিদেশি সংবাদ মাধ্যমের একের পর এক প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন ফোনে। এক ফাঁকে বললেন, কাল থেকে টানা অবস্থানের কর্মসূচী দিচ্ছি। ইভেন্ট ডিটেল দ্রুত ল্যাখ। জয় কর্মকারকে ডেকে বললেন ব্যানার রেডি করতে। আমি বোকার মতো বলার চেষ্টা করলাম, ভাই আপনি একটু সাবধানে চলেন। বিচিত্র হাসি দিয়ে বললেন, ব্যাটা, ভয় পাইছিস?

আমি ইভেন্ট ডিটেল লিখতে বসলাম, এত দীর্ঘ, এত দুঃসহ লেখা আর কখনোই লিখিনি মনে হয়। বারবার আঙুল থেমে যাচ্ছে, আর ভাই তাড়া দিচ্ছেন, দ্রুত কর, দ্রুত কর....

পরদিন আটটা নাগাদ বের হলাম। শুরু হলো টানা অবস্থান। তিনদিনের টানা অবস্থানের সময়ে চিনেছিলাম কিছু মানুষকে.....ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাষ্কর্যে শেষ শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য অভিজিৎ রায়ের প্রাণহীন দেহ আনা হলো। আমরা মিছিল নিয়ে যোগ দিলাম। মিছিল থেকে ক্ষোভের শ্লোগান উঠছিল, 'আমার ভাই খুন কেনো, প্রশাসন জবাব চাই', 'এক অভির রক্ত থেকে লক্ষ অভি জন্ম নেবে'...তাতে সরকারের কিছু পা চাটা দালালের গায়ে আগুন ধরে গেলো। বিক্ষুব্ধ জনতার কণ্ঠ থেকে যাতে তাদের প্রভুর নামে কোনো প্রতিবাদী শ্লোগান না উঠে, তার জন্য উনারা বললেন মৌন মিছিল করতে। বলা বাহুল্য তাতে আমাদের শ্লোগান থামেনি, বরং তা দ্বিগুণ শক্তি পেয়েছিল।

অভিজিৎ দা’ নেই আজ ছয়মাসের বেশি। বিচারের অগ্রগতি কতটুকু আমরা সবাই জানি। সেসব হতাশা নিয়ে অনেক কথা হয়েছে, আমার আরেকটা হতাশার জায়গা নিয়ে কথা বলেই শেষ করব। আজ যাদেরকে ফেসবুকে অভিজিৎ রায়কে নিয়ে সবচেয়ে বেশি হা-হুতাশ করতে দেখি, তাদের অনেককেই ব্যক্তিগতভাবে অনুরোধ করেছিলাম, আসুন আরেক বার সবাই মিলে রাস্তায় নামি। সাড়া দেননি, দিলে হয়তো আমরা ওয়াশিকুর বাবু, অনন্ত বিজয়, নিলয় নীলদের বাঁচিয়ে রাখতে পারতাম।

অভিজিৎ রায় নেই, নাজিম হিকমতের মতে বিংশ শতাব্দীতে শোকের আয়ু বড়জোর একবছর ছিল। জানিনা একবিংশ শতাব্দীতে তার আয়ু ঠিক কতো.....বেঁচে আছি, কেবল যেখানে অভিজিৎ রায়ের মগজ পড়েছিল ঐ জায়গাটুকু পার হয়ে আসার সময় অজান্তেই এক শূণ্যতা আঁকড়ে ধরে।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত