কেয়া চৌধুরী

১৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৫ ১২:০৯

বহুমুখী প্রতিভাবান সৈয়দ মহসিন আলী

সময়টা ১৯৯১, আব্বা (মরহুম কমান্ডেন্ট মানিক চৌধুরী) মারা যাবার পর হঠাৎ করেই, চেনাজানা অনেক মানুষ পরিবর্তন হতে লাগল। খুব কাছের মানুষ গুলো অল্প সময়ের ব্যবধানে কেমন যেন দূরের মানুষের মত আচরণ করা শুরু করল। যা তখন আমার, ছোট মনে, অনেকটা বিস্ময়য়ের সৃষ্টি করেছিল। আজকের স্মৃতিচারণে শৈশবের গোটা সময়কেই বড্ড সাদাকালো মনে হয়। এমন একটা পরিবর্তিত সময়ে, রাজনৈতিক পরিবারের একজন সদস্য হয়ে, আব্বার ঘনিষ্ঠ সহচরদের মধ্যে; হাতে গোনা দু’এক জন রাজনীতিবিদ, যারা পরিবারের সদস্যের মতই আমাদের সাথে পূর্বের মতই ভালবাসা নিয়ে কথা বলতেন। তাদের মধ্যে যাদের কথা খুব মনে হয়। তারা হলেন, প্রয়াত আব্দুল রাজ্জাক চাচা, আব্দুল হামিদ চাচা (বর্তমান রাষ্ট্রপতি), তোফায়েল চাচা, সৈয়দ মহসিন আলী চাচা, এনামুল হক মোস্তফা শহীদ চাচা (সাবেক সমাজকল্যাণমন্ত্রী)।

সৈয়দ মহসিন আলী চাচা যখনই হবিগঞ্জে আসতেন, তখনই আমাদেরকে দেখতে বাসায় ছুটে আসতেন। আমার এখনও মনে আছে, আব্বা মারা যাবার ক’দিন পরের ঘটনা, হঠাৎ একদিন রাত্রে অনেক লোকবল নিয়ে আমাদের বাসার সামনে বেশ ক’টি গাড়ি এসে থামলো। রাতের নীরবতা ভেঙ্গে, সৈয়দ মহসিন চাচার দরাজ কণ্ঠ আমাদেরকে খানিক ভরসার সঞ্চয় করল। আবেকআপ্লুত অশ্রুসিক্ত মহসিন চাচা; আব্বার স্মৃতি চারণ করতে থাকলেন। আমি তখন স্কুলের সপ্তম শ্রেণীতে পড়ি। আমার আব্বা যখন বেঁচে ছিলেন, বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের ছোট ছোট গল্প আমার আব্বার কাছ থেকেই প্রথম জেনেছি। কিন্তু একজন ‘গেরিলা যোদ্ধা’ বলতে কি বোঝায়, দেখতেই বা কেমন, তা আমি প্রথম সেদিন দেখে জেনেছিলাম সৈয়দ মহসিন আলী চাচার মাধ্যমে।

মহসিন চাচার পরনে সফেত সাদা পাঞ্জাবী-পায়জামা, গাড়ো কাল রঙ্গের মুজিব কোর্ট। ডান হাতে জ্বলন্ত একখানা সিগারেট। হঠাৎ আমাকে কাছে ডেকে তার কোলে বসালেন। আব্বার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে, গেরিলা যুদ্ধে আমার আব্বার দেওয়া প্রশিক্ষণের গল্প তিনি আমাকে শুনিয়েছিলেন সেদিন। সেই গল্প কত না- ভয়ঙ্কর। কত না ত্যাগের। দেশপ্রেমের ভালবাসার গল্প। কথা বলতে বলতে, মহসীন চাচা হঠাৎ, হাত দিয়ে পাঞ্জাবীর হাতা তুলে তার হাতের দুই কনুইতে কাল দাগ গুলি দেখিয়ে আমাকে সেদিন; তিনি বলছিলেন, ৭১ সালে তিনি কিভাবে একজন গেরিলা যোদ্ধা হয়ে উঠেছিলেন। গেরিলা যোদ্ধাদের যুদ্ধের বৈশিষ্ট্য কি। সেদিনই প্রথম আমি গেরিলা যুদ্ধের সম্মুখ যোদ্ধার কাছ থেকে, গেরিলা যুদ্ধের গল্প শুনেছিলাম।

২০০৬ সাল থেকে বীরাঙ্গনা নারীদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য চেতনায়’ ৭১ হবিগঞ্জের মাধ্যমে আমি যখন তৃনমূলে কাজ শুরু করি। আমার এই কাজের সর্বশেষ স্বীকৃতিটি সৈয়দ মহসিন আলী চাচার মাধ্যমে পরিপূর্ণতা পায় ২০১২ সালের ৯ই ডিসেম্বর। ২০০৯ সালে হবিগঞ্জের ৬ জন নির্যাতিতা নারীকে বীরমুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গ্যাজেট ভুক্ত করার আবেদন করলে, জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের যাচাই-বাছাই শেষে, বীরমুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ মহসিন আলী এম.পি-র সহযোগিতায় ৩নং সেক্টরের সম্মুখ যুদ্ধের সহযোদ্ধা নারী মুক্তিযোদ্ধা রাজিয়া খাতুন, পঙ্গু নারী মুক্তি যোদ্ধা ফরিজা খাতুন, নির্যাতিত নারী মুক্তিযোদ্ধা মালতি রাণি সুক্লবৈদ্ধ্য, নির্যাতিত নারী মুক্তিযোদ্ধা পুষ্প রানি সুক্লবৈদ্ধ্য, হীরামনি শাওতাল ও সাবিত্রী নায়েকের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতির বিষয়টি নিশ্চিত হয়। আমার জীবনের এই অনন্য দূর্লভ কাজটির সাথে সৈয়দ মহসিন আলী চাচার অসাধারণ সহযোগিতা আমাকে সেদিন, দৃঢ প্রত্যয়ী করে তুলতে সাহায্য করেছিল।

হবিগঞ্জ সিলেট আসনে আওয়ামীলীগের সংরক্ষিত মহিলা এম.পি হবার পর, সমাজ কল্যাণ মন্ত্রী সৈয়দ মহসিন আলী চাচার সাথে চা শ্রমিক ইউনিয়নের নির্বাচনে, প্রতিটি বাগানে কাজ করার সুযোগ আমার হয়েছিল। তার সুরলা কন্ঠে দেশাত্মকবোধক গান শ্রোতাদেরকে যাদুকরী দেশপ্রেমে উদ্ভুদ্ধ করত। রাজনীতিবীদ হয়েও তার এই প্রতিভাটি ছিল, অন্য সবার চেয়ে আলাদা।

যতগুলা জনসমাবেশে তার সাথে আমার যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। প্রতিটি সমাবেশে তিনি আমাকে ‘মা’ বলে সম্মোধন করে পরিচয় করিয়ে দিতেন। একজন মন্ত্রী এবং একজন সংসদ সদস্যের মধ্যকার সম্পর্কে নয়, বরং তার রাজনৈতিক সম্পর্কের বড় ভাই ‘মানিক ভাই’ এর মেয়ে হিসেবে আমাকে তিনি সবসময় আগলে রেখেছিলেন। আমার গলায়, ‘জয় বাংলা’ ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ শ্লোগানটি তার খুব প্রিয় ছিল। যতবার, সভা-সমিতিতে আমি শ্লোগান ধরে নেতাকর্মীদের মাতিয়ে তুলবার চেষ্টা করতাম, ততবারই তিনি হাত তালি দিয়ে আমকে উৎসাহিত করতেন। মহসিন চাচা আমাকে প্রায়ই জিজ্ঞাসা করতেন, ‘হেই দিনের ফুরি হইয়্যা তুই, ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে- গলায় ওত জোড় ফাছ ক্যামনে?’ আমি হেসে উত্তর দিয়ে বলতাম, ‘মনের বিশ্বাস থ্যাইক্যা ‘জয় বাংলা’ ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ শ্লোগান কই... চাচা, এটাই আমার শক্তি’। আমার এই উত্তরে, চাচা খুশি হয়ে কতবার যে... মাথায় ধরে আমাকে আদর করেছেন। তার হিসাব নেই।

চিকিৎসারত অবস্থায় মহসীন চাচা আমাদের ছেড়ে, পৃথিবী থেকে চলে গেছেন। আওয়ামীলীগের বর্ষিয়ান নেতা, সমাজকল্যাণমন্ত্রী সৈয়দ মহসিন আলী-কে মৃত্যু আমাদের কাছ থেকে কেড়ে নিতে পারে। কিন্তু দেশপ্রেমে ভরপুর সততার প্রতীক, বীরমুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ মহসিন আলী চাচার আদর্শ ততদিন বেঁচে থাকবে। তার কাছ থেকে শোনা গেরিয়া যুদ্ধের সাহসী গল্পের, বিশ্বাস থেকে অর্জিত আমার দেশাত্মবোধের চেতনা থেকে তোলা, ‘জয় বাংলা’ ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ প্রাণ প্রিয় স্লোগানে স্লোগানে।

গোটা জীবনে দেশপ্রেম, অভয় চিত্তে অন্যায়ের প্রতিবাদের সোচ্চার সাহসি সৈনিক, সততার অনন্য প্রতীক-সজ্জন ব্যক্তিত্ব বীরমুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ মহসিন আলীর চাচার প্রতি আমার বিনম্র শ্রদ্ধা ও গভীর ভালবাসা।

দোয়া করি, আল্লাহ যেন তাকে বেহেশত নসিব করেন। আমিন।



লেখক: সংসদ সদস্য।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত