০৫ এপ্রিল, ২০২০ ১৯:৩২
করোনাভাইরাস আক্রান্তের খোঁজে গ্রাম থেকে গ্রামে ছুটছেন চিকিৎসকরা। ছবিটি ডা. মোহাম্মদ আবু নাহিদের ফেসবুক থেকে নেওয়া
আমি তাঁর নাম ভুলে গেছি। নয়-দশ বছর বয়েসের কথা। দ্বিতীয়বার মাথা ফাটিয়েছি। সন্ধ্যার আগে-আগে। দিরাই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ইমার্জেন্সিতে নিয়ে যাওয়া হলো। জ্যোতির্ময় কাকা খবর পেয়ে লুঙ্গি পরেই দৌড়ে এলেন। তিনটা সেলাই লেগেছিলো। আরেকজনও এসেছিলেন, ছোটখাটো দেখতে। বিলাপ দিয়ে কাঁদছি। প্রথমেই জড়িয়ে ধরলেন। তার কাপড়ে রক্ত লাগছিলো সেটা পাত্তা দিলেন না। এইতো আন্টি এসে গেছি, কিচ্ছু হয়নি বাবা বলে আমাকে আদর করছিলেন... কান্না থেমেছিলো কীনা মনে নেই। মনে নেই সেই আন্টির নাম। অথচ এর পরেও আরো অনেকবার উনার সাথে দেখা হয়েছে। প্রতিবার আমার কপালের কালো দাগটা তিনি আদর করে ছুঁয়ে দিয়েছেন। তিনি দিরাই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের নার্স ছিলেন।
হাসপাতাল, ডাক্তার, নার্সদের সাথে আশৈশব যোগাযোগ। মায়ের অসুখ দিয়ে শুরু। এখন নিজেই নিয়ম করে যাই।
২০১৮ এর অগাস্ট ২১। আমার বন্ধু সেলিনা তুলির অপারেশন ছিলো। সারাদিন পেরিয়ে সন্ধ্যা হয়ে গেছে। কোন খবর নেই। ঠায় দাড়িয়ে আছি করিডোরে, মাঝে মাঝে বসছি ওয়েটিং রুমে। ছেলে বাড়িতে একা। সেটা ছিলো ঈদের দিন। তাই বাধ্য হয়ে বাড়িতে ফিরে এসেছি। একটু পর পর ফোন করছি রিসিপশন থেকে দেয়া ওয়ার্ডের ফোন নাম্বারে। প্রতিবার একজনই সেই ফোন ধরছেন। তার কাছে কোন খবর নেই। আমার বাজে অসহিষ্ণু ইংরেজিতে হয়তো তিনি বিরক্তই হচ্ছিলেন, তবু বললেন, মাই সান, বার বার ফোন করতে হবে না। আমাকে বিশ্বাস করো, যখনই কোন খবর পাবো আমি, সেটা যতো রাত হোক সাথে সাথে জানাবো। তুমি ফোন খোলা রেখো। এতক্ষণ যেটা মনে হয়নি, তার কথা শোনে মনে হলো, তিনি বয়েসী মানুষ, তিনি আমার মা-খালার মতো কেউ।
রাত সাড়ে ১১ টার দিকে তিনি সত্যি সত্যি কল দিয়েছিলেন। নিয়ম ভেঙে মেয়েদের ওয়ার্ডে ঢুকতে দিলেন। তাঁকে দেখে আমাদের যে কারো মায়ের মতোই মনে হয়েছে। বয়েস আর শরীরের ভার জয় করে থপ থপ করে দরোজা পর্যন্ত এগিয়ে এলেন। আমার হাত ধরলেন, উষ্ণ নরোম হাত। বললেন, চিন্তা করো না, আমরা সারারাত ওর দেখভাল করবো। ইশ্বর নিশ্চয় দয়ালু... সারাদিনের চিন্তা, ক্লান্তি উবে গেলো। নির্ভার হয়ে বাড়ি ফিরেছিলাম।
এর মাস ছয়েক পর দেখা হলো আরেকজনের সাথে। ম্যাগি নাম। বেদনার মতো নীল গাউন পরে গ্ল্যান্ডফিল্ড ক্যানসার স্ক্রিনিং বিভাগের ছোট্ট একটা রুমে আমাদের নিয়ে তিনি বসে ছিলেন। হু হু করে কাঁদছিলেন। তিরিশ বছর আগে দিরাই হাসপাতালে যে মমতাময়ী আমাকে জড়িয়ে ধরেছিলেন ঠিক যেনো তিনিই এখানে উপস্থিত। ছোটখাটো একটা মানুষ৷ তুলিকে পারলে কোলে তুলে নেন৷ একবার হাত ধরেন আরেকবার জড়িয়ে ধরেন। আমাদেরকে ধাতস্থ করার কথা ছিলো উনার, উল্টো তাঁকে নিয়ে আমাদেরই ব্যস্ত হতে হলো। যখন বিদায় দিচ্ছিলেন সেদিনের মতো, বললেন অপারেশন যেদিন হবে তিনি অবশ্যই থাকবেন, কিন্তু এরপরেই তার ছুটি শুরু হবে। পেনশনে চলে যাচ্ছেন!
এমন অসংখ্য মানুষ আজ পৃথিবীময় ছড়িয়ে আছেন। যুদ্ধ করছেন, এক অসম যুদ্ধ। মায়া আর মমতায় মোড়া একেকটা মানুষ। প্রাণশক্তিতে ভরপুর একেকজন মানুষ।
তখন তুলির মাথার সব চুল পড়ে গেছে। আমিও মাথার চুল ফেলে দিয়েছি। নতুন কোন মানুষ এলে তুলির একটু অস্বস্তি হয় হয়তোবা। একজন নার্স এলেন বাড়িতে। হয়তো তিনি বিষয়টা বুঝতে পারলেন। কথা বলতে বলতে পরচুলা সরিয়ে নিজের চকচকে মাথা দেখিয়ে বলেন, তিনিও ক্যানসার জয় করেছেন! এই একটা মুহুর্তে তিনি কতোটা মনোবল বাড়িয়ে দিয়েছিলেন তুলির, সেটা হয়তো নিজেও জানেন না। অথবা জেনে বুঝেই করেছেন, জীবনকে জয়ী করবেন বলে। নিশ্চয় তিনি আজ কোথাওনা কোথাও আছেন আমাদের সম্মিলিত যুদ্ধে। হয়তো তুড়ি মেরে বলছেন, এই দেখো ক্যানসার জয় করে আজ এখানে দাঁড়িয়ে আছি, এই যুদ্ধেও জয়ী হবো। তার দেওয়া প্রেরণা ছড়িয়ে পড়ছে একজন থেকে আর জনে।
মিলানোভিচ নামের পাগলা ডাক্তার, যে অদ্ভুতভাবে পেশেন্টের বাচ্চা কোলে নিয়ে আদর করে কান্না থামাতে চায় অথবা আমারই মতো ট্রাফিক লাইট ফাঁকি দিয়ে টেসকোতে দৌড়ায়। নীলম পোদ্দার নামের ব্যস্ত কনসালটেন্ট শত কাজের মাঝেও ব্যক্তিগত ফোন থেকে পুরনো রোগীর খবর নেন। কিংবা আমার গরীব অপ্রস্তুত দেশের এক প্রান্তবর্তী জনপদের চিকিৎসক মোহাম্মদ আবু নাহিদ। যারা প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্ত লড়ছেন। লড়ছেন মানুষকে বিজয়ী করবেন বলে।
মানুষ বেশিরভাগই দায়িত্বজ্ঞানহীন, স্বার্থপর, অকৃতজ্ঞ। তবু আজ আমরা মানুষের বিজয় কামনা করি, কারণ ভীষণ ভিড়ে আজও কিছু প্রকৃত মানুষ রয়ে গেছেন। শিশুদের কথা ভেবে আজ সকল স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রতি শুভকামনা জানাই। আপনারা অভিবাদন গ্রহণ করুন হে অমৃতের পুত্র-কন্যাগণ।
(বন্ধু রিসনা হক, সালমা জাহান পনি, খায়রুল হাসান, গৌরীশ রায়, ও আমাদের কন্যা প্রেশাস জেগবার জন্য ভালোবাসা।)
নজমুল আলবাব: লেখক, সাংবাদিক।
আপনার মন্তব্য