শ্যামল কান্তি ধর

০৬ এপ্রিল, ২০২০ ২০:৫৩

মানুষই যদি না থাকে, কী হবে নতুন পৃথিবী দিয়ে

পোশাক শ্রমিকদের রাজধানীমুখে ফেরার মিছিল। কেউ হেঁটে, কেউবা ভ্যানে, যে যেভাবে পারে ফিরে আসছিল। সামাজিক দূরত্বের গুরুত্ব সেখানে অর্থহীন হয়ে গিয়েছিল অর্থনৈতিক নিরাপত্তার প্রশ্নে।সময়মত পৌঁছতে না পারলে কেউ বেতন পাবেন না, কেউবা আবার হারাতে পারেন চাকুরী। পৌঁছা তো গেল কিন্তু শোনা গেল কারখানা আবার বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। ততক্ষণে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সবাই এসে গেছেন রাজধানীর বুকে। চাকুরী সোনার হরিণ।চাকুরি যদি চলে যায়, তো এর বিড়ম্বনার শেষ নেই। এমন তো নয় যে চাকুরী চলে গেলে বেকার ভাতার ব্যবস্থা আছে। তাইতো পোশাক শ্রমিকদের এই ঝুঁকির মিছিল।

যদিও বলা হচ্ছিল মার্চ মাসের বেতন ঠিক সময়ে দেয়া হবে, তারও নিশ্চয়তা পাচ্ছিলেন না তাদের কেউ। অথচ সরকার থেকে গার্মেন্টস শিল্পের জন্য পাঁচ হাজার কোটি টাকার একটি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে অনেক আগে, যার পুরোটাই ব্যয় হবে পোশাক শ্রমিকের তিন মাসের বেতন হিসাবে। অবশ্য এই প্রস্তাবিত টাকা বিনা সুদে নয়। বাংলাদেশ ব্যাংক ইতোমধ্যে এ সংক্রান্ত সার্কুলার জারি করেছে। প্রণোদনাপ্রাপ্ত গার্মেন্টস মালিকদের দুই শতাংশ হার সুদে পুরো অর্থ পরিশোধ করতে হবে। এটা সঠিক সিদ্ধান্ত কারণ এই দুঃসময়ে অন্যান্য খাতের কথা বিবেচনা করতে হবে। আর গার্মেন্টস মালিকদের এই অর্থ সময়মত ফিরিয়ে দেবার সক্ষমতাও আছে। এখন অধিক মুনাফার সময় অবশ্যই নয়। আশা করছি খুব দ্রুত শ্রমিকদের বেতন ভাতা পরিশোধ করা হবে। দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অনেকটাই নির্ভর করে যাদের শ্রমের ঘামের উপর তাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা দেয়াটাও একটা মহান দায়িত্ব।

করোনা ভাইরাস কেড়ে নেবে অমূল্য কিছু প্রাণ তার সাথে রেখে যাবে অর্থনীতির উপর দীর্ঘমেয়াদী বিরূপ প্রভাব যাকে ইতিমধ্যে মহামন্দা হিসাবে অবিহিত করা হয়েছে। এই মহামন্দাকে মোকাবিলার প্রশ্নে বিশ্বনেতৃবৃন্দের কপালেও চিন্তার ভাঁজ দেখা যাচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ায় এর প্রভাবও হবে ব্যাপক। কতদিন থাকবে এই করোনা নামক মহামারী তা নিশ্চিত করে কিছুই বলা যাচ্ছে না। তাই অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ আগ থেকে নিরূপণ করা মুশকিল। মহামন্দায় দারিদ্র বাড়বে, কর্মহীনতার সংখ্যা বাড়বে। এরই প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার আর্থিক প্রণোদনা ঘোষণা করেছেন। এর মধ্যে ২০ হাজার কোটি টাকা ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোয় বাংলাদেশ ব্যাংক এর পুনঃ অর্থায়নের মাধ্যমে ঋণ সুবিধা প্রদান করা হবে বলে ধারনা করছি। বাংলাদেশ ব্যাংক এর পূর্ণাঙ্গ গাইডলাইনে হয়তো বিষয়টি সুস্পষ্ট হবে। এ ঋণ সুবিধার সুদের হার হবে ৯ শতাংশ। ঋণের চার শতাংশ সুদ ঋণগ্রহীতা শিল্পপ্রতিষ্ঠান পরিশোধ করবে এবং অবশিষ্ট পাঁচ শতাংশ সরকার ভর্তুকি হিসাবে সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে দেবে। এই আর্থিক প্রণোদনা বাস্তবায়ন করবে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। এর জন্য সঠিক শিল্পপ্রতিষ্ঠান যাতে এই ঋণ সুবিধা পায়, সেই জন্য ব্যাংকগুলোকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। মন্দা অর্থনীতিকে ঘুরিয়ে দেয়ার জন্য সঠিক এসএমই গ্রাহক নির্বাচনের কোন বিকল্প নেই।

এ ব্যাপারে, এক খাতের জন্য নেয়া অর্থ যাতে অন্য খাতে ব্যয় না হয় সেই জন্য ব্যাংকারদের সতর্ক হতে হবে। প্রধানমন্ত্রী এ মর্মেও আশ্বস্ত করেছেন যে, কাউকে চাকুরী হারাতে হবে না এবং দরিদ্র মানুষের বিনামূল্যে খাদ্য বিতরণ করা হবে। জনগণের সুবিধার্থে সরকারী ব্যয় বাড়ানো হবে এবং এই জন্য বর্তমান সময়ে অন্য কিছু খাতে ব্যয় কমানো হবে, যেমন: সরকারী কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণ কমানো হবে। প্রধানমন্ত্রীর এরকম উদ্যোগ সত্যিই প্রশংসা যোগ্য। আমি মনে করি, বড় বড় অবকাঠামোগত প্রজেক্টগুলোও আপাতত স্থগিত করে দেয়া ভালো। বরাদ্দকৃত এ খরচের অর্থে এখন করোনা রোধে বিশেষ ত্রাণ তহবিল গঠন করা যেতে পারে। মিশর ইতিমধ্যে তাদের মেগা প্রজেক্ট স্থগিত করেছে। প্রণোদনা প্যাকেজের বাকী অর্থ ব্যয় হবে অন্যান্য বৃহৎ শিল্প ও আমদানি রপ্তানিমুখি শিল্পে। উদ্দেশ্য একটাই, আসন্ন মহামারী মোকাবিলা। তাই সততার সাথে এই প্রণোদনা প্যাকেজের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।

প্রধানমন্ত্রীর এ রকম উদ্যোগ এর পাশাপাশি সক্ষম জনগণকেও এগিয়ে আসতে হবে তার সুবিধাবঞ্চিত প্রতিবেশীর জন্য। এই মহামারীর সাথে যুদ্ধে কিছুটা কৃচ্ছ্ব সাধন করতেই হবে। নিজের বিলাসী জীবন কিছুটা কাটছাঁট হয়তো নিরন্ন দিনমজুর মানুষের একবেলার অন্ন জুটে যেতে পারে। এই লেখা যখন লিখছি, বাংলাদেশে ১২৩ জন করোনায় সংক্রমিত হয়েছেন, মারা গেছেন ১২ জন। সাধারণ ছুটি বাড়ানো হয়েছে ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত। জানি না, আর কতজন আক্রান্ত হবে, মারা যাবে কতজন! আর কতদিন এভাবে বাড়ানো হবে ছুটি। ঘরে থাকার কথা যদিও বারবার বলা হচ্ছে। আমরা কোন না কোন অজুহাতে ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছি। বড় রাস্তায় না গেলেও পাড়ার গলির মুখে ঠিক জড়ো হচ্ছি।আমরা যে খুবই সামাজিক প্রাণী! এদিকে করোনা বসে নেই, গুচ্ছভাবে কমিউনিটিতে ছড়িয়ে পড়ছে। কেউ কেউ আবার ত্রাণের নামে ফটোসেশন শুরু করে দিয়েছেন। বরাবরের মতই, একজন ত্রাণ নিচ্ছেন আর বাকী দশজন ত্রাণ হাতে ক্যামেরার দিকে থাকিয়ে আছেন! একবার যদি জেলা থেকে উপজেলা এবং গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে তাহলে তা নিয়ন্ত্রণের বাইর চলে যাবার সমূহ সম্ভাবনা।

গ্রামীণ অর্থনীতির দিকে এখন বিশেষ নজর দিতে হবে। অনাবাদী রাখা যাবে না ভূমি এক খণ্ডও। আসন্ন এই বৈশ্বিক মহামন্দায় বাইরের ঋণ/অনুদান কমে যাবে অনুমান করা যায়। তাই খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়া এখন সময়ের দাবি। গ্রামে কয়েকদিনের মধ্যে বোরো ধান উঠবে। প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবিত প্রণোদনা প্যাকেজে কৃষিখাতকেও গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। তবে এখানে কথা একটাই, প্রকৃত কৃষক যাতে এই ঋণ পান সেই ব্যবস্থা করতে হবে। ব্যাংকের মনিটরিং ব্যবস্থা অবশ্যই এখানে জোরদার করতে হবে। যেহেতু, ব্যাংক এ ঋণ দেবে এবং ব্যাংক সময়মতই এ ঋণের টাকা ফেরত চাইবে তাই যাচাই বাছাই করে দ্রুততম সময়ে ঋণ মঞ্জুর করতে হবে।

বিশ্বনেতৃবৃন্দের কপালে আজ চিন্তার বলিরেখা। বিশ্বের পরাক্রমশালীরা প্রতিনিয়ত ব্যস্ত ছিলেন মানুষ মারার অস্ত্র তৈরিতে। সবুজ ঘাস লাল হয় স্থল মাইন বিস্ফোরণে,নীল আকাশ ধুসর হয় বোমারু বিমানের হুঙ্কারে, নীল সমুদ্রে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয় করে পরীক্ষা করা হর পারমানবিক বিস্ফোরণ। বিশ্বকে জানিয়ে দেয়া হয় সগর্বে, আমরাও মানুষ মেরে ফেলতে পারি নিমিষে। তাও রীতিমত সেলিব্রেশন করে। জীবাণু অস্ত্র ছড়িয়ে দেবার হুঙ্কার। কথায় কথায় এক দেশের উপর আরেক দেশের অর্থনৈতিক অবরোধ। সীমান্তের বাঁধা টপকে মানুষ বাঁচতে চায়। সমুদ্র তীরে পড়ে থাকে শিশু আলিয়ানের লাশ। হায়রে কত বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার অর্থ ব্যয় করা হয় মানবতার বিরুদ্ধে। এখন করোনা নামক প্রাকৃতিক অস্ত্রের কাছে জিম্মি গোটা বিশ্ব। এই যুদ্ধে অসহায় পরাক্রমশালী বিশ্ব নেতারা। এই অর্থ যদি মানবতার কল্যাণে ব্যয় হত কিংবা একটা বিশ্ব ত্রাণ তহবিল গড়ে তোলা যেত! ইদানীং খুব শোনা যাচ্ছে করোনা পরবর্তী নতুন পৃথিবীর কথা। প্রকৃতি নিজেকে সাজিয়ে নিচ্ছে নতুন করে। সমুদ্রের পানি আরও নীল হচ্ছে, নির্মল আকাশ, ঝকমকে দিন, পাখির কলকাকলি, পরিবেশ দূষণের মাত্রা কমে যাচ্ছে অবিশ্বাস্যভাবে। হ্যাঁ, দূষণমুক্ত, মারণাস্ত্র মুক্ত পৃথিবী হয়তো গড়ে উঠবে। তবে তা বড্ড দাম দিয়ে। মানুষই যদি না থাকে কি হবে নতুন পৃথিবী দিয়ে?

  • শ্যামল কান্তি ধর: ব্যাংকার।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত