শামীম আহমেদ

১২ এপ্রিল, ২০২০ ২৩:০০

বাঁচার সম্ভাবনা বাসায় বেশি, হাসপাতালে না

করোনা ভাইরাসে নতুন রোগী আক্রান্তের সংখ্যার দিক দিয়ে আজকে বাংলাদেশ পৌঁছে গেছে বিশ্বের শীর্ষ ২৭ দেশের তালিকায়। তাও আমাদের যে পরিমাণ টেস্ট করা হয়, সেটা খুব গ্রহণযোগ্য মাত্রার না। যদি জনসংখ্যা এবং যেই পরিমাণ মানুষের মধ্যে করোনার লক্ষ্মণ আছে, সেই তথ্য বিবেচনায় টেস্ট করা সম্ভব হতো, তাহলে হয়ত বাংলাদেশ আক্রান্তের তালিকায় শীর্ষ ১৫ এর মধ্যে পৌঁছে যেত ইতোমধ্যে।

করোনা ভাইরাস ধরা পড়েছে, এমন মানুষের সংখ্যা এখন পৃথিবীতে প্রায় ১৮ লক্ষের মতো। এর মধ্যে সোয়া ৪ লক্ষ মানুষ সুস্থ হয়েছেন। আগামী কিছুদিন প্রায় প্রতিদিনই লক্ষাধিক মানুষ নতুন করে করোনা পজিটিভ হিসেবে ধরা পড়তে পারে। এর বাইরে লক্ষ লক্ষ মানুষ আছে যাদের করোনা ভাইরাস হয়েছে, কিন্তু টেস্ট হয়নি বলে এই হিসেবের বাইরে রয়ে গেছেন।

পৃথিবীতে যে অল্প সংখ্যক মানুষের টেস্ট করা হচ্ছে (বেশিরভাগ দেশের সামর্থ্যই সীমিত, সাথে আছে “সমন্বয়হীনতা”), সেই হিসেবেই এখনও প্রায় ১৩ লক্ষ মানুষের মধ্যে করোনা ভাইরাস বিরাজমান। এদের মধ্যে সোয়া ১২ লক্ষ মানুষের করোনা মাঝারি ঝুঁকিপূর্ণ। প্রায় ৫০ হাজার মানুষের অবস্থা বেশ খারাপ।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেবে প্রতি ১০০ জন করোনা পজিটিভ রোগীর মধ্যে প্রায় সাড়ে ৩ জন মারা যাচ্ছেন। সে হিসেবে যদি আর ১টা নতুন টেস্টও না করা হয়, তবুও আরও ৪৫ হাজার মানুষ মারা যাবেন। এখন পর্যন্ত মারা গেছেন ১ লক্ষ ১২ হাজার মানুষ। আরও ৪৫ হাজার যোগ হলে সেটি ১ লক্ষ ৫৭ হাজার জনে পৌঁছুবে; খেয়াল করুন, তাও শুধুমাত্র যদি নতুন কোন টেস্ট না করা হয়, তবেই!

সবচেয়ে আক্রান্ত ইতালি, ইরান, যুক্তরাজ্য, স্পেইন, ফ্রান্স, জার্মানি, চায়না, টার্কি, বেলজিয়াম, হল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড, ক্যানাডা ইত্যাদি দেশ তাদের আক্রান্তের মাত্রা বাড়তে থাকার যে ঊর্ধ্বগতি, ইতিমধ্যেই তার শীর্ষের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে বলে অনেকে ভাবছেন। অর্থাৎ এরপর আগামী কয়েকমাসে তাদের আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার আস্তে আস্তে কমতে পারে। এই কয়েকটি দেশ ছাড়া পৃথিবীর প্রায় সব দেশই এখনও নতুন আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যায় উপরের দিকেই ছুটছেন। পৃথিবীর সবচেয়ে আক্রান্ত ও বিপর্যস্ত দেশ যুক্তরাষ্ট্র তো এখনও তাদের সংক্রমণের শীর্ষেই পৌঁছেনি!

ক্যানাডার জনস্বাস্থ্য বিভাগ তাদের বিচার-বিশ্লেষণে বলেছে আগামী ৩ মাস এই দেশে সংক্রমণের হার আরও বাড়তে পারে। হয়ত মাস চারেক পর আক্রান্তের হার ও মৃত্যুর হার কমে যাবে। এটি এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্তের উপর ভিত্তিতে একটি আনুমানিক চিত্র মাত্র! এতক্ষণে যেসব দেশের কথা বললাম, তারা সব মিলিয়ে পৃথিবীর মাত্র ১২-১৩ টা দেশ।

বাকি আছে আরও ২০০ এরও বেশি দেশ। যেগুলোতে আক্রান্ত ও মৃত্যু শুরু হলো কেবল! কারও কারও শুরু হবার খবরও এখনও পাইনি আমরা! দক্ষিণ আমেরিকা এখন আস্তে আস্তে ঝুঁকির শীর্ষে যাচ্ছে; চায়না, ইরান ছাড়া বাকি এশিয়াও। আফ্রিকার কোন খবরই ঠিকভাবে পাওয়া যাচ্ছে না!

উপরে যেমনটা বলেছি, কয়দিন আগেও এই তালিকায় বাংলাদেশকে খুঁজে পাওয়া যেত না। নতুন রোগী আক্রান্তের সংখ্যার দিক দিয়ে আজকে বাংলাদেশ পৌঁছে গেছে তালিকার শীর্ষ ২৭ নাম্বারে। তাও আমাদের টেস্ট করার সক্ষমতা এখন পর্যন্ত ঢাকার বাইরে কম খুব জেলাতেই সক্রিয় রয়েছে। সারা বাংলাদেশে, পরিসংখ্যান এবং এপিডেমিওলোজির সূত্র অনুযায়ী টেস্ট করা হলে বাংলাদেশ আক্রান্তের তালিকায় শীর্ষ ১৫ এর মধ্যে পৌঁছে যেত বলে আমার ধারণা।

খুব দ্রুতই করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যা ২ লক্ষ ছুঁয়ে ফেলবে। ৩ লক্ষ ছুঁতেও খুব বেশি দিন লাগবে না। এই সংখ্যাটা অদূর ভবিষ্যতে ৫ লক্ষ ছুঁয়ে ফেলবে – এমন আশংকা যদি না করতে পারতাম, ভালো লাগত!

ক্যানাডায় মার্চের ১২ তারিখে প্রধানমন্ত্রী ট্রুডোর স্ত্রীর করোনা পজিটিভ হবার পর মূলত মার্চের ১৩ তারিখ থেকে ঘরে থাকতে বলা হয়। খেয়াল করবেন, ক্যানাডায় এখনও লকডাউন হয়নি। অনুরোধ করা হয়েছে ঘরে থাকতে, বেশিরভাগ মানুষ তা শুনেছে। উন্নত দেশগুলোর মধ্যে ক্যানাডার নিয়ন্ত্রণ এখনও বেশ ভালো। কিন্তু গৃহবন্দির একমাসের মাথায় মানুষ ক্লান্ত হয়ে পড়েছে, বিষণ্ণ হয়ে পড়েছে। এই সময়টা খুব খারাপ সময়। এই সময়টা নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি। আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে বাংলাদেশীরাও একই অবস্থায় পৌঁছুবেন।

করোনার এখন পর্যন্ত কোন সুনিশ্চিত চিকিৎসা নাই। বাংলাদেশে শুনেছি ভেন্টিলেটর আছে মাত্র ১১২ টা। আইসিইউ বেড কিছু বেশি। ধরেন ডাক্তারদের পিপিই, গ্লভস, মাস্ক প্রয়োজনমত দিলেন, তারাও সবাই ঝুঁকি নিয়ে তাদের দায়িত্ব পালন করল, তারপরও আপনি আক্রান্ত হলে আপনার বাঁচার সম্ভাবনা কতটুকু? আনুমানিক ১১২টা ভেন্টিলেটরে আপনার অভিগম্যতার সম্ভাবনা কত? যেদিন ১০০০ রোগী আক্রান্ত হবে, সেদিন ভিআইপি বাদ দিয়ে কয়জন ওই আইসিউতে জায়গা পাবেন? উন্নত দেশে যারা ভেন্টিলেটর সাপোর্ট পেয়েছেন, তাদের মধ্যেও ৬৫ ভাগ মারা গেছেন। তাই চিকিৎসা পাবার আশা থাকা ভালো, কিন্তু এ নিয়ে বিতর্ক এড়িয়ে সামর্থ্য থাকলে ঘরে থাকুন।

করোনায় আপনার বাঁচার সবচেয়ে ভালো সম্ভাবনা বাসায়, হাসপাতালে নয়। কিন্তু খেয়াল করুন তাই বলে যারা এই মহামারীতে সম্মুখভাগের যোদ্ধা, অর্থাৎ ডাক্তার, নার্স, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, পরিবহনকর্মী; এছাড়াও সাংবাদিক, ব্যাংকার - যাতে কোনভাবেই উপযুক্ত নিরাপত্তার সামগ্রীর সুবিধা থেকে বঞ্চিত না হয়।

আমার হিসেবে এই সময়ে যারা সবচেয়ে নিবেদিতভাবে কাজ করছেন, সবচেয়ে ঝুঁকির মধ্যে কাজ করছেন, তারা হচ্ছেন পুলিশ, সেনাবাহিনী এবং অন্যান্য নিরাপত্তাবাহিনীর সদস্যরা। তারা অনেকে ঝুঁকির সম্ভাবনা নিয়েও কথা বলছেন না। এইসব বাহিনীর মানুষরা নির্দেশ মানতে অভ্যস্ত, তাই মানুষের সেবায় ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। উচ্চবাচ্য করছেন না বলে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে যাতে আমরা পিছপা না হই।

বাইরে থেকে এসে হাত ধুয়ে নিন। কাপড় আলাদা করে ফেলুন। বাইরে গেলে মাস্ক পরার চেষ্টা করুন। ঘরে থাকলে ব্যায়াম করুন। পরিবারের সাথে সময় কাটান। নেগেটিভিটির চর্চা থেকে দূরে থাকুন। ফেসবুক আর খবর শোনার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করুন। বিশ্বস্ত একটি বা দুটি সূত্র, ফেসবুকের অথেনটিক ও এই বিষয়ে ভালো জানেন (আমি তাদের মধ্যে নই, আমার জ্ঞান সীমিত), এমন প্রোফাইলেই শুধু চোখ রাখুন।

ভালো থাকবেন। ধৈর্য ধরুন। নতুন পৃথিবীর সাথে অভ্যস্ত হোন। প্লিজ।

  • শামীম আহমেদ: সোশাল এন্ড বিহেভিয়ারাল হেলথ সায়েন্টিস্ট, ইউনিভার্সিটি অফ টরোন্টো।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত