সজল কান্তি সরকার

১৪ এপ্রিল, ২০২০ ০৩:০৪

চৈত্রসংক্রান্তি ও বর্ষবরণ উৎসব

গ্রামীণ জীবনাচারে বাংলা সনের ও ঋতুরাজ বসন্তের শেষ দিন ‘চৈত্রসংক্রান্তি’ বা ‘চৈতপরব’। নগর জীবনে যা ‘বর্ষবিদায়’ অনুষ্ঠান। সৌরনিয়মে এই দিন বিষুবরেখার প্রভাব বিদ্যমান থাকে বলে কারও কারও মতে তা ‘বিষুবসংক্রান্তি’ বা ‘মহাবিষুবসংক্রান্তি’। তবে গ্রামীণ বাঙালিয়ানায় তা চৈত্রসংক্রান্তি হিসেবেই জীবনঘনিষ্ঠ। ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের সমাজে বর্ষবিদায় বা বর্ষবরণ হচ্ছে ‘বৈসুক’(বৈশুখ) উৎসব। মারমাদের মাঝে ‘সাংগ্রাই’। তবে মারমাদের পানি উৎসবও অন্যতম। চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যাদের মাঝে তা ‘বিঝু’(বিজু) বা ‘বিষু’। আর তাই বৈসুক, সাংগ্রাই ও বিঝু বা বিষু তাদের আদ্যাক্ষর মিলে আদিবাসীদের প্রধান অনুষ্ঠান ‘বৈসাবি’। ‘হারিবৈসুক’ বা ‘হারবিষুব’ও একটি চৈতি উৎসব যা ঊনত্রিশ চৈত্র পালন করা হয়। চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যারা চৈত্রসংক্রান্তিকে ‘মুল বিঝু’ তার আগের দিন অর্থাৎ হারিবিষুকে ‘ফুলবিঝু’ এবং পহেলা বৈশাখকে ‘নয়াবঝর’ বা ‘গোজর্যাপোজর্যা, দিন বলে।

আদিগ্রন্থ পুরাণে বর্ণিত আছে রাজা দক্ষের সুন্দরী মেয়েদের নামানুসারে সাতাশটি নক্ষত্রের নামকরণ করা হয়। মেয়ে চিত্রার নামানুসারে চিত্রা নক্ষত্র। আর চিত্রা নক্ষত্রের নামানুসারে চৈত্র মাস। বিশখার নামানুসারে বিশখা নক্ষত্র থেকে বৈশাখ মাস। ফলে নক্ষত্র অনুযায়ী মাস নিয়ে হয় সৌরসন। রাজা শশাঙ্ক আনুষ্ঠানিক ভাবে বর্ষপঞ্জিকা লিপিবদ্ধ করেন। এ সময়ে বৈশাখি পর্বেরও আবাস পাওয়া যায়। বৈদিক যুগে সৌরসনের মাসচক্রে বৈশাখের সন্ধান মিলে যেখানে বৈশাখের স্থান দ্বিতীয়। ব্রহ্মাণ্ড পুরাণে অনুষঙ্গপাদের একটি শ্লোকে বৈশাখের স্থান চতুর্থ। তৈত্তিরীয় ও পঞ্চবিংশ ব্রাহ্মণগণের মতে বৈশাখের অবস্থান বছরের মাঝামাঝি ছিল। তারপর ভারতীয় সৌরসন গণনার পদ্ধতি চালু হয়।

মোগল সম্রাট আকবর ‘সুবে বাংলা’ প্রতিষ্ঠার পর বাংলাদেশের ফসল কাটার মৌসুম ও খাজনা আদায়ের সুবিধার্থে রাজ জ্যোতিষী ও পণ্ডিত আমির ফতেহউল্লাহ্ সিরাজী- সম্রাটের সিংহাসনে আরোহণ, ভারতীয় সৌরসন ও আরবি হিজরি সনের সমন্বয়ে ‘ফসলিসন’ এর প্রবর্তন করেন।

১৫৮৪ খ্রি. ১০ মার্চ বা ১১ মার্চ থেকে বাংলা সনের গণনা শুরু হয়। তবে কার্যকর করা হয় আকবরের সিংহাসন আরোহনের সময় ১৫৫৬ খ্রি. ৫ নভেম্বর থেকে। পরবর্তীতে ফসলি সনের নাম হয় বঙ্গাব্দ বা বাংলা বর্ষ। তখন থেকেই বৈশাখ বছরের প্রথম মাস। শুরু হয় বর্ষবরণ। মূলত মাস হিসেবে বৈশাখ প্রথম হবার মর্যাদা বেশি দিনের নয়। ১৯১৭ খ্রি. নববর্ষ পালনের খবর পাওয়া যায়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশদের বিজয় কামনায় পহেলা বৈশাখে হোম কীর্তন ও পূজার বিষয়টিও উল্লেখ রয়েছে। ১৯৩৮ খ্রি. তার আবাস পাওয়া যায়। পরবর্তীতে ১৯৬০-এর দশকে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নিপীড়ন ও সাংস্কৃতিক সন্ত্রাসের প্রতিবাদে ১৯৬৭ খ্রি. ছায়ানট বিশেষ ভাবে বর্ষবরণ অনুষ্ঠান শুরু করে।

১৯৫০ এর দশকে ভারত বর্ষের বিচারপতি পাণ্ডের নেতৃত্বে একটি কমিশন তৈরি হয় যেখানে ড. মেঘনাদ সাহা ও ড.মুহাম্মদ শহীদুল্লাহসহ আরও পণ্ডিতগণ উপস্থিত ছিলেন। কমিশনে ১৪ এপ্রিল পহেলা বৈশাখ উপস্থাপন হলে ‘নিখিল বঙ্গ সারস্বত সমাজ’ তা প্রত্যাখ্যান করেন। ১৯৬৬ খ্রি. ১৭ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমির তত্ত্বাবধানে ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বিষয়টি উল্লেখ করেন।

১৯৮৭ খ্রি. ১৪ এপ্রিল তৎকালের বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি এরশাদ বাংলা বর্ষবরণকে ইংরেজি ক্যালেন্ডারে নিয়ে আসেন। তাই ১৪ এপ্রিল পহেলা বৈশাখ। বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যায় যেখানে পহেলা বৈশাখ ১৫ এপ্রিল যুক্তিযুক্ত।

যাই হোক এবার ফিরে আসি মূল বিষয় চৈত্রসংক্রান্তিতে। চৈতের প্রচণ্ড তাপ থেকে পরিত্রাণ ও বর্ষার প্রারম্ভ পর্যন্ত বৃষ্টি লাভের জন্য সূর্যের তেজ প্রশমনে কৃষিসমাজ বহু অতীতেই এই অনুষ্ঠান করেছিল। মূলত মাস জুড়ে সূর্যের কৃপা প্রার্থনা করে বিভিন্ন ব্রত পালনের মাধ্যমে মাসের শেষ দিনটি বিশেষ ভাবে পালন করা হয়। যা চৈত্রসংক্রান্তি। কৃষিজীবীদের জন্য চৈত্রমাস বিশেষ ক্রান্তিকাল। এ বসন্ত যেন নীলাভ রৌদ্রদগ্ধ। তাই তারা নানা ব্রতাচারে সমস্যার মোকাবিলা করে আসছে। খরা ও তাম্রাভ রৌদ্রদগ্ধ মাসে বৃষ্টির আরাধনায় ব্যাঙাব্যাঙির বিয়ার প্রচলন রয়েছে। এ বিয়েকে কেন্দ্র করে মাগনগীতও প্রচলিত আছে। যেমন-
১.
কানামেঘা রে তুই আমার ভাই
একফুডা পানি দিলে শাইলের ভাত খাই...

২.
আল্লা মেঘ দে পানি দে
ছায়া দে রে তুই...

৩.
ব্যাঙাব্যাঙির বিয়া
কুলা মাথাত দিয়া
ওব্যাঙ মেঘ আনগা গিয়া...

জমির ফসল রক্ষায় বন্দকুমারী (শক্তিদেবী) পূজা চৈত্রসংক্রান্তির আগেই সম্পন্ন হয়। শাপান্ত-শিলান্ত-বসন্ত এ যেন (চৈতের) এসময়ের মহাদুর্যোগ ছিল, আছে। এসব থেকে রক্ষায় মন্ত্রসাধনের বিশ্বাস আজও আছে। সম্মিলিত প্রয়াসে প্রথা অনুযায়ী নতুনধান কাটা ও নবান্ন গ্রহণে ‘আগ-লওয়া’ ও লক্ষ্মীব্রত চৈত্রসংক্রান্তিরই ধারাবাহিক পর্ব। এ উপলক্ষে বাড়ির আবহ রক্ষায় তুলসী গাছে ধারা বেঁধে পানি দেওয়ার প্রচলন আছে। পথে-ঘাটে গোবর ও বরুণ ফুলের ঘাটা বন্ধন। গোয়ালঘরে নিয়মিত ধূয়া দেওয়া। পূর্বপুরুষের শান্তি কামনায় গঙ্গাস্নান। ঘরের সাজসজ্জা বৃদ্ধি। স্বাস্থ্যরক্ষায় নানা শাক-সবজি দিয়ে ব্রতের ভোগ প্রদান সহ খাবারের আয়োজন। বিশেষ করে চৈত্রসংক্রান্তিতে টক এবং তিতা ব্যঞ্জন খেয়ে সম্পর্কে তিক্ততা ও অম্লতা দূরের প্রতীকী প্রথার প্রয়াস এখনও রয়েছে। প্রকৃতি রক্ষায় নানা আচার অনুষ্ঠান, যেমন-বাড়ির গাছ-পালায় বন্ধনী দেওয়াসহ নানা প্রথা। বিশেষ করে চৈত্রসংক্রান্তির আগে আম না খাওয়ার রেওয়াজ এখনও প্রচলিত আছে। সর্বোপরি প্রতিটি পর্বকে কেন্দ্র করে গীত-গান ও ব্রত কথা তো আছেই।

চড়ক চৈত্রসংক্রান্তির একটি প্রধান উৎসব। চড়ক মেলায় অংশগ্রহণকারীগণ শারীরিক কসরত প্রদর্শন করেন। শুলফোরা,বানফোঁড়া,বড়শিগাঁথা ও আগুনে হাঁটা এ উৎসবের বিশেষ আকর্ষণ। তাছাড়া চৈত্রসংক্রান্তির অন্যতম আকর্ষণ গাজন লোকউৎসব। পৌরাণিক ও লৌকিক দেবতার নাম যেমন- শিবের গাজন,নীলের গাজন ইত্যাদিতে কৃষক সমাজের একটি সনাতনি বিশ্বাস কাজ করে। চৈত্রসংক্রান্তির সমাপনীর মধ্যে দিয়েই শুরু হয় পহেলা বৈশাখ। পহেলা বৈশাখকে কেন্দ্র করে বাঙালি মেতে ওঠে অসাম্প্রদায়িক চেতনায়। ১৯৮৯ খ্রি. থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইন্সটিটিউটের উদ্যোগে মঙ্গল শোভাযাত্রা এ উৎসবের উল্লেখযোগ্য বিষয়। কৃষিজীবী সমাজেও বর্ণীল রঙে সেজে আনন্দ উল্লাসের প্রথা রয়েছে তাতে। কৃষি সম্পদ গরুর যত্নসহকারে গোসল ও গায়ে নানা রঙের ‘হাঁদা’ দেওয়ারও প্রচলন রয়েছে। তাছাড়া গ্রামীণ জীবনে ফসল রক্ষায় জমিনে ‘বিশঃকাটি’ স্থাপন পহেলা বৈশাখের একটি উল্লেখযোগ্য বিষয়। সাধারণত খাগড়া দিয়ে বিশঃকাঠি তৈরি হয়ে থাকে।
নিয়মানুসারে খাগড়ার পাতা গুটি বেধে কয়েকটি খাগড়ার মুষ্টি তৈরি করে জমিনে নিশানের মতো রাখা হয়। কৃষিজীবীদের মাঝে যা শিলাবৃষ্টির রক্ষাকবচ স্বরূপ। বাঙালি খাবারের নানা আয়োজনসহ পিঠা-পায়েস, ছাতু খাওয়া, নতুন কাপড় পরিধান, মেলা, মৃতকারু পট শিল্পের আয়োজন, লাঠিখেলা, ষাঁড়ের লড়াই, কুস্তিখেলা, ঘুড়ি ওড়ানো, গান, সঙযাত্রা, যাত্রাপালা, কীর্তন, বায়স্কোপ, সার্কাস ও হালখাতা বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। বিশেষ করে হালখাতায় দেনা পরিশোধের রীতি এখনও চালু আছে। নববর্ষের বৈকালিক আয়োজন হিসেবে গাঁয়ের মাঠে ঘুড়ি ওড়ানো প্রতিযোগিতা ছোট-বড়ো সকলের মন কারে। ষাঁড়ের লড়াই নিয়ে রীতিমতো দলীয় আমেজ সৃষ্টি হয়। লড়াইয়ে যে ষাঁড় জয়ী হয় সে দল সারা পায়ে মিছিল করে জয় ও আনন্দের বার্তা প্রকাশ করে। স্লোগান দেয়-
জিতরে ভাই জিতঙে
জিত্তিয়া আইলাম আড়ঙে।

পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে সারা মাঠ জুড়ে ফুটবল খেলাসহ দলে দলে নানা ক্রীড়া নৈপুণ্য প্রদর্শন হয়। বিশেষ করে কুস্তি খেলার বীরত্ব প্রতিভা সমাজের কাছে পুরুষত্বের অহংকার স্বরূপ। প্রথমে একজন কুস্তিবীর মাঠে নানা শারীরিক কসরত প্রদর্শন করে আরেক জনকে আহবান করে। যে মাল (বীর) খেলায় জয়ী হয় তাকে নিয়ে ঝাজম্যান ডি.ডি.ডি. মাল বলে আওয়াজ তুলে মাঠ প্রদক্ষিণ করে পুনরায় অন্যকে আহ্বান করে। তারপর সর্বশেষ জয়ী মালকে পুরস্কৃত করা হয়। এ গোবর এলাকাজুড়ে মালের সম্মান বৃদ্ধি করে। তাই গ্রামীণ জীবনে বৈশাখি উৎসবের আয়োজন নগর জীবন থেকে আলাদা।

পান্তা-ইলিশ কেবল নাগরিক আচার মাত্র। গ্রামাঞ্চলে এখনও ঘরে ঘরে দাওয়াত করে শাক-ভাত খাওয়ানোর রেওয়াজ প্রচলিত আছে। একে অন্যের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে বাড়ি বাড়ি বেড়ানোর প্রথা এখনও গ্রামীণজীবনে বিদ্যমান। ছোট ছেলে-মেয়েরা বাড়ি-বাড়ি গিয়ে তারে লহর গেঁথে ‘পুরি (পিঠা) মাগা’-এর প্রতিযোগিতা মূলক উচ্ছ্বাসের এখনও কমতি নেই। এখনও অভাবে-ধনে,জাতে ও বর্ণে আক্রান্ত মানুষগুলো স্বভাবে ও মননে এক হয়ে যায়। চৈত্রসংক্রান্তি এবং পহেলা বৈশাখ তাই বাঙালি জীবনে অসাম্প্রদায়িক উৎসব। যা আজ আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাঙালি চেতনার অহংকার।

বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে ২০১৭ সনের চৈত্রসংক্রান্তি ও বর্ষবরণ শুধু ফসলহারা হাওরবাসীর জন্য গোয়ালশূন্য, গোলাশূন্য বর্ণহীন আক্ষেপ অনুরাগের উৎসব ছিল। আজ (২০২০ সন) করোনা কালে তা সকল বাঙালি জীবনে বর্ণহীন ও উল্লাসহীন।

সজল কান্তি সরকার: লেখক।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত