মুহাম্মদ শামসুল ইসলাম সাদিক

১৬ এপ্রিল, ২০২০ ১৭:৪৭

অদৃশ্য দানব করোনা ভাইরাস

নিস্তব্ধ ঢাকা, নিস্তব্ধ দেশ, এমনকি নিস্তব্ধ গোটা পৃথিবী। অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশটাও বর্তমানে ক্রান্তিকালের মধ্য দিয়েই চলছে। দেশে হাট-বাজার, রাস্তাঘাট, যানবাহন, শিল্পকারখানা, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়সবই রয়েছে বন্ধ। মানবসভ্যতার জীবনযাত্রা চলছে এক ভিন্নধর্মী বাঁকে। অদৃশ্য এক দানব সবাইকেই বাধ্য করেছে গৃহবন্দি করতে। এইভাবে ঘরবন্দি থাকা মানুষের জন্য এক কঠিন চ্যালেঞ্জ। তবুও মানুষ আপাতত থাকতে হবে ঘরবন্দি। রাতের অন্ধকারে আঘাত হানা ঝড়ের তাণ্ডবের ছবি দিনের আলো না ফুটলে পুরো বুঝা যায় না। করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব তেমন এক অন্ধকারে আঘাত। মহামারির প্রভাবে আগামী দিনের পরিধি যতটা যা-ই হোক, তার রং যে ‘ধূসর’ হবে তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। দেশের এই ক্রান্তিকালে সমাজের উচ্চবিত্তরা নিজেদের মানিয়ে নিতে পারছেন ঠিকই কিন্তু করোনাভাইরাসে আক্রান্তের ভয় অন্যদিকে কর্মহীন হয়ে খাদ্যাভাবে পড়ার শঙ্কায় দিনমজুর ও নিম্ন আয়ের মানুষের নিদারুণ উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে পতিত হয়েছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসেবে দেশের প্রায় ২১ ভাগ মানুষ দারিদ্রসীমার নিচে বাস করে, যাদের পক্ষে তিন বেলা খাবার যোগাড় করা অসম্ভব। দেশে ক্রান্তিকালে কাজকর্ম বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এই মানুষগুলো সবচেয়ে বেশি অসহনীয় অবস্থার মধ্যে পড়েছে। তাদের পক্ষে খাদ্য সংরক্ষণ দূরে থাক, দিনের খাবার দিনে যোগাড় করতেই কষ্ট করতে হচ্ছে। কর্মহীন হয়ে পড়া এসব মানুষের পাশে দাঁড়ানোই এখন সবচেয়ে বেশি জরুরি। তা না হলে, স্বীয় স্ত্রী-সন্তানদের ক্ষুধার জ্বালায় খাদ্যের সন্ধানে অনেকে এ অবস্থার মধ্যেও বের হয়ে পড়তে পারে। অথচ এই সংকটকালীন সময়ে ঘরের বাইরে বের হওয়ার সুযোগ নেই কারোরই। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সহায়তায় আর্থিক সহযোগিতা দিচ্ছে। কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, ইতালিসহ উন্নত বিশ্বের দেশগুলো তাদের জনগণকে দেশের সরকার আর্থিক বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা দিচ্ছে।

আমাদের দেশে সরকারের পক্ষ থেকেও আর্থিক ও খাদ্য সহযোগিতার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। গৃহবন্দি মানুষের জন্য সীমিত সামর্থ্য নিয়ে বাংলাদেশের সরকার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে- এতে কোনোই সন্দেহ নাই। আর এই কার্যক্রম অতিদ্রুত ব্যাপক পরিসরে শুরু করা একান্ত দরকার। কর্মহীন হয়ে পড়া বিশাল সংখ্যক মানুষকে যদি সরকারি-বেসরকারি সংস্থার সহযোগিতার আওতায় দ্রুত আনা না হয় তবে দেশ এক ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের মধ্যে পড়বে। তখন করোনা মোকাবেলায় নেওয়া পদক্ষেপও অকার্যকর হয়ে পড়তে পারে। বিধ্বংসী এই ক্ষুদ্র ভাইরাসের বাস যেহেতু আমাদের মানবশরীরটাকেই কেন্দ্র করে, সেহেতু ভাইরাসটির বিনাশ হতে পারে কেবল আমাদের মধ্য দিয়েই। বাংলাদেশের মতো ঘনবসতিপূর্ণ জনসংখ্যাবহুল একটি দেশে প্রাণঘাতী এই ভাইরাসের ব্যাপক সংক্রমণ বয়ে আনতে পারে করুণ ট্র্যাজেডি। একবার যদি দুর্ভাগ্যবশত দেশের বিশাল জনগোষ্ঠীর ভেতরে ভাইরাসটির ব্যাপক সংক্রমণ ঘটে, তাহলে শিগগিরই গোটা জাতির অপ্রত্যাশিত ভাগ্য বিপর্যয় নিশ্চিত! এক বিপদ থেকে বাঁচতে গিয়ে আরেক মহাসংকটে পড়ার আগেই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। যত দেরি হবে কর্মহীন অসহায় মানুষের সংকটও তত তীব্র হয়ে উঠবে। তবে বিচ্ছিন্ন এসব উদ্যোগের পাশাপাশি সমন্বিত উদ্যোগ সবচাইতে বেশি জরুরি।

শতকোটি মানুষ অপেক্ষায়, মুক্তি আসবে কবে; ভাবছে, কতদিন? কতদিন মানুষকে এই তাড়া করবে মহামারি-মৃত্যু! এখনো মানুষের জানা নাই। ঘরবন্দি মানুষের অবাধ জীবনাচারই যে কেবল ব্যাহত হচ্ছে তা নয়, বিশ্বের মানুষের জন্য আরও তীব্র বিপদের রণডঙ্কা বাজছে। এই সকল দেশে ক্ষুধার রূপ নিয়ে মৃত্যু প্রবেশ করতে পারে প্রত্যেক ঘরে ঘরে। তাই আমাদের অসহায় কর্মহীন হয়ে বিপন্ন অবস্থায় যারা পড়েছেন তাদের সাহায্যার্থে এলাকাভিত্তিক ত্রাণ তহবিল গঠন করতে হবে। এক্ষেত্রে স্বচ্ছতা বজায় রেখে প্রকৃত অসহায় শ্রমজীবী, গরীব ও দুঃখী মানুষের পাশে সাধ্য অনুযায়ী সহযোগিতা করতে হবে। করোনার কারণে শ্রমজীবী মানুষ এখন দুর্বিষহ জীবনযাপন করছে। রাজনৈতিক কর্মীদের পাশাপাশি যারা বিত্তবান, যাদের সামর্থ্য আছে এমন বিভিন্ন পেশার মানুষ যদি শক্তি-সামর্থ্য অনুযায়ী প্রত্যেকের নিজের গ্রাম বা শহরের আশপাশের গরীব দুঃখী ও শ্রমজীবী মানুষের পাশে এভাবে দাঁড়াতে পারি, তাহলে এর চেয়ে বড় কাজ আর কিছু হতে পারে না।

আজ আমাদের সবার সব থেকে বড়ো চ্যালেঞ্জ হচ্ছে ভাইরাসটির বিধ্বংসীলীলা পর্যুদস্ত করে আবারও জনজীবনে স্বাভাবিকতা আনয়ন করা। করোনার সংক্রমণ রোধে যে সামাজিক বিচ্ছিন্নতার কথা বলা হচ্ছে, তা আসলে মানুষের যূথবদ্ধতারই ভিন্ন সংস্করণ। করোনাবিরোধী এই জনযুদ্ধের কৌশল সামাজিক দূরত্ব রচনা বটে, কিন্তু তা আসলে একে অপরের কাছে আসারই নামান্তর। প্রত্যেককে তার নিজের অবস্থানে থেকে দায়িত্ব পালনের সেই ডাক দিয়েছে করোনা। অন্যের প্রতি অবিশ্বাস আর বিচ্ছিন্নতার নীতিতে এই লড়াইয়ে জেতা যাবে না। প্রতিরক্ষা, নিরাপত্তার নামের রাষ্ট্রকেন্দ্রিক দর্শন যে কতটা অসাড়, বিলিয়ন-বিলিয়ন ডলারের অস্ত্রভাণ্ডারের মালিক দেশটিও যে কতটা অসহায়, করোনা তার হাতেকলমে শিক্ষা দেয়। এই শিক্ষার সারকথা, জিততে হলে লাগবে পারস্পরিক সহযোগিতা, ভ্রাতৃত্ব, সৌহার্দ্য।

মনীষীরা আপন মানুষের প্রতি ভালোবাসার কথা ও উত্তম কাজের ওপর সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন। কেননা, এর মধ্য দিয়ে জীবন উন্নত হয়। মহিমান্বিত হয়। সময় এখন ভালোবাসার-বিশ্বাসের-ভরসার বেষ্টনী দিয়ে পৃথিবী ঘিরে ফেলার; একে অপরের দিকে হাত বাড়িয়ে দেওয়ার সময় এখন মানুষে-মানুষে, দেশে-দেশে। আমাদের চারপাশে অসংখ্য দুঃখী মানুষ আছে। সেই সব সহায়-সম্বলহীন মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে। রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন- দুঃখী মানুষ ও ক্ষুধার্তের অন্নদানই হচ্ছে সর্বোত্তম কাজ। মানুষের প্রতি মহানুভবতা প্রকাশের মাধ্যমে এবং মানবসেবায় নিজেকে বিলিয়ে দিয়েই তিনি পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষে পরিণত হয়েছিলেন। সাধারণত মানুষের মধ্যে বিলীন হয়ে গিয়ে পরিণত হয়েছিলেন অসাধারণ মহামানবে। মানব জীবনকে সফল-সার্থক করে তুলতে হবে।

মানুষ আর মানুষের প্রতি ভালোবাসা, সহযোগিতা ও সহমর্মিতার মাধ্যমেই একজন মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ মেলে। মহান আল্লাহর চিরন্তন আহ্বানই হলো, মানুষ ও মানুষকে ভালোবাসার মাধ্যমেই জীবনকে সার্থক করো। সত্যিকার অর্থে খাঁটি মানুষ মানুষকে ভালোবাসার মধ্য দিয়েই সমাজের উত্তম কাজের পরিপূর্ণতা আসে। উত্তম কাজের প্রতিদানও কিন্তু সর্বোত্তম পুরস্কার। আসল ব্যাপার হচ্ছে মানুষের সদিচ্ছাবোধ ও আন্তরিকতা। কল্যাণের মধ্য দিয়েই শুদ্ধ জীবনের পথ তৈরি হয়। অতএব, মাটি ও মানুষের প্রতি মমত্ববোধ ও ভালোবাসার মাধ্যমে সঠিক এবং সর্বোত্তম প্রতিদানের সন্ধান করতে হবে।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত