মনির হোসাইন

১২ মে, ২০২০ ০৩:২৪

অবিশ্বাসীর সহযাত্রী

অনন্ত বিজয় দাশ

আমরা মোটামুটি পরিচিত যারা তাঁকে সবাই ‘অনন্তদা’ বলেই সম্বোধন করতাম। আমরা মানে আমি, লিটন দাস, সৈকত চৌধুরী আর আমাদের সংগঠনের প্রথম সভাপতি মাহমুদ আলী, দ্বিতীয় সভাপতি হাসান শাহরিয়ারসহ যারা অনন্ত বিজয় দাশের সিনিয়র ছিলেন, প্রায় সবাই-ই তাঁকে ‘দাদা’ বলেই সম্বোধন করতাম। ‘বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী কাউন্সিলে’র সিনিয়র-জুনিয়র প্রায় সবাই তাঁকে ‘দাদা’ বলতো। অনন্ত বিজয় দাশ আমাদের সবার কাছে এই ‘দাদা’ হয়ে ওঠা নিয়ে আজও মাঝে মাঝে ভাবি। এই লোকটা আস্তে আস্তে সবার কাছে কেমন করে জানি না ‘দাদা’ হয়ে উঠেছিলো। তা আজ ভাবলে একটু অবাকই লাগে।
বয়সের তুলনায় তো এই বয়সে তার ‘দাদা’ হয়ে উঠার কথা না। অনন্ত বিজয় তখন হয়তো বছর বাইশের যুবক হবেন। তারপরও কেমন করে জানি তিনি সবার ‘দাদা’ হয়ে উঠেছিলেন। অনন্ত বিজয়ের সাথে আমার আজ থেকে প্রায় দেড় যুগ আগে পরিচয় হয়। লিটন দাস, সৈকত চৌধুরীর সাথে পরিচয়ও প্রায় একই সময়ে। হয়তো মাস দু’য়েক আগে বা পরে এরকম হতে পারে। তবে একই বছরে আমাদের পরিচয় হয়। আমরা সবাই তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি। কেউবা পড়ি ফার্স্ট ইয়ারে, কেউবা সেকেন্ড ইয়ারে। বয়সেও সবাই প্রায় একই রকমই।

বিজ্ঞাপন

সময়টা খুব সম্ভব ২০০৪ সালের শেষ দিকের ঘটনা। আমি তখন সিলেট শহরের আম্বরখানা এলাকাতে একটা গণ-মেসে থাকতাম। বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে স্নাতক কোর্সে ভর্তি হয়েছি। ২০০৪ সালে বোধকরি নভেম্বর-ডিসেম্বরেই হবে, এই সময়েই কীভাবে জানি খবর পাই সিলেটে কয়েকজন তরুণ সংঘবদ্ধ আছে। প্রতি শুক্রবার কিংবা শনিবার তারা একটি নির্দিষ্ট জায়গায় বসে। অনেকটা ঘরোয়া আড্ডার মতো। সেখানে উন্মুক্ত আলোচনা চলে। অনেকটা পাঠচক্রের মতো। সবচেয়ে বড় কথা যুক্তিবাদ-ধর্ম–বিজ্ঞান নিয়ে আলোচনায় সমমনা যে কাউকে তাঁরা সাদরে আমন্ত্রণ জানায়। আমার কৌতূহল বেশ বেড়ে গেলো। খোঁজ করতে লাগলাম। সমমনা দু’য়েকজন ক্লাসমেট-বন্ধুদেরও বলি সেই কথা। তারাও দেখি বেশ আগ্রহ প্রকাশ করে। এভাবেই একদিন খোঁজ পেয়ে গেলাম সেই আড্ডাবাজ বুদ্ধিদীপ্ত লোকেদের ঠিকানা।

উপশহর, সিলেট। কোন ব্লক তা আজ আর মনে নেই। খুব সম্ভবত আমাদের মধ্য থেকে কেউ একজন ফোন করেছিলো। আর ফোনেই আমাদের বলা হয়েছিল কীভাবে যেতে হবে। তো আমরা মানে আমি আমরা গিয়েছিলাম। তিনজন ছিলাম। তিনজনেই বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে পড়ি। ওই দিন আসলে আমি ঠিক অনন্ত বিজয়কে তেমন ভালোভাবে এতোটা খেয়াল করিনি। কারণও ছিলো। কারণ যিনি তখন এই আড্ডার আয়োজন করতেন তিনি অসম্ভব ভালো বক্তা ছিলেন। যেকোনো বক্তব্য সহজভাবে উপস্থাপন করতে অত্যন্ত পটু ছিলেন। যাকে এক কথায় বলে বাকপটু। খুব জোরালো ও রসসিক্ত করে তিনি যেকোনো বিষয়ই উপস্থাপন করতে পারতেন। তাঁর কথা ঘণ্টার পর ঘণ্টা আমরা মনোযোগ দিয়ে শুনতাম। তাই সঙ্গত কারণেই অনন্ত বিজয় দাশকে আমার মতো নতুন অনেকেই তখন চিনেছে দেরিতে।

আমরা তাঁকে ধীরে ধীরে চিনতে শুরু করি। শুরুটা মূলত এভাবেই হয়। এই আলাপ-পরিচয়ের ফাঁকে ফাঁকে ধীরে ধীরে বাকি সদস্যদের সাথে আমার পরিচয় হয়। তখনও আমি আমার ক্লাসমেট দু'জনকে নিয়ে ওই উপশহরের আড্ডায় যাই। অনন্ত বিজয় তখন রেগুলারই আসতেন। লিটন দাস, সৈকত চৌধুরী এদের কারো সাথেই আমার তখনও সম্ভবত পরিচয় হয়ে উঠেনি। চিনি একমাত্র অনন্ত বিজয়কে। তো এই আড্ডার সূত্র ধরে আমরা সবাই সবার মোবাইল নাম্বার, এড্রেস এসব বিনিময় করি। সম্ভবত তখন একটা ফর্ম জাতীয় কিছু একটা ছিলো। যা আমরা পূরণ করি। আর প্রত্যেকেই প্রত্যেকের মোবাইল নাম্বার সেভ করে রাখি। তখন জম্পেশ এই আড্ডার ফাঁকে ফাঁকে চলতো পিঁয়াজু-মুড়ি মাখা আর লাল চা। আড্ডা সেই সকালে শুরু হতো তা কখন যে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হয়ে যেতো খুব বেশি টের পেতাম না। উঠতে উঠতে সেই সন্ধ্যে হয়ে হতো। সাধারণত আড্ডাগুলো শুক্রবারেই হতো। না হয় বিশেষ কোনো ছুটির দিনে।


এই আড্ডা ধীরে ধীরে বেশ জমজমাট হয়ে ওঠে। তখন মাহমুদ আলী, হাসান শাহরিয়ার, লিটন দাস ও সৈকত চৌধুরীসহ অনেকেই আমরা একে অন্যকে সবে চিনতে শুরু করেছি। প্রতি শুক্রবারেই আমরা যে জায়গাই থাকি না কেন কীভাবে জানি আমরা ঠিকঠাক উপস্থিত হয়ে যেতাম। মাঝেমধ্যে অবশ্য ব্যতিক্রম হতো। তা করতো বেশি সৈকতে। সে মাঝেমধ্যে আসতে পারতো না। তো এই ফাঁকে সৈকতের সাথে আমার দেখা হওয়ার ব্যাপারটা বলে নিই। কারণ তার সাথে আগে আমার ব্যক্তিগত যোগাযোগ হয়। সম্ভবত তখন রমজান মাস। রাত দশ কি এগারোটা হবে। একটা অপরিচিত নাম্বার থেকে কল আসে। আমি রিসিভ করতেই ওপ্রান্তে কেউ একজন সরাসরি বলে, আপনি কি মনির? বেশ অবাক হয়ে বললাম, হ্যাঁ। কেনো বলুন তো? আর আপনিইবা কে? এভাবে বেশ কিছুক্ষণ আলাপের পর সে বলে সে মোবাইল নাম্বারটি কোথা থেকে সংগ্রহ করেছে। তারপর সেদিন আমরা মোবাইলে প্রায় মিনিট দশেক আলাপ করি। ফোন রাখার আগে আগে সৈকত ধুম করে বলে, আমি যদি এখন আম্বরখানায় আসি তাহলে কি আমরা দেখা করতে পারি? বেশ অবাক হলেও আমি বললাম, হ্যাঁ। নিশ্চয়ই! ফোন রাখার মিনিট বিশেক পরেই সম্ভবত সৈকত একেবারে আমার মেসে এসে হাজির হয়েছিলো। সে রাতে আমরা প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিটের মতো আলাপ করেছিলাম। বেশিরভাগ প্রশ্নই ছিলো ধর্ম বিষয়ে। আমরা একে অন্যে ধর্ম নিয়ে কী ভাবি, কীভাবে এই পরিবর্তনটা নিজের মধ্যে আসলো এসবই ঘুরেফিরে একে অন্যকে আমরা জিজ্ঞেস করি। তারপর কী কী অবস্থার মধ্য দিয়ে আমাদের যেতে হচ্ছে, এখন কী অবস্থা এসব একে অন্যের সাথে শেয়ার করি। এক অর্থে অনন্ত বিজয় ও লিটন দাসের আগে আমার সাথে সৈকতের চেনাজানাটা ভালোভাবে হয়ে ওঠে। এভাবেই আমরা আপনি থেকে তুমি তারপর তুই'য়ের দিকে যাই। আর এই তুই-তুকারি শুধু আমাদের তিনজনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো। অনন্ত বিজয় আমাদেরকে তুমি বলতেন।

বিজ্ঞাপন


তখন আমরা উপশহরের আড্ডাটি ছেড়ে এসেছি। আমরা তখন স্থানাভাবে সিলেট শহিদ মিনারে শুক্রবারে নিয়ম করে আড্ডা দিই। এছাড়া আমাদের আর কোথাও বসার মতো স্থান তখন ছিলো না। তাই বাধ্য হয়েই শহিদ মিনারকেই আমাদের বেছে নিতে হয়। শহিদ মিনারের 'কবি পরিষদে'র কবিতা পাঠ কিংবা নানান সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান তখন শহিদ মিনারে প্রায় শুক্রবারে লেগেই থাকতো। এসব অনুষ্ঠানাদি যখন হতো তখন আমাদের আর এক সাথে বসে আলাপ-আলোচনা করার সুযোগই থাকতো না। চারদিক লোকে গিজগিজ করতো। অনুষ্ঠান হলে মাইকের উচ্চস্বরের আওয়াজের কারণে কোনোকিছুই বলা সম্ভব হতো না। আমরা তাই তখন বাধ্য হয়েই শহিদ মিনারের পাশের শহিদ শামসুদ্দীন আহমদ কবরস্থানের মূল বেদির নিচে গিয়ে বসতাম। জুতা খুলেই যেতাম। এসব আমরা যথানিয়মেই করতাম। সিলেট সিটি করপোরেশনে দরখাস্ত করে লিখিত অনুমতি নিয়ে তখন বসার অনুমতিও পেয়েছিলাম। কিন্তু বৃষ্টি হলে অগত্যা দৌড়াতে হতো। জিন্দাবাজারের 'ইটালি রেস্টুরেন্ট'ই ছিলো আমাদের তখনকার আড্ডা। পিঁয়াজু-বেগুনি, ডালপুরি, ছোলাভুনা হয়ে চা-শিঙাড়া এসবের উপর দিয়ে ঝড় বইতো। এই চায়ের সাথে শিঙাড়া খাওয়া এটা অনন্ত বিজয়ের কাছে এক মজার খাবার ছিলো। চা আসবে আর শিঙাড়া থাকবে না তা তো হয় না। সে ঠাণ্ডা হোক কিংবা বাসি শিঙাড়া তার চাই-ই চাই! এভাবেই মূলত আমরা আমাদের পাঠচক্রের আলাপ-আলোচনা চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলাম।

তখন ধীরে ধীরে কিছু নতুন সদস্যও যুক্ত হচ্ছিলো। এর পাশাপাশি আমরা ষোল ডিসেম্বর, একুশে ফেব্রুয়ারি, ছাব্বিশে মার্চ উপলক্ষে আমাদের সব সদস্যদের নিয়ে শহরে র‍্যালি করতাম। পুষ্পস্তবক অর্পণ করতাম। পাশাপাশি শহরের গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে মোড়ে বেশ বড় সাইজের কাপড়ের ব্যানারও টানিয়ে দিয়েছিলাম। আমাদের তখনও কোনো অফিস ছিলো না। ব্যানারে 'বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী কাউন্সিল'র একটা ইমেইল আইডি দেওয়া ছিলো। নিচে যোগাযোগের নাম্বার। একটা অনন্ত বিজয়ের। আরেকটা আমার। বেশ ভালোই সাড়া পেয়েছিলাম। এটা আমাদের সবার কাছেই বেশ আনন্দের ছিলো। তখন ফোন করে কেউ কেউ বলতেন কীভাবে তিনি ধর্মমুক্ত হলেন। এখন কী অবস্থায় আছেন এসব। মাঝেমধ্যে হুমকিও যে আসতো না, তা না। আসতো। অন্তত সেসময় যেসব হুমকি আসতো তখন বেশ ভালোভাবেই আমরা সামাল দিয়েছি। দুই হাজার দশ সাল পরবর্তী অবস্থা গোটা দেশের ধর্মীয় উত্তেজনা, জঙ্গিবাদ ছিলো ভয়ানক। যদিও শেষতক অনন্ত বিজয়দেরকে হত্যার মধ্য দিয়েই ইসলামি জঙ্গিরা সফল হয়!


তখন সম্ভবত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসেনি। সাল সম্ভবত ২০০৬ সাল হবে। অনন্ত বিজয় দাশ আমাদেরকে বললেন, চলো ঢাকা থেকে দিন দু'য়েক বেড়িয়ে আসি। এই বেড়ানোটা আসলে ঠিক বেড়ানোও না। কিছু দরকারি কাজও আছে। এক দু'জনের সাথে সরাসরি দেখা সাক্ষাতের ব্যবস্থা করা আছে। সুতরাং এ ঠিক বেড়ানো না। আমরা মোটামুটি তখন প্রায় সবাই-ই যেতে রাজি। এই ফাঁকে সবাই দলগতভাবে ঢাকায় বেড়াতে পারলাম, পাশাপাশি কয়েকজন বিশিষ্ট লোকেদের সাথে দেখা সাক্ষাৎও করলাম এ তো বেশ আনন্দের খবর। তখন সবাই বললাম যাওয়ার সময় ও টিকেট এসবের একটা প্ল্যান করি। সে প্ল্যান মোতাবেক টিকিট কাটা হয়। তিন জন। সৈকত চৌধুরী শেষতক কোনো কারণে জানি যেতে পারেনি। লিটন দাস, অনন্ত বিজয় আর আমি। আমরা বাসে করেই রওয়ানা দেই। সকালের বাস ধরে প্রায় বিকেলে নাগাদই ঢাকায় পৌঁছাই। ওঠি ফকিরাপুলের কোনো এক হোটেলে। হোটেলে গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে আমরা কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে বিকেলের খাবার খেয়ে একজনের সাথে দেখা করতে যাই। তখনকার কোনো এক বামদলের কর্মী ছিলো ওই লোক। এখন খাঁটি আওয়ামী লীগার! তার বিশাল ফ্ল্যাট। মধ্যবিত্তের ড্রয়িংরুমে যা যা থাকে তার সবই আছে। ঝাঁ তকতকে মেঝে। তেমনি হালকা ক্রিম কালারের রঙ করা ওয়াল। বিশাল টিভি। কী নেই সেই বাসায়? কিন্তু এতোসব কেনো বলছি? কারণ তার দলের নেতার আসলে কোনো বাড়িগাড়ি সে অর্থে নেই। যা আছে সবই দলের নামে। অথচ এই লোকের সবই আছে। নেতাও আছে। দলও আছে। তেমনি শ্রমিক-কৃষকও আছে। যা নাই তা হলো, বিপ্লব! বিপ্লব যেনো এই ফ্ল্যাট বাড়িতেই বন্দি হয়ে গুমরে গুমরে কান্নাকাটি করে মরছে! যাই হোক এই এক কিম্ভূতকিমাকার অবস্থা থেকে বেরিয়ে আমরা পরদিন যাই অধ্যাপক অজয় রায়ের বাসায়।

তখন অজয় স্যার অনেকটাই নজরবন্দি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার তাঁকে সহ দেশের তখনকার তাঁর সমমানের প্রায় সবাইকেই এভাবেই নজরবন্দি করে রেখেছিলো। আমরা আগেই এসব জেনেবুঝেই যথাসময়ে তাঁর বাসায় পৌঁছে যাই। তখন অজয় স্যার শারীরিকভাবে বেশ শক্তপোক্তই ছিলেন। একে একে আমাদের সবার পরিচয় জানলেন। পাশাপাশি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে নানান প্রশ্ন করলেন। তখন বিজ্ঞান-যুক্তিবাদ নির্ভর 'মুক্তান্বেষা' ছোটোকাগজ নিয়ে পরিকল্পনা চলছে। মাসিক হবে, না ত্রৈমাসিক হবে তা তখনও সিদ্ধান্ত হয়নি। পত্রিকার বিষয়ে অনেক আলাপ করলেন। ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা জানালেন। পাশাপাশি 'মুক্তমনা'র লেখালেখি নিয়েও নানান কথা বললেন। তখনকার দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা নিয়ে তাঁর চিন্তা-ভাবনা, লেখালেখি সমস্তই একে একে এই ব্যস্ততার মধ্যেও বলে গেলেন। সেদিন অধ্যাপক রায় শারীরিকভাবে খুব সুস্থ ছিলেন এমন না। কিন্তু আমাদেরকে পেয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে শারীরিক অসুস্থতা থাকা সত্বেও আলাপ চালিয়ে গিয়েছিলেন। আমরা তিনজনই তখন তাঁর কথা কতোটকু ভালো বুঝতে পেরেছিলাম জানি না। তবে অধ্যাপক অজয় রায়কে খুব কাছ থেকে তাঁকে সেদিন দেখতে পেয়েছিলাম, আলাপ করতে পেরেছিলাম এটাই ছিলো বড়ো পাওয়া।

আজ আর আমাদের মাঝে অধ্যাপক অজয় রায় নেই। বিজ্ঞান লেখক-ব্লগার অভিজিৎ রায় ও অনন্ত বিজয় দাশও আর বেঁচে নেই! অধ্যাপক অজয় রায় পুত্র শোক বুকে চেপে স্বাভাবিক মৃত্যু হলেও অভিজিৎ রায়-অনন্ত বিজয় দাশদের টগবগে তারুণ্যকালীন দেশি ইসলামি মৌলবাদী জঙ্গিরা প্রকাশ্যে কুপিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে। আজন্ম সংগ্রামী এক শিক্ষক-বিজ্ঞানী বাবার কোলে তার সন্তানের লাশ ধরিয়ে দেয় তাঁরই সংগ্রামের ফসল এই জাতি-রাষ্ট্রটি!

বিজ্ঞাপন


তারপরের দিন খুব সম্ভবত আমরা কবি-লেখক ওয়াহিদ রেজার বাসায় যাই। নারায়ণগঞ্জ শহরে। আগে থেকেই তিনি আমাদের নিমন্ত্রণ করেছিলেন। বলেছিলেন সকালের দিকে যেতে। যাতে আমরা নারায়ণগঞ্জ শহরটা এদিক-ওদিক ঘুরে ফিরে দেখতে পারি। কিন্তু আমরা আর আসলে ঠিক সকাল সকাল যেতে পারিনি। যেতে যেতে তখন প্রায় দুপুরই বলা চলে। শহরে পৌঁছেই ফোন দিই তাঁকে। বললেন সরাসরি তাঁর চেম্বারে যেতে। গিয়ে দেখি ওয়াহিদ রেজা নামে কোনো দাঁতের ডাক্তারও সেখানে নেই। তেমনি এই নামে কোনো চেম্বারও সেখানে নেই। অগত্যা পরে তাঁকে আবার ফোন দিই। ফোনের ওপ্রান্তে হো-হো-হো করে হেসে তিনি বলেন, বুঝেছি! তা উপরে ওঠে আসো। আমি তোমাদের তিনজনকেই দেখতে পাচ্ছি। ফোন রাখতে না রাখতেই ওয়াহিদ ভাই চেম্বার থেকে বেরিয়ে এসে আমাদেরকে তাঁর চেম্বারে নিয়ে যান।

ওয়াহিদ ভাইয়ের প্রকৃত নাম সম্ভবত আনিসুর রাব্বী। তাঁর ডেন্টাল চেম্বারেরও ওইরকম নাম ছিলো। রাব্বী ডেন্টাল হল মনে হয়। তো চেম্বার থেকে আমরা তাঁর বাসার দিকে রওয়ানা দিই। বাসায় গিয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিই। ওয়াহিদ ভাই সমানে তখন নানান বিষয়ে আলাপ করে যাচ্ছেন। সরদার ফজলুল করিম, অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, আহমদ ছফা, অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ, তসলিমা নাসরিন, প্রবীর ঘোষ এঁদের প্রসঙ্গে নানানরকম স্মৃতিচারণামূলক বলে যাচ্ছেন। এর পাশাপাশি সিলেটে বেড়াতে গিয়ে তিনি কীভাবে রোড এক্সিডেন্ট করে তাঁর স্ত্রীকে হারান তাও বিস্তারিত বলেন। এলবাম খোলে পারিবারিক ছবি দেখান। স্ত্রী মারা যাওয়ার পর আর বিয়ে করেননি। এক মেয়ে, এক ছেলে নিয়ে এভাবেই আজও আছেন। আমরা এসব নানান আলাপ সবাই খুব মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনে যাচ্ছি। খেয়াল করলাম ওয়াহিদ ভাই কথা যখন বলেন তখন কারো দিকে সরাসরি চোখ তোলে তাকিয়ে কথা বলেন না। কেমন নিজের মতো ঘোরলাগা হয়ে বলে যান। বেশ উঁচু স্বরে কথা বলেন। কথা বলতে বলতে নিজের স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে হাহাহা করে হাসেন। হাসতে হাসতে চোখ দিয়ে জল গড়ায়! আর একটার পর একটা সিগারেট টানতেই থাকেন। কালো পাইপযুক্ত করে সিগারেট টানেন। এক সময় নিয়ম মেনে আমাদের পেটেও ক্ষিধে জানান দেয়। তিনি টেবিলে খাবার সাজিয়ে ডাকেন। খাবার টেবিলে গিয়ে দেখি শীতলক্ষ্যা নদীর পাঙাশ মাছ রান্না করিয়েছেন। প্রথমেই বললেন, তোমাদের জন্য শীতলক্ষ্যা নদীর তরতাজা পাঙাশ মাছ এনে রান্না করিয়েছি। কিন্তু আমরা আসলে পাঙ্গাশের নাম শোনে কেমন যেনো এই ডিশকে এভয়েড করা শুরু করলাম। কারণ পাঙাশ তো ততদিনে ইয়া বিশাল সাইজের হয়ে ফার্মেই উৎপাদন হওয়া শুরু করেছে! আর আমাদের মধ্যে বিশেষ করে অনন্ত বিজয়ের অস্বস্তি ছিলো একটু বেশিই। তাঁর মাছ খাওয়াখাওয়ি নিয়ে বেশ বাধাধরা কিছু নিয়ম আছে। সব মাছ খেতেন না। পাঙাশ তো নয়ই। ফার্মের মুরগি হলেই অনন্ত বিজয় বেজায় খুশি। আর খুব প্রিয় ছিলো বিরিয়ানি। তো যাইহোক সব মিলিয়ে সে এক এলাহি খানাপিনার আয়োজন করিয়ে রেখেছেন ওয়াহিদ ভাই। নিজেও এটাওটা এগিয়ে দিচ্ছেন। আমাদের সাথে খাচ্ছেন আবার সমানে গল্পও চালাচ্ছেন। খাওয়াদাওয়া শেষে আমরা ঘণ্টা দেড়েক মতো আড্ডা দেই। আড্ডা তো ফুরাবে না জানি। কিন্তু নিয়ম মেনে তো আমাদের উঠতেই হয়।