বিনোদন ডেস্ক

১৪ জুলাই, ২০১৫ ১৩:১২

যৌন সহিংসতা উসকে দিচ্ছে বলিউড!

সাম্প্রতিক এক পরিসংখ্যান বলছে ভারতে প্রতি ২২ মিনিটে একজন নারী ধর্ষিত হয়। বলিউডের রুপালি পর্দায় নারীরা যেভাবে উপস্থাপিত হন তার সঙ্গে কি এসব যৌন সহিংসতার কোনো যোগসূত্র আছে?

ভারতের চলচ্চিত্র শিল্পের গুরুত্বপূর্ণ নানা চরিত্রের সঙ্গে কথা বলে এ নিয়ে লিখেছেন বিবিসির চলচ্চিত্র সমালোচক টম ব্রুকস। এখানে তার সংক্ষিপ্তসার তুলে ধরা হলো।

নয়া দিল্লিতে বাসে গণধর্ষণের শিকার হয়ে মারা যান ২৩ বছর বয়সী মেডিকেল কলেজের এক ছাত্রী। ২০১২ সালের ডিসেম্বরে এ ঘটনা দুনিয়াজোড়া গণমাধ্যমের সংবাদ শিরোনাম হয়, ভারতজুড়ে বয়ে যায় প্রতিবাদের ঝড়। সেসময় বলিউডের সবচেয়ে বড় তারকাদের একজন শাহরুখ খান টুইট করেন, ‘আমি খুবই দুঃখিত যে আমি এই সমাজ ও সংস্কৃতির অংশ। আমি দুঃখিত যে আমি একজন পুরুষ।’

এরপর থেকে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে একের পর এক যৌন সহিংসতার খবর গণমাধ্যমের শিরোনামে আসতে থাকে। কয়েক মাস পরই পশ্চিমবঙ্গে আরেকটি পৈশাচিক গণধর্ষণের ঘটনা ঘটে। অভিযোগ আছে, গ্রাম্য সালিসের ফল হিসেবে ওই গণধর্ষণের শিকার হন ২০ বছর বয়সী ওই নারী। ভারতের জাতীয় অপরাধ তথ্য ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী ভারতে সে সময় প্রতি ২২ মিনিটে একজন নারী ধর্ষিত হন।

যৌন আবেদনের উপস্থাপন
একের পর এক এমন সব বর্বর ধর্ষণের ঘটনার সামাজিক কারণ খুঁজতে গিয়ে এই প্রশ্নটাও সামনে চলে এসেছে যে, ভারতে নারীর প্রতি এই যৌন সহিংসতা উসকে দেওয়ার পেছনে কি বলিউড আংশিকভাবে দায়ী? বিশেষত চলচ্চিত্রের পর্দায় নারীকে যেভাবে উপস্থাপন করা হয় এবং যেসব চিত্রকল্প আর আখ্যান তুলে ধরা হয় সেসব কি যৌন সহিংসতা উসকে দিচ্ছে?

ভারতীয় সিনেমায় নারীকে উপস্থাপনের বিষয়ে উন্নতির অনেক সাহসী নমুনা দেখা গেলেও দেশটির অন্যতম শীর্ষ পরিচালক মীরা নায়ার তাতে খুশি নন। তিনি মনে করেন অনেক ক্ষেত্রেই বলিউডে নারীর উপস্থাপন অবমাননাকর। তিনি বলেন, ‘আমাদের অনেক সিনেমাতেই এখনো সেই একঘেয়ে পুরোনো গল্প বলা হচ্ছে।’ আরও স্পষ্ট করে তিনি বলেন, ‘যখনই কোনো আবেদনময়ী নারী চরিত্র আসে, তাকে কেবলই শরীর মুচড়ে মুচড়ে নাচতে থাকতে হয়, তাকে অবশ্যই প্রবল যৌনতা ছড়াতে হয়, নিজেকে তীব্র আকর্ষণের বস্তুতে পরিণত করতে হয়, আমি বলব এমনভাবে এসব করতে হয় যে, তা রীতিমতো অশ্লীল।’

বিশেষ উদ্বেগের বিষয় তথাকথিত ‘আইটেম নাম্বার্স’ বা ‘আইটেম গান’। এসব তুমুল জনপ্রিয়, খুবই সচেতনভাবে কোরিওগ্রাফি করা এবং প্রায়শই যৌনতার আকর্ষণে ঠাসা ‘নাচে-গানে-ভরপুর’ ধরনের। হলে গিয়ে যারা সিনেমা দেখেন তাদের কাছে খুবই উপভোগ্য বিনোদন বলিউড সিনেমার নিয়মিত অনুষঙ্গ এই আইটেম গান। কিন্তু মীরা নায়ার একে ভিন্নভাবে দেখেন— ‘সিনেমা হলের গণ-পরিবেশে অনেকটাই পুরুষ রাজত্বের মধ্যে, যখন কেউ এসব উত্তেজক আইটেম গান দেখেন, তখন এসব গানে হাজির হওয়া বলিউডের নতুন রানিকে নিজেকে দুমড়ে-মুচড়ে প্রবলভাবে তাদের প্রলুব্ধ করতে হয়।’ তিনি বলেন, ‘আমি সত্যিই একে প্রশ্ন করছি। আমি মনে করি না, এটা নারী ও পুরুষের মধ্যে সম্পর্ককে কোনো সম্মানজনক জায়গায় নিয়ে যায়।’

ভারতীয় অভিনেত্রী তিলোত্তমা সোম আরও একটু ভিন্নভাবে চিন্তা করেন। তিনি বলছেন, আলোচনাটা কেবল সিনেমায় নারীর উপস্থাপনে সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না, পুরুষকে কীভাবে হাজির করা হচ্ছে তাও ভাবতে হবে। তিলোত্তমা বলেন, ‘এখানে পুরুষেরা হয় খুবই উগ্র নয়তো খুবই রক্ষণশীল। এমন সব ছকবাঁধা উপস্থাপন নারীর জন্য যেমন ক্ষতিকর তেমনি পুরুষের জন্যও ক্ষতিকর। এমন উপস্থাপনের প্রভাব সমাজেও এমন বাঁধা ছক টিকিয়ে রাখতেই উৎসাহিত করে।’

‘না’ মানে আসলেই ‘না’
আরেকটি উদ্বেগের বিষয় হলো; প্রথাগত কাহিনিতে প্রেম বা যৌনতার প্রস্তাবে ভারতীয় নারীর সাড়া দেওয়া না দেওয়ার চিত্রায়ণ। বহুদিন ধরে চলতে থাকা এই ছকবাঁধা উপস্থাপনটা এমন যে—কোনো নারী যখন কারও প্রস্তাবে ‘না’ বলেন আসলে তিনি অসম্মতি জানান না, ভারতীয় নারীর ধরনটাই যেন এমন যে, মুখে ‘না’ বললেও মনে মনে তিনি যেন বিষয়টা ঠিকই মেনে নিচ্ছেন।

কিছুদিন আগেই ভারতের ধ্রুপদি অ্যাকশন-অ্যাডভেঞ্চার ‘শোলে’র থ্রিডি সংস্করণ দেখা গেল। এখানে একটা সিকোয়েন্স আছে যেখানে দেখা যায় একজন নারী তার দিকে প্রবলভাবে এগিয়ে আসতে থাকা এক পুরুষকে শক্তভাবেই না বলছেন। ঘটনার একপর্যায়ে ওই নারীকে হাল ছেড়ে দিতে দেখা যায় এবং দর্শক এমন একটা ধারণা পান যে, আসলে ওই নারীর ‘না’ বলাটা আসলে না ছিল না, ওটা আসলে ‘হ্যাঁ’-ই ছিল! নারী-পুরুষের মধ্যে যৌনতার সম্পর্কের এই বোঝা ভারতীয় সিনেমায় সাধারণ ঘটনা। বলিউডের সিনেমায় কোনো পুরুষের পক্ষে কোনো নারীর পেছনে লেগে থাকার ঘটনা অগ্রহণযোগ্য কিছু না।

বলিউডের সবচেয়ে বড় তারকাদের একজন আমির খানকে অনেক ক্ষেত্রেই অনেক সহকর্মীর চেয়ে সামাজিকভাবে বেশি অগ্রসর বলে মনে করা হয়। কাউকে অনুসরণ করা বা তার পেছনে লাগাটাকে সিনেমায় সাধারণ ঘটনা হিসেবে হাজির করার প্রবণতা নিয়ে আমির খান চিন্তিত। ‘এমন অনেক সিনেমা আছে যেখানে এমন কিছু বিষয়কে ফ্যাশনেবল বা দারুণ বিষয় হিসেবে উপস্থাপন করা হয়।’ এই অভিনেতা-পরিচালক আরও বলেন, ‘এটা খুবই দুঃখজনক। এটা আমাদের চিন্তা পদ্ধতির পরিচায়ক। সৃষ্টিশীলতার জগতেও এমন মানুষ আছেন যারা এসবকে বলার মতো ভালো গল্প বলে মনে করেন। তাই এটা আমাদেরই প্রতিচ্ছবি এবং এটা দুঃখজনক।’

সিনেমা-টিভি-বাস্তবতা
এই কথা নিয়েও অনেক তর্ক-বিতর্ক হচ্ছে যে— বলিউডের সিনেমা আর ভারতের কিছু টেলিভিশনের রিয়েলিটি শো দর্শকদের সামনে এমন এক ভোগ-বিলাসী জগতের ছবি তুলে ধরছে যেখানে বিলাসী জীবন কাটানো কোনো সমস্যাই না আর এভাবে দর্শকদের মধ্যেও ওই রকম জীবন কাটানোর প্রবল আকাঙ্ক্ষা তৈরি করা হচ্ছে। কেউ কেউ এমন ভাবেন যে, সিনেমা-টিভির এই বাস্তবতা আর দিনকে দিন স্বনির্ভরতার পথে পা বাড়িয়ে আরও বেশি সংখ্যায় নারীদের নগরগুলোতে পাড়ি দিতে থাকা মিলিয়ে এমন অবস্থা তৈরি হয়েছে যে, অনেক পুরুষেরাই এতে ক্ষেপে যাচ্ছেন আর যৌন সহিংসতায় লিপ্ত হচ্ছেন।

ভারতীয় চলচ্চিত্র নির্মাতা মীরা নায়ার বলেন, ‘একজন যুবক যখন কোনো আধুনিক নারীকে সিনেমা দেখে বেরিয়ে আসতে এবং বাসে উঠতে দেখে, তখন ওই যুবকের চোখে যে দৃষ্টি দেখা যায় তাতে রাগ আর ঈর্ষা একই সঙ্গে মিলেমিশে থাকে। বিষয়টা যেন এমন যে, আমি এটা পারছি না কিন্তু একটা নারী এতদূর চলে যাচ্ছে।’

এমন কিছু সিনেমাও আছে যেখানে নারীর প্রতি সহিংসতার বাস্তবতাকে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে, কিন্তু সেগুলোর সংখ্যা কম। ২০১১ সালের থ্রিলার ছবি ‘নো ওয়ান কিলড জেসিকা’ তার মধ্যে অন্যতম। ১৯৯৯ সালে নয়া দিল্লির মডেল এবং একটা বারের হোস্টেস জেসিকার খুন হওয়ার বাস্তব ঘটনা নিয়ে এই সিনেমা তৈরি করা হয়েছে।

ভারতীয় অভিনেত্রী তিলোত্তমা সোম মনে করেন, স্বতন্ত্র ধারার চলচ্চিত্র হয়তো নিশ্চিতভাবেই যৌন সহিংসতার ঘটনাকে তুলে ধরার চেষ্টা করতে পারে। কিন্তু তাঁর কাছে কাহিনির মতোই গুরুত্বপূর্ণ উপস্থাপনের ধরনটাও। তিনি বলেন, ‘কেউ যদি একটা সিনেমায় একজন ধর্ষক পুরুষের জীবনে ধর্ষণের আগের দিনটা তিনি কীভাবে কাটিয়েছিলেন সেটা তুলে ধরতে চান সেটা হয়তো দারুণ। কিন্তু পর্দায় ধর্ষণের ঘটনাটা দেখানোর কিছু নেই, সেটা আমরা হাজারবার দেখেছি। তার চেয়ে এ বিষয়ে বোঝাপড়া বাড়াতে পারাটা গুরুত্বপূর্ণ।’

ভারতে যখন এই যৌন সহিংসতা নিয়ে তুমুল ঝড় উঠছে তখন এ কথা মনে করা যেতে পারে যে, আইনি অভিযোগের নথিপত্রের হিসাবমতে যুক্তরাষ্ট্রে ধর্ষণের ঘটনা ভারতের চেয়েও বেশি। হলিউডের সিনেমায় নারী চরিত্র নিয়েও অনেক কথা হতে পারে। কিন্তু যে কেউই হয়তো স্বীকার করবেন, হলিউডের নারী চরিত্ররা বলিউডের নারী চরিত্রের তুলনায় অনেক বেশি বাস্তবের কাছাকাছি। অবশ্যই, পর্দায় কীভাবে উপস্থাপিত হলো তার পাশাপাশি সমাজের আরও অনেক কিছুই নারীর প্রতি যৌন সহিংসতার সঙ্গে সম্পর্কিত, তা ভারতেই হোক কিংবা যুক্তরাষ্ট্রে।

তারকারা মেনে নিচ্ছেন যে, বলিউডের নিশ্চয়ই দায় আছে, কিন্তু কেবল বিনোদন জগৎকেই এর সব দায়-দায়িত্ব চাপিয়ে দিলে হবে না। আমির খান যেমন বলেন, ‘আমাদের যথাযথ আইন-শৃঙ্খলা নেই। যদি ভারতে ধর্ষণকে একটা অপরাধ হিসেবে দেখেন সে ক্ষেত্রে দেখা যাবে বেশির ভাগ ধর্ষণেরই আইনি নালিশ হয় না। তাই চলচ্চিত্র শিল্পকে যেমন নিজেদের দিকে তাকিয়ে ভাবতে হবে যে, আমরা নারীকে কীভাবে উপস্থাপন করছি তেমনি অন্যত্রও অনেক কিছু করতে হবে। আমি মনে করি যে সবচেয়ে বড় সমস্যা এবং সব চয়ে বড় ইস্যু হলো-আমাদের আইন-শৃঙ্খলার অবস্থা আমাদের পুরোপুরি ব্যর্থ করে দিয়েছে।’

আপনার মন্তব্য

আলোচিত